ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

কুয়াশার ফুল

অদিতি ফাল্গুনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৭:১৪, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০
কুয়াশার ফুল

ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে ভালো লাগে না জগদীশের। তবু বিরূপ উত্তরটা মুখে চলে এলো আজ- ‘ভাগ্যে তুমি বনশ্রীর মতো সুন্দরী ছিলা না। নাহলে রাজাকাররা কি তোমাকেও আর্মির হাতে তুইলা দিত না? তখন তোমার অবস্থাও আজকে ওর মতোই হইতো!’

 

তিন-চার দিন হয় সকাল থেকেই কুয়াশা। সারা দিনই কুয়াশা থাকে। দুপুরেও সূর্যের নাম-নিশানা নেই। তবু এই জেলা শহরের দুঁদে উকিল বলতে লোকে আজো তাঁকে এক নামে চেনে। দুই ছেলে বাবার সঙ্গে আইন ব্যবসায় নামলেও শেষ সওয়ালটা তাঁকেই করতে হয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায় শরীরটা এই পঁচাত্তর বছর বয়সেও শক্ত-পোক্ত আছে। শুরুতে তো এই মহামারির বছর কোর্ট বন্ধ। তবে গেল দু’তিন মাস হয় এই বয়সে আদালতে না গেলেও দুপুরের পর হালে এই মফস্বল শহরের মোড়ে গজানো এক পাঁচতলা সুপার মার্কেটের পাঁচ তলাতেই একটি তিন রুমের চেম্বারে বসেন তিনি। ঢাকা বা বড় শহরগুলোর কেতায় এই পাঁচতলা ভবনে দিব্যি একটি লিফটও যুক্ত হয়েছে। কাঁচের দরজা দেওয়া লিফট। আজ আগে আগেই যেতে হবে। বড় একটি কেস প্রতিপক্ষের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না দুই পুত্রধন ও আরো তিন যুবক সহকারী। দুই ছেলে অবশ্য বাবাকে নিয়ে ভয়েই আছে। ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। করোনায় পটপট করে মরছে সব সিনিয়র সিটিজেন বা সোজা বাংলায় ষাটোর্ধ্ব বুড়োরাই। তিনি, শ্রী জগদীশ দত্ত, এই বয়সেও দু’বেলা যোগ ও প্রাণায়াম করেন। আদা চা খান দিনে কয়েক কাপ। খাবার-দাবারে পরিমিত। এই বয়সে হার্টের সমস্যা, ডায়াবেটিস, হাই প্রেশার কিছুই বলতে গেলে নেই। তাই বলে সুপার মার্কেটের পাঁচতলা ভবনের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গেলে হাঁটুতে কি টান পড়ে না? পড়ে। বুকেও খানিকটা। লিফট থাকায় তাই শান্তি।

‘তোমার না গেলে চলে না?’
‘ঝামেলার কেস। সামনে ঢাকাতেও যেতে হতে পারে। ছেলে বা জুনিয়রদের দিয়ে ভরসা করা যায় না!’
‘শুধু কি কেসের জন্য?’ সত্তরের স্ত্রী ক্রুদ্ধ চোখে তাকান, ‘ঐ ধাঙর বেটি ওখানেই টয়লেট পরিষ্কার করার কাজ করে- জানি না বুঝি?’
‘উমা!’

প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে ধমকান জগদীশ। বুঝতে পারেন কনকনে কুয়াশার এই সকাল সাড়ে ন’টায় তার কপালে ঘাম জমছে আর বুকে একটি সূক্ষ্ম ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে।
‘বনশ্রীকে তুমি ধাঙর মহিলা বলতেছ উমা? বলতে পারলা? মুখে একবারও আটকাইলো না? সে তো তোমারই স্কুলের সিনিয়র দিদি ছিল। তোমার দুই বছরের বড়।’
‘হ্যাঁ- প্রেমে তো পড়ছিলা। সব জানি। বামুন হয়ে চাঁদে হাত দিতে গিছিলা। কায়স্থের ছেলে হইয়া বামুনের মেয়ে বিয়ে করতে চাইছিলা। বনশ্রীর বাপ তো রাজি হয়নি। তা এত বামনাইপানা শেষে এখন হইছে ধাঙর-মেথর!’
‘উমা!’

খাবারের টেবিল থেকে উঠে দাঁড়ান জগদীশ। ভাগ্যি ভালো দুই ছেলের ঘর থেকেই টিভির সাউন্ড ভেসে আসছে। পুত্রবধূ, নাতি-নাতনীদের কলহাস্য। শুনতে পাচ্ছে না তারা বৃদ্ধ এই দম্পতির চাপান-উতোর। কাউকেই কড়া, ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে ভালো লাগে না জগদীশের। অথবা আক্রমণের মুখে প্রতি-আক্রমণ। তবু বিরূপ উত্তরটা মুখে চলে এলো আজ- ‘ভাগ্যে তুমি বনশ্রীর মতো সুন্দরী ছিলা না। নাহলে রাজাকাররা কি তোমাকেও আর্মির হাতে তুইলা দিত না? তখন তোমার অবস্থাও আজকে ওর মতোই হইতো!’
‘আহারে সুন্দরী! সুন্দরী এখন মুসলমান বাড়ির মেয়েদের মতো মাথায় ওড়না পেঁচায়; ঝাঁটা আর ব্রাশ হাতে মার্কেটের হাগাখানা সাফ করে। হা- হা- তা-ও এই চাকরিটা বুড়া বয়সে তোমার সুপারিশেই পাইছে জানি।’
ফর্সা মুখের প্রতিটি শিরা লাল হয়ে দপদপ করছে জগদীশের।
‘আর একটা কথা বললে তোমারে আমি খুন করবো- উমা! ঐ মার্কেটের মালিক এক হজ্ব করা মানুষ। তার মার্কেটে সুইপার মহিলাদের মাথায় ওড়না পেঁচায় যেতে হয়; কোনো হিন্দু-মুসলমান নাই।’
এটুকু বলতে বলতে কেমন নিস্তেজ আর অসাড় বোধ করতে থাকেন জগদীশ।
দুই পুত্রবধূর ভেতর ছোট পুত্রবধূ ঘর থেকে বের হয়ে এদিকে এসেছে।
‘বাবা, না খেয়ে উঠে পড়লেন?’

এই মেয়েটি গোস্বামী ঘরের মেয়ে। বড় বউমা সাহা ঘরের মেয়ে। মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশে হিন্দুদের জাত-পাত পাকিস্তানি আমল পর্যন্ত তা-ও যতটা বা যতটুকু ছিল, এখন আর কিছুই নেই। এখন কে কাকে বিয়ে করে তার কোনো ঠিক নেই। কোনো মতে পাত্র-পাত্রী মিললেই সবাই কত খুশী! কমতে কমতে দেশে তো আর ছেলেমেয়েই নেই হিসাব-নিকাশ করে বিয়ে করার! আর মুক্তিযুদ্ধের সময়েই জগদীশ দত্ত প্রথম জানতে পারেন যে মুসলমান বাড়িতে ভাত খেলেও ‘জাত’ যায় না। মানুষ যেমন ছিল তেমনটাই থাকে বা থেকে যায়।
‘না মা, শরীরটা ভালো নাই।’
‘তাহলে কি চেম্বারে যাবেন এখন? আজ তো শনিবার।’
‘না মা, কাজের আর শুক্র-শনি কি? আমার একটু যাইতেই হবে। আমি দুপুরের ভেতর আইসা পড়বো। অয়ন-চয়নকে বইলো আমি ফিরা আসার পর যাইতে। নাতিদের পরীক্ষা আছে সামনে। ওরা থাকুক।’
পুত্রবধূর সামনে ভাগ্যিস উমা আর মুখ খোলে না।
‘চা খাবেন, বাবা? চা করে দেব? নাকি কফি খাবেন একটু?’
‘কফি দাও তাইলে।’

অর্চি কফি বানিয়ে আনলে সেটা খেয়েই তিনি বের হয়ে পড়েন। সুপার মার্কেট তার বাসা থেকে বেশি দূরে নয়। হাঁটলে ত্রিশ মিনিটের রাস্তা আর রিকশা নিলে দশ মিনিট। গাড়িও আছে একটা। গাড়িই বের করলেন। গাড়ি পৌঁছে গেল পাঁচ মিনিটে। কনকনে কুয়াশা। মার্কেটের লিফট মাত্র শুরু হয়েছে। ঘরে পঁয়ষট্টির বুড়ি বউ উমা যতই এই বয়সেও সন্দেহে মুখ ভার করে থাকুক সত্যি বলতে এই সুপার মার্কেটে সবসময় বা প্রতিদিনই কি আর বনশ্রীর সঙ্গে আর তাঁর দেখা হয়? বনশ্রী। বনশ্রী আচার্য। সেই ১৯৬৫ সালের কথা। তাদের ছোট্ট, একটেরে মফস্বল শহর। শহরের একটি মাত্র সিনেমা হলে সাদা-কালোয় শবনম-রহমান বা সুচন্দা-রহমানের ছবি। অপূর্ব সব ঢিমে তালের মিষ্টি গান। মরে আসতে থাকা নদীর পাশে একটিই কো-এডুকেশন কাম কলেজ ও ইউনিভার্সিটি। সেখানেই শহরের একমাত্র ‘বালিকা বিদ্যালয়ে’র ক্লাস টেনের সুন্দরীতমা মেয়ে বনশ্রী আচার্য ভর্তি হলো আর্টসে ইন্টার প্রথম বর্ষে। জগদীশরা তখন ইন্টার শেষ করে সেই কলেজেই বিএ অনার্সে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন। বনশ্রীর পেছনে ঠিক কে যে ঘোরে না কে জানে? ঘোরে বিএ অনার্সের থার্ড ইয়ারের হিরন্ময় গাঙ্গুলী দা (সে বয়সে সিনিয়রতম ও কাস্টের হিসেবেও এগিয়ে থাকা বিবেচনায় বনশ্রীর সব পাণিপ্রার্থীর কাছে গণশত্রু নম্বর এক), ঘোরে সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ নেতা মুস্তাফিজুর রহমান ভাই ও আলী কিবরিয়া ভাই, ঘোরে কলেজের একমাত্র গিটার বাজিয়ে গায়ক উইলিয়াম ডি কস্টা এবং সে জগদীশ দত্ত। তবে বনশ্রীকে খুব হুঁশিয়ার মেয়ে মনে হয়। সে সখী পরিবেষ্টিতাই থাকে। সব ভক্তের অনুরাগাকুল চোখের দিকে তাকিয়েই সে লাজুক, স্মিত মুখে মাথা নিচু করে চলে যায়। এমন সুখের দিনই চলতো হয়তো যদি না দেশে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হতো। ততদিনে বনশ্রীরা ইন্টার দ্বিতীয় বর্ষে ‘উঠি-উঠবো’ করছে। একদিন কলেজ কেন্টিনে আত্মহত্যার সঙ্কল্প জানালেন হিরন্ময়দা। কেন?
‘কোথায় ইন্ডিয়া-পাকিস্তান যুদ্ধ হচ্ছে আর বনশ্রীর বাবা মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেলছেন। তা-ও শহর থেকে খানিকটা গ্রামের ভেতরে- ছেলে ইন্টার ফেল কাঠের ব্যবসায়ী। কাস্টে মিল আছে আর অনেক পয়সা।’

বনশ্রী আচার্য লিফটের কলবেলে হাত দিয়েও লিফটের ভেতরে তিন-তিনজন ভদ্রলোককে দেখে ইতঃস্তত করে। তারপরই হঠাৎ ক্ষয়ে আসা অথবা বার্দ্ধক্যে কমে আসা দাঁতের মুখে জগদীশকে দেখে হেসে সম্ভাষণ করে, ‘ভালো আছেন, স্যার?’ ‘স্যার’ সম্বোধনটা জগদীশের বুকে ধাক্কা দেয়। যেন নদীর পাড় ভেঙে ধ্বসে পড়ছে মাটি। জগদীশ ‘দাদা’ ছিল বনশ্রীর। কলেজের দাদা। 


‘দাদা, তুমি তো গিয়ে ওর বাপকে প্রপোজ করলেই পারো। এক ধর্ম, এক কাস্ট, তাতে বয়সে সবচেয়ে সিনিয়র। আর এক বছর পরই মাস্টার্স দেবে!’ মুখ গোমড়া করে বলল মুস্তাফিজুর ও আলী কিবরিয়া। সেদিন হিরন্ময়ের ‘গণশত্রু’ অবস্থান পাণিপ্রার্থী দলের অন্য সবাই ভুলে যায়।
‘নাহ্, ঘাড়ের উপর দু’টো দিদির এখনো বিয়ে হয়নি। আমার চাকরি নেই।’ হিরন্ময়দা হাত নাড়ে। ক্যান্টিনে সেদিন তারা কয়েকটা সিঙ্গারা আর কয়েক কাপ চায়ে টাকা বেশি উড়ায় আর উইলিয়াম ডি কস্টা কলেজ ক্যান্টিনের পেছনের অন্ধকার বারান্দায় বসে গিটারে টং টং আওয়াজ তোলে:
‘সে যে বনলতা-
নয় নয় সে যে ট্রয়ের হেলেন,
নও তুমি সীতা-
ওহে মনোনীতা!’

নাহ্, সাহস বলে সাহস, অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র জগদীশ সত্যি সত্যি বনশ্রীদের একতলা বাড়ির যার ছাদটি টিনের আর নিচে পাকা দালান এবং সামনে কামিনী ফুল, জবা আর শীতের দিনে গাঁদা গাছের ঝোঁপ আর বসতবাড়ির তিন হাত দূরত্বে বনশ্রীর বাবার আয়ূর্বেদিক ওষুধের একটি দোকান, সেখানে গিয়ে লাল মুখে নিজের দাবি তুলতে পেরেছিল। বলেছিল যে জাতি প্রথা আজকাল আর কোনো বিষয় নয় এবং এটা মনুষ্য সৃষ্ট আর এই প্রথা থেকেই ভারতবর্ষের সব দুর্ভাগ্য তথা দেশভাগ। শুধুই বর্ণের কারণে শহর থেকে সামান্য দূরে একটি গ্রামে এক ইন্টার ফেল কাঠের ব্যবসায়ীর হাতে মেয়ের বিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বনশ্রী মেধাবী ছাত্রী এবং তার পড়াশোনার দিকটাও বিবেচনা করা প্রয়োজন। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের জন্য মেয়ের এত অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া অনুচিত এবং নিতান্ত যদি দিতেও হয়, সে জগদীশ দত্ত এই মুহূর্তে চাকরিতে না থাকলেও বাড়ির বড় ছেলে এবং তাদের বাড়ির অবস্থা ভালো। সে একমাত্র ছেলে এবং দুই দিদির বিয়ে হয়েছে। ঈশ্বরের কোনো অলৌকিক কৃপায় তাদের পরিবার এখনো ‘শত্রু সম্পত্তি আইনে’র খড়গানলে পড়েনি এবং সে তার বাবা-মাকে রাজি করাতে পারবে।
‘তুমি কার পোলা? নরেশের পোলা তুমি? বেত্তমিজ কোথাকার! বাপ-মা আদব-কায়দা কিছু শেখায় নাই? মুখ টিপলে এখনো দুধের গন্ধ বাইরায় আর বিয়ার প্রস্তাব নিয়া আসছে? ভাগ!’

সেখানে ক্ষান্ত হলেই হতো। বনশ্রীর রাগী বাবা সাইকেলে চেপে সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় এসেই ঘটনা জানায়। সেই রাতে বাবা গায়ে হাত না তুললেও অকথ্য গালাগালি বয়ে যায় বাড়িতে। পরের এক মাসের ভেতরেই বনশ্রীর বিয়ে হয়ে যায় এবং এমনি ভাগ্য যে, মা আর বিধবা ছোট পিসী বনশ্রীদের বাড়ি থেকে দিব্যি বিয়ে বাড়ি থেকে যথারীতি আমিষ ও নিরামিষের আহার সেরে আসে। ছোট পিসী একা মানুষ ছিলেন বলেই খানিকটা বন্ধুর মতো ছিলেন। একটা প্রাথমিক স্কুলে পড়াতেনও।
‘শোন বাবা, মন খারাপ কইরো না। তুমি তো এখনো ছোট, বুঝলা না? তাতে অগো জাত আলাদা। বনশ্রীর বাপ বিয়া না দিয়ে পারে নাই। একে মেয়ে সুন্দরী তাতে দেশ পাকিস্তান হইয়া গেছে আজ আস্টো বচ্ছর। এরপর  যুদ্ধ লাগছে- কখন কি হয়! মন খারাপ করে নাগো লক্ষী সোনা- এই তো সেকেন্ড ইয়ারে উঠছ। আগামীবার অনার্স ফাইন্যাল দিলেই তো একটা চাকরিতে ঢুকতে পারবা। তখন তোমার জন্য সুন্দরী দেইখা বউ আনমুআনে।’

তা সেই বনশ্রীর বিয়ে হয়ে গেল দেড় মাইল দূরের গ্রামে এক কাঠের ব্যবসা করে এমন ছেলের ঘরে। বছর না যেতে ছেলে কোলে এলোও সে। সেই বছরই অনার্স হয়ে গেল জগদীশের, আর কালো ও একটু গোলগাল উমা মেয়ে হয়েও একাধিক প্রেমপত্র সেই প্রথম জগদীশকে পাঠায়। বাবার বাড়িতে ছেলে কোলে আসা বনশ্রী বাচ্চা হবার পরও মোটা হয়নি বরং আরো সুন্দর হয়েছে। অষ্টমী পূজার মণ্ডপে দূর থেকে বনশ্রীকে দেখে জগদীশের মেজাজ আরো চড়ে গেছিল, আর শহরের নামী উকিলের মেয়ে উমারপাঠানো দ্বিতীয় প্রেমপত্রের উত্তর সে ভালো মনেই সেই রাতে লিখে:
‘রূপ অতি ক্ষণস্থায়ী বিষয়, উমা। মানুষের মনের সৌন্দর্যই শাশ্বত সৌন্দর্য। সেই রূপে তোমাকে হারায় সাধ্য কার? তুমি চিরদিন আমার মনের সম্রাজ্ঞী হয়ে থাকবে।’

ছোট পিসীই বাবার সঙ্গে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক করে ভাইপোর অত অল্প বয়সে বিয়ে হতে সাহায্য করেছিল- ‘বাপ হইয়া কোনদিন চারদিক একটু তাকায় দেখলি না, মেজদা! বুঝিস এক এসি ল্যান্ড অফিসের সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরি। পোলাটা এক বছর ধইরা মুখ কালো কইরা ঘুইরা বেড়ায়। কোনদিন সেই দিকে ভালো কইরা চাইয়া দ্যাখছস?’
মা’র একটু অমত ছিল উমা কালো আর গোল-গাল বলে।
‘মা কালীও কালো গো, বউদি! জগজ্জননী শ্যামার মতো সুন্দরী আর কে আছে? বলি এক ধলা সুন্দরীর ঠোনা খাইয়া তোমার পোলা যে একটা বচ্ছর ভালো মতো খাওয়া-দাওয়া করে না! এই মেয়ে ওরে সুখী করতে পারলে তো ভালোই হয়। এছাড়া মেয়ের ফ্যামিলি ভালো। আমাগো কাস্ট। বাপ শহরের নাম করা ল ইয়ার। এক দাদা আমেরিকা গেছে। এমন ফ্যামিলি পাইবা আর? বনশ্রীরা জাতেই বামন। এগো শিক্ষা-দীক্ষা, টাকা-পয়সা বেশি। সেইটা দেখবা না?’
যুক্তি পছন্দ হয়েছিল বাবা-মা’র- ‘হ্যাঁ, এরা অনেক বেশি শিক্ষিত।’
তা সেই ১৯৬৫ সালে যদি বনশ্রীর বিয়ে হয়, জগদীশ বিয়ে করেছিলেন ১৯৬৭ সালে- মাত্র বছর একুশ বয়সে। এখনকার ছেলে-মেয়েরা এটা বিশ্বাসই করতে চাইবে না। তার ছোট ছেলে বিয়ে করেছে প্রায় আটত্রিশে গিয়ে। ছোট বউমা তখন পঁয়ত্রিশ ছুঁইছুঁই। দেখলে পঁচিশও মনে হয় না।


‘স্যার, মার্কেট তো আইসা গেছে। নামবেন না ‘
ওহ, এই কনকনে, হিম সাদা কুয়াশার সকালে স্মৃতি রোমন্থনে দশ মিনিটের রাস্তা যেন দশ সেকেন্ডে ফুরিয়ে গেল! মন তো বাতাসের চেয়েও দ্রুতগামী। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন বকরূপী ধর্মকে। মার্কেট খুলেছে কি? ক্লায়েন্ট পার্টি সকাল সাড়ে দশটায় আসার কথা। শহরের নাম করা এক অভিজাত ইসমাইলী পরিবারের দুই ভাইয়ের সম্পত্তির শরিকানা নিয়ে সেই আইয়ুব খানের আমল থেকে মামলা চলছে।  হ্যাঁ, ওই তো মার্কেটের লিফট খুলেছে। একে ঘনঘোর কুয়াশা আর তাতে করোনা মিলিয়ে আজ যেন মার্কেটে মানুষ কম। লিফটের ঝাঁপি খুলতে না খুলতে সেখানে ঢুকে সুইচে হাত দিতে গিয়েই আরো কেউ কি কল টিপলো? মুখে মাস্ক পরা দুই যুবক ঢুকলো। তৃতীয় মানুষটি কে? বনশ্রী না? গায়ে একটা সস্তা ফুল-ছাপা মেক্সির উপর ওড়না চুল আর কানে প্যাঁচানো। বাহাত্তরের শরীর এখনো ছিপছিপে। হাতে একটা বালতি, ঝাঁটা, ঘর মোছার ব্রাশ আর বালতির ভেতর হারপিকের কৌটা ও টয়লেট পরিষ্কারের ব্রাশ। সুপার মার্কেটের টয়লেট। বারো জাতের মানুষ। বারো জাতের মানুষের গু-মুত সাফ করা, সিঁড়ি ঝাড়ু দেওয়া, পাঁচ তলার বিভিন্ন ঘর ও মেঝে ঝাড়ু দেওয়া বা পরিষ্কার করার কাজ করে বনশ্রী আচার্য। বীরাঙ্গনা। বীরাঙ্গনা পরিচয়েই এই চাকরিটা পেয়েছে সে বুড়ো বয়সে। কোনোমতে। মার্কেট কমিটির কাছে জগদীশের সুপারিশ ছিল? হ্যাঁ, ছিল।

লিফটের ভেতরে ততক্ষণে জগদীশসহ আরো দুই যুবক ঢুকে পড়েছে। ধাঙরনী বনশ্রী আচার্য, ওহ! ওটা কুমারী নাম। ওর বরের পদবী কি ছিল? ছিল কিছু একটা; ধাঙরনী বনশ্রী আচার্য লিফটের কলবেলে হাত দিয়েও লিফটের ভেতরে তিন-তিনজন ভদ্রলোককে দেখে ইতঃস্তত করে।
‘থাক, আমি পরে আসি।’
তারপরই ক্ষয়ে আসা অথবা বার্দ্ধক্যে কমে আসা দাঁতের মুখে জগদীশকে দেখে হেসে সম্ভাষণ করে, ‘ভালো আছেন, স্যার?’
‘স্যার’ সম্বোধনটা জগদীশের বুকে ধাক্কা দেয়। যেন নদীর পাড় ভেঙে ধ্বসে পড়ছে মাটি। জগদীশ ‘দাদা’ ছিল বনশ্রীর। কলেজের দাদা।
‘আরে আসো-আসো, ভেতরে আসো!’
অনেকটা কুঁকড়ে, যেন বাস্তবিকই আজ মেথরনী হয়ে যাওয়া বনশ্রী তার হাতে টয়লেট ব্রাশ, হারপিক আর ঝাড়ুসহ বালতি এবং নিজেকে সমেত দুই যুবক ও এক বৃদ্ধসহ তিন ভদ্রলোকের হাত থেকে নিজের অশুচিতাকে দূরে রাখতে এক কোণে গুটিয়ে-সুটিয়ে থাকে।

সত্তরের জানুয়ারিতে তৃতীয় সন্তান প্রসবের আগে বনশ্রী আবার এসেছিল আয়ুর্বেদিক ওষুধের একটি ছোট্ট দোকানের মালিক বাবা হরিচরণ আচার্যর বাসায়। তৃতীয় সন্তান হবার পর সে আবার দ্রুতই শুকিয়ে যেতে শুরু করে। বনশ্রীর ছোট দুই ভাইকে ততদিনে ভারতে পাঠানো হয়েছে সেখানেই ভবিষ্যৎ গড়ার আশায়। বনশ্রীর বর তখনো তার কাঠের ব্যবসা নিয়ে গ্রাম আবার খানিকটা গঞ্জের মতো জায়গাতেই রয়ে গেছে। তিনটি সন্তানের মা বনশ্রীর এখনো বাড়তে থাকা রূপ নিয়ে কলেজের প্রাক্তন প্রেমিক গোষ্ঠি সেবারও দমিত যাতনা প্রকাশ করেছিল নিজেদের মধ্যে। হিরন্ময়দা ততদিনে ভারতে দেশান্তরী। ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের মোস্তাফিজুর ও আলী কিবরিয়া রাজনীতি নিয়ে বিষম ব্যস্ত। উইলিয়াম ঢাকায় গেছিল। সেখানে সে শেরাটন হোটেলে সন্ধ্যায় গান গায় গিটার বাজিয়ে। ছোট বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে উইলিয়াম এসেছিল সেবার সেই ছোট্ট শহরে।একা জগদীশই ততদিনে ব্যস্ত উকিল শ্বশুরের প্রিয় জামাতা ও উদীয়মান আইনজীবী। বড় ছেলের বয়স দুই বছর তবে ছোট ছেলের তখনো জন্ম হয়নি। এরই ভেতর পুরনো বন্ধুরা মাঝে মাঝে সময় করে তারা বসতো বা আড্ডা দিত। মার্চ শেষ হয়ে এপ্রিল আসতে না আসতেই এলো সেই দিন। শহরের হিন্দু পাড়ায় অবিবাহিতা মেয়ে কেউই রক্ষা পায়নি। বিবাহিতাদের ভেতরেও সুন্দরীরা ছাড় পায়নি। এছাড়াও কোন বাড়ির ছেলে মুক্তিযুদ্ধে গেছে আর কোন বাড়ি থেকে রেডিওতে ৭ই মার্চের ভাষণ শোনা গেছে, কে আওয়ামী লীগ করে আর কার বাসায় ‘আকাশবাণী’ শোনা যায় সেই সব বাসার মেয়েদেরও কাউকে কাউকে নাকি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথম সন্তান জন্মের পর এম্নিতেই মোটা উমা আরো অনেকটাই মুটিয়ে যায়। এছাড়া উমার বুদ্ধিমান বাবা মুসলিম লীগের নেতাদেরও মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে হাতে রাখতেন সবসময়। তাদের বাসায় হামলা হয়নি।

‘আসলে বনশ্রীদি’কে ছাড়ানো যেত। ঘটনা হলো উনি খানিকটা ঐ পাঞ্জাবী মেয়েদের মতই লম্বা-ফর্সা কিনা, পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন ওনাকে খুব পছন্দ করেছে। ওনাকে ছাড়তেই চাচ্ছে না,’ বলেছিল রাজাকার ক্যাম্পের এক পরিচিত ছেলে। বর্ডারের যুদ্ধ থেকে ফিরে মুস্তাফিজুর আর কিবরিয়া বনশ্রীকে উদ্ধার করেছিল শহরে আর্মি ক্যাম্পেরই বাঙ্কার থেকে।

 

৩রা এপ্রিল দুপুরের পর... রবিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছিল তখন। বাজার-ঘাট বলতে গেলে শূণ্য, তবু বাসার জন্য চাল কিনতে বের হয়ে পথে বনশ্রীর মা’র সঙ্গে দেখা হয় জগদীশের।
‘ও বাপ জগদীশ, ও বাপ জগদীশ! একটু দাঁড়াও। আমার মাইয়াটারে...’
‘কী হয়েছে?’
‘আমার মাইয়াটারে...’
‘কী হয়েছে মাসীমা?’
‘আমার বিয়াতো, বাচ্চাঅলা মাইয়াটারে রাজাকারেরা যে ধইরা নিয়া গেল! কোনো কথাই শুনলো না! আমি হাত-পাও ধইরা কত কান্দলাম! কত আছাড়ি-পিছাড়ি গেলাম। অর জামাই তো গ্রামে ব্যবসা দেখতাছে। তিনটা বাচ্চা ছোট ছোট। বাচ্চাগুলার সামনে দিয়া মাইয়াটারে জীপে তুললো। ও বাবা জগদীশ, আমি এহন কি করি গো, ঠাহুর!’
‘মাসীমা, কি বলছেন! বনশ্রীকে রাজাকারেরা নিয়া গেছে? আগেই সাবধান হইলেন না আপনারা? আগেই পালাইতে পারতেন!’
‘বাবা, দুই পোলারে ইন্ডিয়া পাঠাইছি অগো মামাগো কাছে। মাইয়া একখান ছিল। সুন্দরী বইলা বিয়া দিছি তাড়াতাড়ি। তিন বাচ্চার মারে কেরা কি করবো এমন ভাবছিলাম! আর বেশি টাকা-পয়সা তো আমাগো নাই যে অনেক লুট হবে।’
‘মেসোমশায় কোথায়?’
‘উনি জ্ঞান হারাইছেন। ওনার জন্য ডাক্তার ডাকুম না মাইয়ারে খুঁজতে থানায় যামু?’

সেই দুঃসময়ে সাধ্য মতো করেছিল অবশ্য জগদীশ। শ্বশুর মুসলিম লীগের যে নেতাদের চাঁদা দিতেন প্রতি মাসে, তাদের মাধ্যমে বনশ্রীকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টাও করেছিল সে খুব।
‘আসলে বনশ্রীদি’কে ছাড়ানো যেত। ঘটনা হলো উনি খানিকটা ঐ পাঞ্জাবী মেয়েদের মতই লম্বা-ফর্সা কিনা, পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন ওনাকে খুব পছন্দ করেছে। ওনাকে ছাড়তেই চাচ্ছে না,’ বলেছিল রাজাকার ক্যাম্পের এক পরিচিত ছেলে। বর্ডারের যুদ্ধ থেকে ফিরে মুস্তাফিজুর আর কিবরিয়া বনশ্রীকে উদ্ধার করেছিল শহরে আর্মি ক্যাম্পেরই বাঙ্কার থেকে। শেষের দিকে ভারতীয় বিমান বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানিরা যখন বাঙ্কারে লুকিয়েছে, তখন সেখানেই নিয়ে গিয়েছিল বটে তারা যুদ্ধবন্দি যত বাঙালি মেয়েকে! আর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের ভেতরে এই মধ্যবর্তী সময়েই বনশ্রীর স্বামী এসে তার তিন বাচ্চাকে নিয়ে গেছিল। বলে গেছিল রাবণের হাতে পড়া সীতাকে সে আর ফিরিয়ে নেবে না। আরো বলেছিল, বিয়েও করবে সে অতি তাড়াতাড়ি। বারোভোগ্যা, নষ্ট হয়ে যাওয়া মায়ের হাতে বাচ্চাদের বড় করাবে না সে।
বনশ্রীর বাবার এরপর স্ট্রোক হয়েছিল আর মাসীমার কান্না থামানোই যেত না, ‘আমরা জাত-জাত করছি। তোমারে কায়স্থ বইলা জামাই করি নাই। আইজ তুমি হইলে হয়তো আমার মেয়েরে ঘরে ফিরায় নিতা। তার কষ্টটা বুঝতা। তার মূল্যটা দিতা। সেই পাপের শাস্তি লাগলো আমাগো গায়ে। আমি এখন কি করি, বাবা? ওর জামাই তিন বাচ্চা সুদ্ধা ইন্ডিয়া পলাইছে। তারে এখন আমি কোথায় খুঁজমু? এদিকে অর তো আবার বাচ্চা হইবো। খানেগো বাচ্চা। অয় তো গর্ভনাশের জইন্য পাগল হইয়া গেছে। আমি কোথায় যামু, ঠাহুর? ঠাহুর আমারে মরণ দ্যায় না ক্যান?’

এদিকে জগদীশের ঘরেও তখন অশান্তি চরমে।
‘আমার তো মনে হয় তুমিই তোমার আগের প্রেমিকারে রাজাকারদের হাতে তুইলা দিছ য্যানো ওর জামাই ওরে ছাইড়া দেয়। আর পরে তুমি মহান সাইজা তারে বিয়া করতে পারো- হায় ভগবান!’
কোন কুক্ষণে বাসরঘরে ‘সঙ্গিনীকে সব সত্য কথা বলা’র বোকামি পেয়ে বসায় বনশ্রীর প্রতি তার নিতান্ত একপাক্ষিক ভালো লাগার গল্প সে করে ফেলেছিল নাম-ধাম সহকারে!
‘স্টুপিডিটির একটা সীমা আছে, উমা!’
‘তা তো বলবাই। আমার বাপের পয়সায় ল পাশ দিয়া, উকিল হইয়া এখন আমারেই তো বলবা!’

বনশ্রীকে আওয়ামী লীগ থেকে ন্যাপসহ সব দলে পরিচিতদের হাতে-পায়ে ধরে ঢাকায় যুদ্ধে ধর্ষিতা মেয়েদের আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠিয়েছিল জগদীশ। তারপর অনেক অনেক বছর কোনো খোঁজ বাস্তবিকই ছিল না। ওর বাবা মারা গেছিলেন বাহাত্তরের অক্টোবরে আর মা’কে ওর মামারা এসে ভারত নিয়ে যায়। ওদের বাড়িটা বেশ কিছু বছর অমন ফাঁকা পড়েছিল। আর বঙ্গবন্ধুর হত্যারও বছরতিনেক পরে ‘দাঁড়ি-পাল্লা মোটর গ্যারাজ’ নামে একটি সাইনবোর্ড লাগে সেই পরিত্যক্ত বাড়ি ও আয়ূর্বেদিক ওষুধের দোকানে। দোকানের মালিক একাত্তরে এলাকার শান্তি কমিটির প্রধান। তার সেজো ছেলেই শহরে পাঁচতলা এই মার্কেটের মালিক। সেখানেই মাসে নিয়মিত ত্রিশ হাজার টাকা ভাড়া দিয়ে এই চেম্বার নিয়েছেন তিনি। মাঝখানে অবশ্য বহু বহু বছর বনশ্রীর আর কোনো খবরই কোথাও ছিল না। আদালত পাড়া, অভ্যস্ততার স্ত্রী আর দুই ছেলের বড় হওয়া নিয়ে ব্যপৃত জগদীশের মাথা থেকেও হারিয়ে গেছিল সে। মাঝে মাঝে উড়ো খবর আসত। আয়ুর্বেদিক ঔষাধালয়ের হরিচরণ আচার্যর মেয়ে বনশ্রী ঢাকায় ফাইভ-স্টার হোটেলে এখন উঁচু রেটের কলগার্ল। কেউ বলতো, সে আছে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে। কেউ বলতো, সে ভারতে চলে গেছে। কেউ বলতো, তার বিয়ে হয়েছে ধনী মুসলিম ব্যবসায়ীর তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে। তবে আসল কথা বনশ্রীকে নিয়ে এসব গুজবই শোনা গেছে শুধু যতদিন না...যতদিন না...পাঁচ বছর আগের একদিন... সেই দিনটা ভোলার না। মোস্তাফিজুর ততদিনে মারা গেছে। পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের আলী কিবরিয়া দুপুর বেলা খোদ আদালতেই জগদীশের রুমে এসেছিল, ‘আজ তোকে এমন এক আশ্চর্য খবর দেব যে ভাবতেই পারবি না!’
‘কী খবর?’
‘সেই যে আমাদের কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে একটা খুব সুন্দরী মেয়ে ভর্তি হয়েছিল না ‘আয়ুর্বেদিক ঔষধালয়ে’র হরিচরণ আচার্য কাকার মেয়ে বনশ্রী আচার্য; যার বাবা তাকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় হুট করে বিয়ে দিয়ে দিলো আর মানে, মানে ঐ রাজাকাররা ওকে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে গেল!’
‘হ্যাঁ।’
‘ওকে নিয়ে কত গুজব কাণে এসেছে নানা সময়ে, না?’
‘গতকাল সে আমাদের পার্টি অফিসে এসেছিল। মেয়েটা ঢাকায় অনেকদিন নানা জায়গায় কাজ করেছে। পরের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ থেকে বস্তিতে থেকে দাইগিরি- কিচ্ছু বাকি রাখেনি। এখন বয়স হয়েছে, শরীর ভেঙ্গে এসেছে। আমার কাছে মুক্তিযোদ্ধা মানে নির্যাতিতা, বীরাঙ্গনা নারী হিসেবে একটি কার্ড চায়। আর বলছিল একটা চাকরি, মানে নিদেনপক্ষে একটা সুইপারের চাকরিও যদি পায়! তুই তো আল ফাহিয়ান সুপারমার্কেটে চেম্বার খুলেছিস। ওখানের মালিককে বলে যদি একটা সুইপারের চাকরিও দিতে পারিস?’

তারানা তারান্নুম নামের এই বাইশ বছরের মেয়েটির ঝলমলে চুল আর হলদে সালোয়ার-কামিজ তার পাঁচতলার চেম্বার রুমের জানালার কাঁচে জমে ওঠা শাদা কুয়াশার কনকনে হিম কাটিয়ে চাঙ্গা করে তুলছে মামলার ভারে বিপর্যস্ত পরিবারগুলো থেকে আসা সব ক্লায়েন্টকে, তরুণ তিন সহকারীকে অথবা গোটা পরিবেশকেই। যৌবন এমনই।

 

‘সুইপারের চাকরি করবে? বনশ্রী? কি বলছিস তুই? একটা ব্রাহ্মণ ঘরের মেয়ে... যদিও আমি কাস্টিস্ট না, ও কলেজে ভর্তি হয়েছিল... কি বলছিস!’
‘একটু বাস্তববাদী ভাবে ভাব, প্লিজ! ও কলেজের ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত পড়েছে। তবু যুদ্ধে রেপড হওয়া এমন মেয়েদের আমরা একটা প্রাইমারি স্কুলের টিচারের চাকরিও দেইনি। কিছু মনে করিস না, তোদের হিন্দু ঘরগুলায় ধর্ষিতা মেয়েদের আরো বেশি হারে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। এতগুলো বছর ও যে কোনো রকমে বেঁচে আছে, সেটাই আশ্চর্যের! একজন নারী যার স্বামী নেই, সন্তান নেই, মা-বাবা-ভাই-বোন কেউ নেই। অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় পড়াশোনা শেষ হয়নি, চাকরি নেই। শেষ বয়সটা একটা সুইপারের কাজ পেলেও তো বেঁচে যায়। মাসে একটা স্টেডি ইনকাম যত কমই হোক থাকবে। আর আমি দেখি ওর জন্য বস্তিতে একটা ঘর ভাড়ার ব্যবস্থা করে দেয়া যায় কিনা।’
‘ওর তো বয়স হয়েছে। এই বয়সে এই সুইপারের কাজ করতে পারবে? এতদিন কোথায় ছিল জিজ্ঞাসা করেছিস কিছু ‘
‘না রে, আমি অত ভেঙে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে যাইনি! শুধু বললো ঢাকায় এই শেষ বয়সে আর পারছে না। বাড়ির কথাও মনে পড়ছিল। এখানেই শেষ জীবনটা থাকবে। আর তার শরীরের গাঁথুনি এখনো শক্ত, দিব্যি সিঁড়ি ভেঙে ওঠা-নামা করতে পারে। এত বয়স হয়েছে দেখে মনে হয় না। ঐ যে কাব্যে-উপন্যাসে পড়া যায় না কিছু নায়িকা আজীবন সুন্দরী থাকে। ট্রয়ের যুদ্ধে শেষ দৃশ্যে হেলেনকে দেখে মেনিলাস যেমনভাবে, ঠিক এত ধকলের পরও সে এমন রূপসী বা অশোক কাননে বন্দিনী সীতা যেমন, অত শোকের ভেতরেও সুন্দরী, যাকগা, বনশ্রীকে তোর চেম্বারের ঠিকানা দিয়েছি। বিকেলে তোর সুপার মার্কেটের পাঁচতলায় যাবে। দ্যাখ, যদি ওর চাকরিটা তোর সুপারিশে হয়!’

সেই বিকেলে সত্যিই বনশ্রী এসেছিল। বাহাত্তর সালের পর আর ২০১৫ সালে; ঠিক তেতাল্লিশ বছর পর বনশ্রী যেন এক জন্মান্তরের দেখা করতেই জগদীশের চেম্বারে ঢুকেছিল। সাথে আলী কিবরিয়ার লিখে দেওয়া স্লিপ ছিল বলেই হয়তো তাকে জগদীশের চেম্বারের দরজা পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয়েছিল। কাঁচের পার্টিশনের ওপার থেকে সে ইতঃস্তত মুখে দাঁড়িয়েছিল।
‘আসব স্যার?’
‘আসো-আসেন-আসো!’ সম্বোধন কেমন গুলিয়ে যায় জগদীশের। কলেজের জুনিয়র যার সঙ্গে প্রেম হতে পারতো বা হয়নি, পরনারী আবার আজ এই পরনারী শ্রেণিগত অবস্থানে এতটাই চ্যূত যে তাকে যেন অনায়াসে ‘তুমি’ ডাকা যায়!
‘বসো-বসেন-বসো!’ সম্বোধন গুলিয়ে যায় এবং রড লাইটের আলোয় সামনে বসা বনশ্রীকে দেখে জগদীশের মনে হয় কিবরিয়া কিছুই ভুল বলেনি। কত দিনের পুরনো একটি ত্যানাত্যানা শাড়ি পরনে। চুল পেকেছে। মুখে ও হাতে ত্বক বলীরেখার জানান দিচ্ছে জোরেশোরেই। গনগনে স্বর্ণচাঁপা রং এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রবল। মুখে কুণ্ঠিত হলেও একটি সহজ, স্বচ্ছ হাসি যেন সে এক অনন্ত নরক জীবন পার করে আসেনি! যেন এই তো, এই সেদিন কলেজে তার সঙ্গে জগদীশের দেখা হয়েছিল।
‘কী-কী খবর, বনশ্রী?’
‘আমার আর কী খবর, স্যার? সবই তো জানেন!’
‘এতদিন মানে কোথায়?’
‘ভাগ্যে যা ছিল। বস্তিতে ছিলাম অনেক বছর। ধাইগিরি করছি। পরের বাসায় কাজ। কিছুদিন হয় বাবা-মাকে স্বপ্ন দেখছিলাম। বলছে মরার আগে জন্ম শহরেই যেন থাকি! তাই আসলাম! এছাড়া এখন বুড়া হইয়া গিছি তো। এখন আর কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবে না, জানতেও চাবে না।’
‘তোমার, ইয়ে মানে হাজব্যান্ডের সঙ্গে তো যোগাযোগ নেই আর?’
‘না, আমার এক কাকাতো বোনের দেবর কলকাতায় থাকে। সে কীভাবে কীভাবে জানছে যে আমার তিনটা বাচ্চাই সতীনের ঘরে বেদম কষ্ট পাইয়া বড় হইছে। মেয়েটা মইরা গেছে টাইফয়েডে- ক্লাস সেভেনে থাকতে। এক ছেলে বাসের কন্ডাক্টরি করে। আর এক ছেলে ফুটপাথে ফলের ব্যবসা। দুইজনেই নাকি বিয়া করছে, ছেলে-মেয়েও হইছে। নাতি-নাতনীগুলারে দেখতে পারতাম! কিন্তু অত ভাগ্য কইরা আসি নাই জীবনে!’ বলতে বলতে বনশ্রীর মুখে একটি স্মিত, প্রসন্ন হাসি দেখা দেয়।
‘আত্মীয়-স্বজন কারো সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই?’
‘ঐ এক কাকাতো বোন ঢাকায় থাকে। তার জামাই গার্মেন্টসে কাজ করে। একবার মীরপুর বেনারসী পল্লীর সামনে দেখা হইছিল। সে চিনছিল। কিছুদিন সেই কাকাতো দিদির বাসাতেও ছিলাম। সেখানেও কাজ করছি। তয় আত্মীয়র বাড়িতে কাজ করা খুব কষ্ট। আর আমি যুদ্ধে...’ বনশ্রী এখানে এসে সামান্য মাথা নিচু করে পরক্ষণেই সহজ হয়ে বলেছিল, ‘আমি যুদ্ধে জাতি-ধর্ম, নারী হিসেবে ইজ্জত সব খোয়াইছি। কেউই আমারে ঘরে বেশিদিন রাখতে চায় না। এখন তাই একটা চাকরি হলে বাঁচতাম! একটা সুইপারের চাকরিও যদি পাইতাম!’
‘মুক্তিযোদ্ধা, মানে বীরাঙ্গনা কার্ড আছে তোমার?’
‘সেটা আছে একটা।’
‘ভাতা পাও?’
‘পাই। তয় খুব বেশি টাকা তো না।’
‘এই বয়সে এত কষ্টের চাকরি করতে পারবে? তাতে তোমরা ব্রাহ্মণ! ব্রাহ্মণ হয়ে সুইপারের কাজ করতে পারবে?’
‘কষ্ট আর কি? আর মেয়েমানুষের ব্রাহ্মণ কি আর শূদ্রই বা কি? বাপের ঘর বলেন আর স্বামীর ঘর বলেন, সেই তো থালা-বাসন মাজা, কাপড় কাচা, ঘর-দুয়ার-বাথরুম পরিষ্কার এইই তো জীবন!’
‘মার্কেটে বারো জাতের মানুষ, তাদের ময়লা; শুধু ঘর বা সিঁড়ি ঝাড়া-মোছার কাজ তো না! টয়লেটও পরিষ্কার করতে হবে মাঝে মাঝে- পারবে?’
‘স্যার যে কি কন! আমার সেই জাত, কবে ব্রাহ্মণের ঘরের মেয়ে ছিলাম কিনা- সব তো গেছে! যুদ্ধে কি আর আমার কিছু থাকছে? এছাড়া মেয়ে মানুষের জীবন তো জন্ম মেথরের জীবন। আমার শাশুড়ি আমারে দিয়া আমার পাগল শ্বশুরের পায়খানা, প্রস্রাব সব পরিষ্কার করাইছে না? বিয়ার পরপর!’
তাও করিয়েছে নাকি? এটা তো জানত না জগদীশ!
‘ঠিক আছে, দেখছি মার্কেট মালিকের সাথে বলে কিছু করা যায় কিনা।’

না। বনশ্রীকে স্যারের বদলে ‘দাদা’ ডাকতে বলার অনুরোধও করা যায়নি। এতটা নাটক এই বুড়ো বয়সে কি করা যায় আর? কেমন বিশ্রী লাগে না?
মার্কেট মালিক খান তৌসিফ রিফাত আসলাম যার বাবা আলহাজ্ব লতিফ আলী আকন্দ যুদ্ধাপরাধের বিচারে আপাতত কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকলেও তৌসিফ রিফাত তিন বছর হয় সরকারি দলে যোগ দিয়েছেন, তাকে অনুরোধ করে জগদীশ সত্যিই বনশ্রীকে সুইপারের চাকরি পেতে সাহায্য করেছে। হাতে মার্কেটের সুইপার হিসেবে আইডি কার্ড নিয়ে হাসি মুখে, দেড়শো টাকা দামের মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসেছিল বনশ্রী তাঁর চেম্বারে। শাড়ির বদলে গায়ে ম্যাক্সি, মাথায় ওড়না।
‘একি! এই পোশাক?’
‘মালিকে ডাকছিল। বললো, খালা এই মার্কেটের টয়লেটে অনেক মুসল্লী মানুষ আসে। তাই পর্দা করতে হবে। মাথায় ওড়না দিতে হবে। শাড়ির বদলে ম্যাক্সি নয় সালোয়ার-কামিজ ভালো পোশাক।’

আর কিছু বলার ছিল না, বা বলার থাকে না জগদীশের। তারপর এই পাঁচ বছরে... এক সুপার মার্কেটে কর্মক্ষেত্র হলেও খুব বেশি বনশ্রীর সঙ্গে দেখা হয়নি জগদীশের। হয় না দেখা। ভদ্রলোক ও সুইপারের ভুবন তো দুই ভিন্ন ভুবন। ব্রহ্মার মস্তক থেকে যে ব্রাহ্মণের জন্ম হয়, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়, উরু থেকে বৈশ্যের এবং পদদ্বয় থেকে যে শূদ্রের জন্ম হয় যার কাজ শুধু তিন বর্ণের সেবা করা- সুইপার চতুবর্ণাশ্রমের ভেতর পড়ে কি? নাকি অস্পৃশ্য? জন্ম মাত্রই যার দেহ চারপাশের সবকিছু অস্পৃশ্য করে? বনশ্রী আচার্য- পলিটিক্যালি কারেক্ট হতে গেলে বনশ্রীর জন্য তাঁর দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই বা দুঃখ পেতে নেই। তবু বনশ্রী হায়!

আজ লিফট থেকে নামতে নামতেই বনশ্রী নামলো তিনতলায়। হয়তো সিঁড়ি ঝাড়ু দিতে হবে, ময়লা সাফ করতে হবে পাঁচতলা এই মার্কেটের প্রতিটা করিডোরে, অসংখ্য পুরুষের থকথকে মল-মূত্রে আকীর্ণ টয়লেটের প্যান পরিষ্কার করতে হবে...আর ভাবতে ইচ্ছা হচ্ছে না জগদীশের। প্রতিদিন ভাবা হয়ও না। তাঁর ঘরে ওকালতির পয়সায় নিজের রুমে ও দুই ছেলের বেডরুমেই আলাদা আলাদা তিনটা কালার টিভি, তাঁর ঘরে এসি, পাঁচ বেলা হরেক সুখাদ্য, একটি সাদা ছিমছাম প্রাডো গাড়ি, উমার হাতে রিমোটে ‘স্টার জলসা’ বা ‘জি বাংলা’র কত অনুষ্ঠান! উমা কালো কি মোটা, সুন্দর কি অসুন্দর এসব নিয়ে যৌবনে ভাবেননি তিনি। ছেলেদের বয়স যত কম থাকে, বিয়ের বাজারে বার্গেনিং পাওয়ার তত কম থাকে। কোনো মেয়ে নিজে থেকে এলেই ধন্য হয়ে যায়। আর বয়স বাড়তে থাকলে বার্গেনিং পাওয়ার বাড়তে থাকে। মেয়েদের উল্টো। বয়স যত কম, তত বার্গেনিং পাওয়ার বেশি। বয়স বাড়ছে তো বার্গেনিং পাওয়ার কমছে। কাজেই উমা মোটা কি কালো, সুন্দর কি অসুন্দর এমন বিশ্রি নানা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট কথা তিনি ভাবতেই চাননি। যৌবনের শুরুতে বরং খুব সুখীই হয়েছিলেন। অধরা বনশ্রীকে না পাওয়ার দুঃখ ভুলেছিলেন। তবে জীবনের কাছে এত অদ্ভুত মার খাওয়া, এতটাই পরাজিত ও নিঃসহায়, নিঃসম্বল বনশ্রীকে নিয়ে এখনো যখন প্রতিদ্বন্দ্বীর আক্রোশে উমা কটু সব মন্তব্য করে, তখন স্ত্রীকে বাস্তবিক তার ভয়ানক কুচ্ছিত মনে হয়।

 

আত্মীয়র বাড়িতে কাজ করা খুব কষ্ট। আর আমি যুদ্ধে...’ বনশ্রী এখানে এসে সামান্য মাথা নিচু করে পরক্ষণেই সহজ হয়ে বলেছিল, ‘আমি যুদ্ধে জাতি-ধর্ম, নারী হিসেবে ইজ্জত সব খোয়াইছি। কেউই আমারে ঘরে বেশিদিন রাখতে চায় না। এখন তাই একটা চাকরি হলে বাঁচতাম! একটা সুইপারের চাকরিও যদি পাইতাম!’

 

লিফট বেয়ে পাঁচতলা উঠতে উঠতে বনশ্রী আবার জগদীশের মাথা থেকে হারিয়ে গেল। যেমন হারিয়ে যায় রোজ। অথবা জীবনের এতটাই শেষ মুহূর্তে এই আবার দেখা বা এক ছাদের নিচে কাজ যখন নর-নারী দু’জনেরই শরীর শেষ বা শুকিয়ে গিয়েছে, তখন নতুন করে কাউকে কিছু পাবার নেই। পাবার চেষ্টাও যেন আর করা যায় না শুধু এক গভীর বিষাদ বোধ করা ছাড়া। এই তো পাঁচ তলায় উঠতে না উঠতে তিনি দেখলেন তাঁর চেম্বারের সামনে ক্লায়েন্ট পার্টি এসে হাজির। চটপটে, সুন্দরী সেক্রেটারি মেয়েটা ‘গুড মর্নিং, স্যার’ বলে অভ্যর্থনা জানালো। তারানা তারান্নুম নামের এই বাইশ বছরের মেয়েটির ঝলমলে চুল আর হলদে সালোয়ার-কামিজ তার পাঁচতলার চেম্বার রুমের জানালার কাঁচে জমে ওঠা শাদা কুয়াশার কনকনে হিম কাটিয়ে চাঙ্গা করে তুলছে মামলার ভারে বিপর্যস্ত পরিবারগুলো থেকে আসা সব ক্লায়েন্টকে, তরুণ তিন সহকারীকে অথবা গোটা পরিবেশকেই। যৌবন এমনটাই। রূপও এমন অমোঘ ও অবিনশ্বর। তুমি বুড়ো হয়েও লম্পট নাই হতে পারো। কিন্তু তারুণ্যের প্রাণচঞ্চলতা আশপাশের সবাইকে খুশি করে তুলবেই। এটাই নিয়ম। পঁচাত্তরের জগদীশ বুঝলেন খুব ভালো এক কাপ কফির মতো তারানা তারান্নুম তথা এলএলবি, তৃতীয় বর্ষ ও তার হলদে সালোয়ার-কামিজ, তার গায়ের বডি স্প্রে ও বাস্তবিক তার হাতে করে আনা এক কাপ কফি তাঁকে সব ভোলালো। উমার রাজরানী জীবন, বনশ্রীর মেথরনী জীবন, ১৯৭১ ইত্যাদি ইত্যাদি সব ভুলে দারুণভাবে তিনি পরবর্তী তিন ঘণ্টার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেন ইসমাইলীয়া পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে শরিকানার বিবাদে। প্রায় তিন ঘণ্টা কাগজপত্রের ভেতর যুবকের উদ্যমে নিবিষ্ট থাকার পর টয়লেট পেল তাঁর, আর সুপার মার্কেটের পাঁচ তলার ডানে পুরুষদের টয়লেটে ঢোকার দরোজায় দেখলেন মার্কেট মালিকের ছোট নাতি বনশ্রীকে বকছে, ‘কি করেন খালা? কমোডের প্যানে ময়লা থাকে অনেক সময়। ভালোভাবে পরিষ্কার করবেন। জোরে জোরে ডলবেন, বুঝলেন? গায়ে শক্তি নাই?’
বনশ্রী অসহায় একটা হাসি মুখে আটকে বলছে, ‘বুড়া হইছি তো বাপ। আইচ্ছা আবার ঘষুম নে।’

কেমন স্তব্ধ হয়ে টয়লেটে না ঢুকেই আবার চেম্বার রুমের দিকে ফিরে যান জগদীশ। গোটা শহরটা আজ কুয়াশায় থম মেরে আছে। সেই হিম কিছুতেই কাটছে না। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন জগদীশ। দুপুর পৌনে একটা। এখনো রোদ ওঠেনি। বরং তাঁর চেম্বার রুমের জানালার শার্সিতে ছড়িয়ে পড়ছে কুয়াশার শাদা শাদা থোকা থোকা ফুল আর বাইশের এলএলবি, তৃতীয় বর্ষ তারানা তারান্নুমের ঝলমলে পিঠ ছাপানো চুল, হলদে সালোয়ার-কামিজ ও বডি স্প্রে ও সেই কুয়াশার ফুল কাটিয়ে রোদ আনতে পারছে না। কিছুতেই পারছে না।
প্রতিটি সুতো ছিঁড়ে গ্যাছে আর ঘুড়িও বিচিত্র অঙ্গদ!

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়