ঢাকা     শনিবার   ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২১ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় প্রেম ও নারী

আনোয়ার মল্লিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫১, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫  
সিকদার আমিনুল হকের কবিতায় প্রেম ও নারী

সিকদার আমিনুল হককে শনাক্ত করা হয় ষাট দশকের কবি হিসেবে। এই দশকে বাংলাসাহিত্যে বেশ কয়েকজন মেধাবী কবির আবির্ভাব হয়েছে। যেমন আব্দুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ, মহাদেব সাহা প্রমুখ। এদের মধ্যে আব্দুল মান্নান সৈয়দ বাদে অন্য সবাই তুমুল পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। সিকদার আমিনুল হক ষাটের গুরুত্বপূর্ণ একজন কবি। শুধু ষাট বললে ভুল হবে; আধুনিক বাংলা কবিতা-আকাশেরই এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তিনি।

কিন্তু কবি হিসেবে তাঁর যে অনন্যতা আমরা লক্ষ্য করি, সেই তুলনায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা, চর্চা বেশি হয়নি। এমনকি পাঠকপ্রিয়তায়ও তিনি পিছিয়ে। পাঠক খামতির একটা কারণ হয়তো দাঁড় করানো সম্ভব, যেমনটা  কবি-প্রাবন্ধিক মিনার মনসুর বলেছিলেন, ‘‘সিকদার আমিনুল হকের কবিতা পাঠের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন আছে। কেউ যদি মনে করেন এ-কালের সস্তা উপন্যাসের মতো এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলবেন কিংবা একবার পড়েই সব বুঝে ফেলবেন তাহলে তাকে নিশ্চিতভাবে হতাশ হতে হবে।’’
[ভূমিকা, সিকদার আমিনুল হক রচনা সমগ্র-১]

পাঠকপ্রিয়তার ব্যাপার দূরে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, আমাদের বিশেষজ্ঞ-সমালোচকেরাও তাঁর প্রতি কাঙ্ক্ষিত মনোযোগ দেননি।

সিকদার আমিনুল হক প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন; ছিলেন পরিশীলিত রুচির মানুষ। প্রচারবিমুখ, শুদ্ধাচারী এই কবির কবিতাও ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের মতো বিশুদ্ধ এবং অন্তর্মুখী। ষাটের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক ডামাডোল, তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবেই তা থেকে নিজেকে আড়ালে রাখেন। গতানুগতিক কোনো কিছুতে গা ভাসাননি। বিশুদ্ধ মনন এবং অনন্য কাব্যভাষা তাঁর কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য দান করেছে। রোমান্টিকতা ও মৃত্যু চিন্তা তাঁর কবিতার প্রধান অন্বিষ্ট দুটি বিষয়। এ ছাড়া তাঁর যে রোমান্টিকতা, সেখানে প্রেম ও নারীই প্রধান অনুষঙ্গ। এবং যে প্রেমের বন্দনা তিনি করেছেন তা নিষ্কাম প্লেটোনিক প্রেম নয়, রক্ত মাংসের দেহজ প্রেম। এ ছাড়া নগর চেতনা, বিচ্ছিন্নতা, গ্রামীণ ও লোকজ উপাদান, নিসর্গ তাঁর কবিতায় ঘুরেফিরে আসে।

সিকদার আমিনুল হক পুরোদস্তুর রোমান্টিক কবি। তাঁর এই রোমান্টিকতার কেন্দ্রে ছিল নারী। এবং যেসব নারীর কথা তিনি কবিতায় তুলে এনেছেন সেসব নারী ছিলেন খুবই আকর্ষণীয়া। অপরূপ তাদের দেহবল্লরী। প্রকৃতির বিভিন্ন উপাচার যেমন, ধু-ধু মাঠ, খরোস্রতা নদীর দুই তীর, পাহাড় এবং নদীর উপমায় নারীর শরীর তিনি চিত্রিত করেছেন। এসব পেলব, কমনীয় নারী-শরীরের আকস্মিক ঘ্রাণে কবি উন্মাতাল। 

তিনি বলেন: 
‘‘তোমাকে পাই রোদ্দুরে। সিঁড়ি ছুঁয়ে ফ্ল্যাটের নিবিড়
চলন্ত প্রবাসী মূর্তি; যেন দোকানের কাচে ঢাকা
শান্ত মাছ, তোমাকে প্রত্যহ চাই ঘ্রাণে আকস্মিক,
হঠাৎ দরজা খুলে, অবিন্যস্ত বিপুল শরীর।
লগ্নতা জাগে চিবুকে: পেশল পিঠের ধু-ধু মাঠ
মসৃণ শাদা পাথর-সিমেট্রির, পেলব কোমর-
পাহাড় জায়গায় স্থৈর্য, নিচু দেহ, কখনো নদীর
খরস্রোতা দুই তীর, মাঝে-মাঝে বিষণ্ন শীতল।’’
[পরস্ত্রীর সিঁড়িতে, তিন পাপড়ির ফুল]

সিকদার আমিনুল হকের প্রেমের অনুভব একেবারেই শরীরকেন্দ্রিক এবং ইন্দ্রিয়ঘন। প্রেম ঘিরে কবি যতই বুদ্ধিবৃত্তিক এবং দার্শনিক মীমাংসায় উপনীত হতে চান না কেন শেষ পর্যন্ত প্রেমিকার শরীরই তাঁর কাছে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি মৃত্যুর অনিবার্য সত্য জেনেও তিনি নারীর প্রেম এবং শরীর ভুলতে পারেন না।

‘‘একটি মেয়ের হাত, নিতম্বের তপ্ত অবক্ষয়
ঢেলে দিলো জলের জিহ্বায়-
আর আমি চুম্বনের ঘ্রাণ
মৃত্যুময় মেয়েটির ঠোঁটে।
এসব পার্থিব নয়:
ফিরে গেলো, বহু গ্রীবা, জঙ্ঘা, নাভি, স্তন-
গুচ্ছ-গুচ্ছ আহত লবণ।
[শারীরিক অতিথি, তিন পাপড়ির ফুল]

নারী আসে কবির জীবনে সঞ্জিবনীর প্রাণশক্তি নিয়ে। রাত আর দিনের প্রতিটি প্রহরে, রৌদ্রের শুষ্কতায়, মেঘের শীতলতার মতো নারীকে চান তিনি। এই চাওয়া অপ্রতিরোধ্য। শরীরের কোষে কোষে নিষিদ্ধ নেশার মতো নারীর জন্য তীব্র ব্যাকুলতা। এই আকাঙ্ক্ষা, এই কামনা জীবনকে তাড়িত করে, ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়। নারীর জন্য এই রিরংসা, এই দহন, এই সর্বগ্রাসী কামনার প্রকাশ দেখি যখন কবি বলেন:

‘‘তোমাকে আমার চাই অকপট প্রহরে-প্রহরে,
চাই খাঁ খাঁ দিনে তুমি একমাত্র মেঘ হয়ে আসো
রুক্ষ-শুষ্ক স্তব্ধতায়; তুমি আসো নর্তকীর মতো
বিশাল উৎসুক মঞ্চে নাটকের অসুখ বাঁচাতে।
চাই, আমি বলি চাই; যেভাবে বৃদ্ধেরা ফিরে চায়
রতির ক্ষমতা, আর জাহাজের খালাসি মাটির
সিকি চিহ্ন নীলিমার সরু পাড়ে, সেই মতো  চাই।’’
[এক প্রেমিকের স্বপ্ন, শ্রেষ্ঠ কবিতা]

নারীর যৌবনই পুরুষের একমাত্র আরাধ্য। এই যৌবনের টানে পতঙ্গের মতো পুরুষ নারীর কাছে ছুটে আসে। যৌবন নারীর জীবনে প্রেম আনে। অতিক্রান্ত যৌবনে প্রেম মরে যায়। বসন্তের মাতাল আবাহন নারীর শরীর পুনরায় জাগিয়ে তোলে। শরীরের বাঁকে বাঁকে প্রেম দোলা দিয়ে যায়। যৌবন চলে গেলে বিষাদে ছেয়ে যায় জীবন। এই সত্যই উঠে এসেছে ‘সতত ডানার মানুষ’ কবিতায় নিপুণশৈলীতে:

‘‘সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না; কেউ কেউ ফেলে। আর যারা অপেক্ষা করে, তারা শীতের সবুজ পতঙ্গের মত। অনেকে চাঁদ আর ঝুল বারান্দার নিচে পরাধীন! অনিশ্চিত তাদের টলমলে সুঠাম পা; বালিকা বয়স থেকেই নিদ্রিত স্তন হয়ে ওঠে ওদের নৈরাশ্য এবং সম্পদের ভার! তারা বাঁচে বসন্ত আর প্রেমের কয়েকটা দিন।.. বাতাস আর পাতাও যখন তাদের ইশারায় কাঁদায়, সেই সরল কয়েকটা দিনই ওদের নির্ভুল আয়ু।’’
[সতত ডানার মানুষ]

নারী- প্রেমে কামই কবির আরাধ্য। কাম ছাড়া প্রেম মূল্যহীন। যুগে যুগে নারী-পুরুষের কামের সঙ্গী হয়েছে। নারীর এই কামকলাই মানব প্রজাতিকে রক্ষা করেছে, এগিয়ে নিয়েছে। কবির মনোজগতে যে নারীর বসবাস, সেই নারী তার কাম-সঙ্গী, কবির আনন্দ-বেদনার সহচর। কাঙ্খিত নারীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে কবি বাধা পড়ে আছেন। এই বন্ধন ছিন্ন হলে কবির সুস্থতা হারিয়ে যায়। কবির বেঁচে থাকা হয়ে পড়ে অর্থহীন। কবি বলেন:
‘‘আকাঙ্খিত নারীর ওষ্ঠ থেকে যখন আমার রসসিক্ত জিভ সরিয়ে নিচ্ছি, তখন পৃথিবীর কোন দুরারোগ্য রোগীর মুখ থেকে এই মাত্র নার্স বিবেকহীন প্রশান্তিতে সরিয়ে নিলো ওষুধের দাগে বিবর্ণ জরুরি  গ্লাসটিভ’’
[সতত ডানার মানুষ]

কবি তাঁর দয়িতাকে সর্বক্ষণ তাঁর কাছে চান। জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গে, কর্ম কোলাহলে, ঘুমে জাগরণে তাকে কামনা করেন। অফিসে গিয়ে কাজ শেষের লাঞ্চে অথবা রিকশায় করে বাড়িতে ফেরার মুহূর্তে শুধু তার কথাই মনে পড়ে। কর্মচারীরা যখন বেতন বাড়াতে সচিবালয়ের গেটে এসে স্লোগান দেন, কবির ইচ্ছা হয় সেই শ্লোগানে তিনি তাঁর  প্রেমিকাকে কামনা করেন। এমনকি গলির মোড়ের সেলুনে বসেও তিনি তাঁর প্রিয় নারীকেই অনুভব করেন। কবির এই ভাবনার বহিঃপ্রকাশ দেখি নিম্নোক্ত চরণে:  
‘‘তোমাকে আমার চাই, এই কথা ভুলি না কখনো!
আপিসের দায় সেরে যখন রিকশায় বাড়ি ফিরি,
লাঞ্চে রেস্তোরাঁয় গিয়ে এই মন্ত্র জপি মনে মনে।
তোমাকে আমার চাই। যে শ্লোগান বেতন বাড়াতে
সচিবালায়ের গেটে আসে, তার সাথে ভিড়ে গিয়ে বলি
তোমাকে আমার চাই। সকালে গলির মোড়ে গিয়ে
সেলুনের সাদা ফেনা গালের কৌতুকে বসে গেলে
তখনও নিশ্চিন্তে বলি, তোমাকে আমার চাই!’’
[এক প্রেমিকের স্বপ্ন, পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা] 

যে নারীকে উন্মাদের মতো জীবনের যাবতীয় অনুষঙ্গে কবি কামনা করেন, সেই নারীর বিচ্ছেদে তিনি কাতর। যে কোনো মূল্যে তাকে কাছে পেতে চান। সেই আর্তি নিয়েই কবি বিনীতভাবে তাঁর প্রেয়সীর কাছে নিবেদন করছেন, সে যেন তাঁর কাছে ফিরে  আসে। প্রেমিকাকে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে তার জন্য তিনি শরীরের রক্ত ঢেলে দিতে প্রস্তুত। তার রূপচর্চার জন্য তিনি আয়না দিয়েছেন তাকে। শিল্পীকে দিয়ে তার ভাস্কর্য নির্মাণ করিয়েছেন। এমনকি চিত্রকর তাঁর ছবি অঙ্কন করেছেন। তারপরও কেন সে আসবে না তাঁর জীবনে- কবি বিনয় সহকারে সে কথাই জানতে চেয়েছেন।  
‘‘কেন আসবে না?- আমি কী দেইনি কবিতার রক্ত
নিঃসঙ্গ তোমাকে? আর মায়াবী আয়না, মুগ্ধ চোখে 
নিজেকে দেখার সুখ! তোমার শরীর ভাস্করের
অন্তহীন মনোযোগ? ড্রইং শেষে ক্যানভাসে রং?’’
[তুমি আসবে না তাই, পারাবত, এই প্রাচীরের শেষ কবিতা]

কবি তাঁর একান্ত নারীর জন্য প্রবল স্মৃতিকাতর। মধ্য- ডিসেম্বরের কোনো এক সময়ে তিনি তাঁর প্রিয় ব্রুকবন্ড চা পান করছিলেন। সেই চায়ের ঘ্রাণ ছিল মনোরম। কিন্তু কবির  প্রেয়সীর গায়ের গন্ধের কাছে প্রিয় চায়ের এই ঘ্রাণও ম্লান হয়ে যায়। কবি চা পান করতে করতে তাঁর পুরনো প্রেমিকার কথা স্মরণ করেন।

‘‘বারান্দায় বসে আছি মধ্য- ডিসেম্বরে। এইমাত্র
ব্রুকবন্ড চার গন্ধ ঢেকে দিলো বহু কাল আগে
তোমার সুঠাম গন্ধ!... তারপর কত দিন গেল;
তোমার মতন নেই ভালোবাসা, বিরল উৎসাহ
নারীদের স্বচ্ছ চোখে। পুরনো চাদর বেশি মিহি’’
[পাখি ও পাপিয়া, লোরকাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেল]

প্রেম সবসময়ই কবিদের আরাধ্য বিষয়। সিকদার আমিনুল হকের ক্ষেত্রেও যদি লক্ষ করি, একক বিষয় হিসেবে প্রেম তাঁকে কাছে টেনেছে সবচেয়ে বেশি। প্রেমের কবিতাগুলোতে তিনি অত্যন্ত সপ্রতিভ। এ ছাড়া প্রেমের কবিতায় তিনি অনুকরণীয় শিল্প কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন।

ঢাকা/তারা//

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়