ঢাকা     রোববার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৬ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

‘অলৌকিক’ লোক কবি হলধর নাগ

শাহিদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৭, ৩১ মার্চ ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘অলৌকিক’ লোক কবি হলধর নাগ

রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পদ্মশ্রী নিচ্ছেন হলধর নাগ

শাহিদুল ইসলাম : কবি এলেন খালি পায়ে। গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি। পরনে ধুতি। ঘাড়ের ওপর দিয়ে প্যাঁচানো সাদাটে চাদরে বুক ঢাকা। মাথায় বাবরি চুল। কৃষ্ণ বর্ণের ছিপছিপে গড়নের কবি এসে দাঁড়ালেন রাষ্ট্রপতির সামনে। পরিপাটি মঞ্চের সামনে বসে আছেন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। স্বভাবসুলভ নির্মোহ কবির হাতে রাষ্ট্রপতি তুলে দিলেন ‘পদশ্রী’ পদক। মুহুর্মুহু করতালিতে প্রকম্পিত হলো রাইসিনা হিলসের অন্দরমঞ্চ। কবি হলধর নাগ হয়ে উঠলেন ভারতের জাতীয় সম্পদ।

 

এই কবির বিদ্যার দৌড় মাত্র তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। অথচ তাকে নিয়ে গবেষণা করে এরই মধ্যে পাঁচজন পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন, আরো অনেকে গবেষণায় নেমেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করা হচ্ছে তার লেখা এক কুড়ি কাব্যগ্রন্থ। বিস্ময়কর প্রতিভার এই ব্যক্তি হলেন ওডিশা রাজ্যের ‘লোক কবি রত্ন’।  তার কবি প্রভিতার তুলনা শুধু তিনিই।

 

কবি হলধর নাগ সম্প্রতি ভারতের পদ্মশ্রী পদকে ভূষিত হয়েছেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির কাছ থেকে তিন দিন আগে পদক গ্রহণ করেছেন। পদ্মশ্রী পাওয়ার আগ পর্যন্ত ওডিশা রাজ্যের বাইরে তার পরিচিতি কম ছিল। একদিনেই সেই পরিচিতি জগতজুড়ে ছড়িয়ে গেল। কারণ তার ক্ষুরধার মেধার কথা শুনে তাকে একনজর দেখার ইচ্ছা নিবারণ করা কষ্টকর।

 

লোক কবি হলধর নাগ শুধু কবিই নন, তার চেয়ে বেশি কিছু। শুনলে অবাক হতে হয়- এই কবি যত কবিতা ও কাব্যগ্রন্থ লিখেছেন, পুরোটাই তার মুখস্থ! কেউ যদি কোনো কবিতার নাম, চরিত্র বা দু-এক চরণ উল্লেখ করে তাকে ওই কবিতা বলতে বলেন, তাহলে না দেখেই হড়হড় করে পুরো কবিতা বলে দিতে পারেন তিনি। বিশ্বে অনেক কবি, মহাকবির নাম শুনেছি আমরা। কিন্তু এমন চারণ কবির নাম শুনেছি কি- যিনি নিজের লেখা প্রতিটি কবিতা এমন কি পুরো কাব্যগ্রন্থ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুখস্থ বলতে পারেন? হলধর নাগ তা পারেন। এ জন্য তাকে ‘অলৌকিক’ কবিও বলা যায়।

 

 

ভারতের ওডিশা রাজ্যের বারগড় জেলার ঘেনসে ১৯৫০ সালের ৩১ মার্চ এক গরিব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন হলধর নাগ। আজ কবির জন্মদিন। কবির জন্য শুভেচ্ছা রইল। কবির বাবা ছিলেন মজুর। মাত্র ১০ বছর বয়সে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার বাবা মারা যান। তারপর বই হাতে আর স্কুলের বারান্দায় ওঠা হয়নি। সংসারের হাল ধরেন সেই অল্প বয়সে। হোটেলে হাড়িপাতিল পরিষ্কারের কাজ শুরু করেন। সে সময় মাকে নিয়ে খুব কষ্টে কাটে তাদের জীবন। হলধর নাগ তার সেই সময়ের স্মৃতি স্মরণ করে বলেছেন, ‘একজন বিধবার ছেলের জীবন কঠিনই হয়।’

 

এক গ্রামপ্রধান হলধর নাগকে একটি স্কুলে বাবুর্চির কাজ দেন। সেখানে থাকেন ১৫ বছর। এর মধ্যে আশেপাশে আরো কিছু স্কুল গড়ে ওঠে। এক ব্যাংকারের সঙ্গে কথা বলে ১ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজেই একটি দোকান দেন। কষ্টের দিন দূর হতে শুরু করে তার। এর মধ্যে বিয়েও করেন।

 

১৯৫০ থেকে ১৯৯০ সাল এই চার দশকে টানাহেঁচড়ার জীবনে কত কিই না ঘটে গেছে। হলধর নাগের জীবনে এ ৪০ বছর খেটেখুটে কোনোমতে বেঁচেবর্তে থাকার সংগ্রামী অধ্যায় বলতে হয়। দিন আনা দিন খাওয়া হলধর নাগ স্কুলে বাবুর্চির কাজ করার সময় আপন খেয়ালে কবিতা লেখা শুরু করেন। স্থানীয় একটি সাময়িকীতে তিনি চারটি কবিতা পাঠান। ধারাবাহিকভাবে চারটি কবিতাই ছাপা হয়। তার প্রথম কবিতা ‘বুড়ো অশ্বথ গাছ’। হলধরের কবি প্রতিভার সমাদরও করে ওই সাময়িকী। কিছু সম্মানী দিয়ে তাকে লেখায় উৎসাহিত করা হয়। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি। আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়েছে রাশি রাশি কবিতা। হলধর নাগের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে ওডিশার আনাচে-কানাচে। প্রতিবেশী রাজ্য ছত্তিশগড়েও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি।

 

পদ্মশ্রী ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক। সম্মানের এ পদক হলধর নাগকে দেওয়া হলেও তিনি যে ভাষায় কাব্য সাধনা করেন, তা ওডিশার সরকারি ভাষা নয়। ওডিশা রাজ্যের পশ্চিম ওডিশা অঞ্চলের মানুষের ভাষা কোসলি। উড়িয়া ভাষার রূপভেদ কোসলি, যাকে উড়িয়া ভাষায় ‘কোসালি’ বলা হয়। কোসলি ভাষাকে স্থানীয়ভাবে সম্বলপুরি ভাষাও বলা হয়। ১৯ শতকের আগে কোসলি ভাষার কোনো লিখিত রূপ পাওয়া যায় না। কিন্তু বহু আগে থেকে এ ভাষা পশ্চিম ওডিশার মানুষের মুখের ভাষা ছিল। ওডিশা রাজ্যে সরকারি ভাষা হিসেবে কোসলির স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন চলছে গত চার দশক ধরে। কবি হলধর নাগ আন্দোলনকারীদের একজন এবং বর্তমানে আন্দোলনের প্রথম সারির উচ্চকণ্ঠ।

 

সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলধর নাগকে ওডিশায় ‘লোক কবি রত্ন’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। ১৯ শতকে উড়িয়া ভাষার স্বভাব কবি গঙ্গাধর মেহেরের সঙ্গে তুলনা করা হয় তাকে। গঙ্গাধর মেহের সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যা লিখতেন, তাই যেন সাহিত্য-সোনায় পরিণত হতো। গঙ্গাধরের ধর্মীয় সংস্কার চেতনার ‘ভক্তি’ কবিতা আজো সমানভাবে জনপ্রিয়।

 

হলধর নাগের স্ত্রী মালতি নাগ। তাদের এক মেয়ে। হিন্দু ধর্মানুসারী তিনি। সহজ-সরল জীবনে অভ্যস্ত হলধর নাগ ধুতি ও স্যান্ডো গেঞ্জি ছাড়া অন্য কোনো পোশাক পরেন না। সব সময় খালি পায়ে থাকেন। কারো যদি বর্ণবাই থাকে, তবে হলধর নাগকে তার পছন্দ হবে না। জাদরেল গোঁফের মুখখানি নিষ্প্রভ মনে হলেও ভেতরের আলো তার ভাষাকে জীবন দেয়। শব্দের পরে শব্দজুড়ে তিনি লিখে যান গরিবের সুখ-দুঃখের কাব্য। সাধারণ শব্দও তার কবিতায় অসাধরণ হয়ে ওঠে প্রয়োগের সুচিন্তায়। তাই তো তিনি লোকের মাঝে থেকেও অলৌকিক।

 

 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মার্চ ২০১৬/রাসেল পারভেজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়