ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোটগল্প || বৃদ্ধাশ্রম হয়ে ওঠা কফি হাউসটি

অলাত এহ্সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৫, ৫ জুলাই ২০২১  
ছোটগল্প || বৃদ্ধাশ্রম হয়ে ওঠা কফি হাউসটি

অলঙ্করণ: অপূর্ব খন্দকার

মাত্র সাত দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলাম প্রায়। ঘরের লেজার লাইট, কম্পিউটার মনিটর, ফোনের স্ক্রিন আর ক্ষুদ্র ভেন্টিলেটর দিয়ে আসা আলো ছাড়া কিছু চোখে পড়েনি। একটু দম ছাড়ার জন্য হলেও চারপাশ ঘুরে দেখা দরকার। ধানমন্ডি তত দিনে সুপার নোভার মতো আত্মসংকোচন ঘটিয়ে শহরের ক্ষুদ্র, কিন্তু ওজনদার এলাকায় পরিণত হয়েছে।

কাঁটাসুর থেকে কয়েকটা বাঁক পেরোলেই ধানমণ্ডি মেইন রোড। রাজধানীর এই অংশকে বলা যায় রেস্টুরেন্টের শহর। এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত রেস্টুরেন্ট। সব প্রায় অভিজাত, না হলেও যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কোনো কোনো ভবনে এর সংখ্যা দশটারও বেশি। ফাঁকে ফাঁকে ছোট-বড় বার। এক সময় নতুন ঢাকার এখন প্রায় পরিত্যক্ত নগরী, তবে সংরক্ষিত। অর্থ-কড়ি হওয়ায় পুরোনো বাসিন্দারা বাড়িঘর ভাড়া দিয়ে চলে গেছে শহরের বিকাশমান উত্তর দিকে, অনেকটা আদিম অভিবাসীদের মতো দল বেঁধে। জনমানব কম। পরিবহন বলতে ট্যাক্সি আর রিকশা। সমুদ্র সৈকতের কিছু অদ্ভুত ও শৌখিন মোটর যান দেখা যায় রাস্তায়, সচরাচর হলেও বিদেশ থেকেই আমদানি করা। এই ফাঁকে আখড়া গেড়েছে সব মাদক কারবারি আর অপরাধীরা। বড় জুয়ারিদের ভিড়ও এখানে। মাঝেমধ্যে ঘটে মারাত্মক সব ঘটনা! হত্যা থেকে শুরু করে প্রকাশ্য গোলাগুলি।

তহিদুল পইপই করে বলে রেখেছে, যেন একা বের না হই। খুব বেশি হলে পাশের দোকান থেকে সিগারেট কেনা যেতে পারে। তাও কখনো সন্ধ্যার পরে নয়। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত শহরে নির্জীব সন্ধ্যাগুলোই সবচেয়ে উপভোগ্য হয়। রোড ডিভাইডারের গাছগুলো তখন বাতাসে ডাল নামিয়ে মাথা দোলানোর সুযোগ পায়। গায়ে একটা জামা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আশপাশে কফি শপের সন্ধানে, একেবারে শিস দিয়ে।
পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার আগেই উত্তরের চাপে পরে ছিল এলাকাটা। তাই ঘরবাড়িও সব আধুনিক হয়ে ওঠেনি। অনেক বাড়ির প্রায় শতবর্ষ পুরোনো নকশা। পরিত্যক্ত হওয়ার ক্ষতিপূরণ হিসেবে এগুলো এখন একটা প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য অর্জন করেছে। ঈদের সময় এই এলাকার ভাড়াটিয়ারা যখন বাড়ি ফিরে যান, তখন পুরোনো বাসিন্দারা ফিরে আসেন সাবেকি দরদ নিয়ে। তখন এলাকাটা পুরোনো সংস্কৃতি ফিরে পায়।

আমি পেরিয়ে যাচ্ছিলাম বেসরকারি হাসপাতাল, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, বিপণি কেন্দ্রগুলো। শুধু বিকেলে খুলে এমন ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান খোলা ছিল সেখানে। এলাকাভিত্তিক সাপ্তাহিক ছুটির দিন হিসেবে বিপণিগুলো বন্ধ। সন্ধ্যার অন্ধকারে রেস্টুরেন্টের বাহারি সাইনবোর্ডগুলো জ্বলজ্বল করছিল, কিন্তু একই মুদ্রায় বারবার। দুই-দশটা রেস্টুরেন্টর সাইনবোর্ড দেখে একটা কফি হাউস খুঁজে পেলাম। বড় একটা বিপণির পাশের গলি দিয়ে একটু ভেতরে। একটা পুরোনো বাড়ির নিচতলায় কফি হাউসটা। রাস্তার বাতি আর কফি হাউসের সাইনবোর্ডে দূরত্বটুকু আলোহীন, তবে অন্ধকার নয়। শান্ত অনুভূতির ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেলাম। গেটের দিকে সাইনবোর্ডে কাঠখোদাই করে লেখা ‘নেক হেড বার’। পাশে ছোট্ট সাইনবোর্ডে মরিচা বাতি দিয়ে লেখা: কফি হাউস। রাস্তার পাড়ে এটুকু লেখা ছিল। তা হোক, কফি পাওয়ার আনন্দে ভেতরে ঢুকে পড়লাম।
প্রবেশ মুখের টেবিলগুলো কাস্টমার ভর্তি, কিন্তু উত্তরে কয়েকটা টেবিল একেবারে ফাঁকা। দূরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন হৃষ্টপুষ্ট লোক— বার ব্যবসায় যাকে বলে বাউন্সার— ভেতরে কোনো গন্ডগোল হলে কাস্টমার শায়েস্তা করার জন্য। হরহর শব্দে একটা চেয়ার টেনে ওয়েটারকে ডাকতেই এগিয়ে এসে মাথা ঝুঁকে বিনয় দেখাল— প্রায় জাপানিজদের মতো। এক কাপ কফি অর্ডার দিতেই অসম্মতি জানাল— শুধু কফি বিক্রি হয় না, সঙ্গে আপনাকে গ্রিল করা মুরগি অর্ডার দিতে হবে।
বেশ জ্বালা তো! তাও ঠিক আছে। শেষ পর্যন্ত একটা কক মুরগির গ্রিল অর্ডার দিলাম রাতে খাবারের ঝক্কি এড়াতে। তারপর টেবিলের ওপর টোকা মেরে আঙুলে শব্দ তুলতে তুলতে লক্ষ্য করছিলাম আশপাশের টেবিলগুলোতে কী চলছে।

হাউসের ভেতর কেউ হাত গুটিয়ে বসে নেই। কেউ কার্ড পেটাচ্ছে, কেউ ‘তিন তাস’ খেলছে। টিভিতে চলছে ওয়ান-ডে ক্লাব ক্রিকেট। স্ক্রিনে চোখ রেখে দর হাঁকছে একদল। সবচেয়ে উল্লাসে আছে বোধ হয় পেগ গ্লাস উল্টো করে তার ভেতর ধাতব মুদ্রা ফেলে খেলায় মত্তরা। কিন্তু টেবিলগুলো খুবই অপরিষ্কার ও পুরোনো, অন্তত ব্যবহারের তুলনায়। হার্ডবোর্ডের টেবিলের বাকল উঠে গেছে কোথাও, তার ভেতর ঢেলে দিচ্ছে তাসের পেটি। হাতলে ময়লা জমেছে, চেয়ারের খাড় ছিঁড়ে নরম তুলা বেড়িয়ে গেছে। মনে হয় কখনোই এই টেবিলগুলো খালি হয় না যে, ওয়েটার একটু মুছে দেয়ার সুযোগ পাবে। এক একটি বুড়ো যেন ঘাসের ডগায় দাঁড়িয়ে থাকা নড়বড় পোকা, ঝড়ের জন্য অপেক্ষা করছে শূন্যে উড়াল দিবে বলে। টেবিলের কাস্টমারগুলো এতটা বয়সী যে— এর ভিন্ন চিন্তা করার সুযোগ ছিল না।

হঠাৎ টেবিল ঘণ্টার শব্দ শুনে সংযত হলাম। ওয়েটারকে এগিয়ে যেতে দেখে তখনই খেয়াল করলাম। যে কোনো প্রথম দর্শন আগ্রহ জাগানিয়া হয়। হাউসের উত্তরের কোণে পরিষ্কার ফাঁকা টেবিলে একজন নারী বসে আছেন। টেবিলে একটাই আসন। তিনি বসে আছেন বাকি টেবিলগুলোর দিকে পেছন ফিরে। দেয়ালের দিকে তার মুখ একটু ওপরে তুললে নাক একটা সাইনবোর্ড নির্দেশ করবে। তার মাথার ওপর লেখা ‘ব্রেক ফাস্ট অ্যাট টিফানি’স’। সঙ্গে বার্ন শেডে আঁকা অড্রে হেপবার্নের আবক্ষ।

আমি বসে ছিলাম ঠিক তাঁর পেছন দিকের একটা টেবিলে। এবার তাঁর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু তিনি এক ধ্যানে মোবাইল স্ক্রিনে কী যেন দেখছিলেন। পাশে আরেকটা মোবাইলে এসএমএস আসছিল। টেবিলে বুমবুম শব্দ করে মোবাইলটা কেঁপে উঠে তা জানান দিচ্ছিল। তারপরই তিনি সেদিকে তাকাচ্ছিলেন। কখনো মোবাইলটা হাতে তুলে উত্তর লিখছিলেন। অনেকটা পরীক্ষার উত্তরপত্র দেখে দেখে কাগজে নাম্বার তোলার মতো। কিছুতেই মোবাইল থেকে চোখ সরাচ্ছিলেন না। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থেকেও তার কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এর মধ্যে একটা গ্রিল আর দুই কাপ কফি সাবাড় করে ফেলেছি। বিল দিতে গিয়ে পড়লাম আরেক ফ্যাকড়ায়।

‘বিলটা একটু সংশোধন করে আনুন, প্লিজ’— আমি বিনয়ের সঙ্গেই বললাম, ‘আপনাদের ভুলে হয়তো দুইটা পেগ লেখা হয়েছে।’ 
‘না, না; ঠিকই আছে স্যার, এখানে দুই পেগের কম কেউ খায় না।’ কাস্টমার তুষ্টির সেই হাসি হেসেই ওয়েটার বলল, ‘আমাদের পাঁচ পেগ, দশ পেগের প্যাকেজ আছে। আর পনেরো পেগের ওপরে গেলে হাফ দাম।’ 
‘পনেরো পেগ!’ ভ্রু তুলে মানিব্যাগের টাকা গুছিয়ে নিতে নিতে বললাম। 
‘হ্যাঁ, পনেরো পেগ স্যার। এর আগে এক বুড়ো নাই নাই করতে করতে পুরো বোতলটা মেরে দিয়েছে। পরে বুঝলাম তার কাছে মোটে আট পেগের দাম দেয়ার পয়সা ছিল, ওই অর্ধেক দামের আশায় পুরো বোতল মেরেছে। তো বুঝুন।’ ওয়েটার হাসি ছড়িয়ে দিলো। 
আমি আর কথা না বাড়িয়ে মানিব্যাগ কাত করলাম। কিন্তু কি দুঃখজনক, গতকাল সন্ধ্যায় সিগারেট কেনার পর রাখা খুচরা টাকা ছাড়া একটা পয়সাও নেই। তহিদুল মাথার কাছে রাখা মানিব্যাগ থেকে টাকাগুলো নিয়ে ব্যাংক নিয়োগ গাইডের কাছে রেখে গেছে। একটা অবিবেচক। আমি তাকে ক্রেডিট কার্ড অফার করলাম। 
‘স্যার, পাঞ্চ মেশিনটা নষ্ট’— আবার অপারগতা প্রকাশ করল ওয়েটার। 
‘তাহলে তো আমাকে বাইরে যেতে হবে, বুথ থেকে টাকা তুলে দিচ্ছি।’ মানিব্যাগ গুটিয়ে নিতে নিতে বললাম। 
‘আপনি খুব ঘোরেল লোক মশাই, দেখতেই পাচ্ছেন এখান থেকে কারও বাইরে যাওয়া সম্ভব না। আপনাকে ছাড়ি আর পস্তাই।’ কাউন্টার থেকে লোকটা এগিয়ে এসে বলল। 
‘আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, আমি ফিরে এসেই দিয়ে যাব।’ প্রায় অনুরোধের মতো শোনাল কথাগুলো। 
‘হে, হে; জবর বলেছেন মশাই’ পরিহাসের হাসি ছড়িয়ে বলল কাউন্টার ম্যান, ‘আপনি এক পেগও মদ খান নাই, আর বলছেন আপনাকে বিশ্বাস করতে, মশাই!’ 
আমাকে এই বলে চূড়ান্ত রকমের উপহাস করা হচ্ছিল যে, আমি এই শহরের নতুন এবং নেক-হেড বার সম্পর্কে কিছুই জানি না। এটা ঠিক, বারটা দেখতে বেশ পুরোনো আর আমি নতুন, বিশেষ করে শহরের এই অংশে। একটা বার সম্পর্কে একজন না-ই জানতে পারে। কিন্তু সবাই আচরণ করছিল চূড়ান্ত রকমের মাতালের মতো, কী করছে তার কিছুই তারা সচেতন নয়। আমার কণ্ঠ একেবারে চড়ে যাওয়ার আগে টুং করে বেজে ওঠা টেবিল ঘণ্টি ঘরে নিস্তব্ধতার অনুরণন তৈরি করছিল। টিফানি টেবিলের ম্যাডাম ডেকেছেন। ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে সেদিকে ছুটে গেল। তারপর তিনি পার্স থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন।
‘লোকটাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিতে পারো, কাল টাকা দিয়ে যাবেন।’— টিফানি নারী বললেন। 
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে, ন্যূনতম পক্ষে নামটা জিজ্ঞেস করতে তার দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যোগী হলাম। অমনি ওয়েটার হাত দিয়ে পথ আগলে দাঁড়াল— ‘উমহুঁ, আজকে যান, কালকে টাকা নিয়ে আসবেন।’ 

অপমানের দহনে তহিদুলকে গালিগালাজ করতে করতে বেরিয়ে এলাম। বুঝতে পারলাম, ও আমার প্রতিশোধ নিতে শুরু করেছে। সাত দিন আগে একেবারে কপর্দকশূন্য অবস্থায় এই শহরে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। হুট করেই চট্টগ্রাম পোর্টের চাকরিটা গেল। পাওনা-দাওনা যা পাবো তাও তিন মাসের ইনভেস্টিগেশন শেষ হওয়ার আগে না। ব্যাপারটা জানাতেই তহিদুল ওর বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছে। খরচ বাবদ চেয়ে নেয়ার বদলে নিজের মনে করে নিয়ে গেছে। 
‘দেখ, ঢাকায় কিছু করতে পারোস কি না। চট্টগ্রাম এবার ছাড়।’ —ও বলে।
আমরা দুজনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সঙ্গে পড়ালেখা শুরু করে ছিলাম। ক্লাস শুরুর দিকেই ও চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হল। এখন আউট সোর্সিং আর টুরিস্ট গাইড হিসেবে বেশ কামাই। আমি পড়ালেখা শেষে চট্টগ্রাম পোর্টে চাপরাশির একটু ওপরের পোস্টে কাজ শুরু করি। 
‘বড় কিছু শুরুর আগে আউট সোর্সিং করতে পারিস’— বাস্তববাদীর মতো উপদেশ দেয় তহিদুল। 

ঢাকা আসার পর তহিদুল অনলাইনে কয়েকটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিল। গ্রাফিকসের কিছু কাজ সেখানে নমুনা আকারে দেয়া। কী কী সব ভিউ বাজারে অ্যাকাউন্ট লিংক জমা দিতে হয়। বায়ারেরা সেখান থেকেই ওয়ার্কার চয়েজ করে নেয়। পায়ে হেঁটে অফিসে অফিসে সিভি জমা দেয়ার বদলে অনলাইনে দেয়া আর–কি। একেবারে ভাসমান কাজ। শ্রমিক আন্দোলন নেই যে, কর্তা হয়ে তাতে সমর্থন দেয়ার অজুহাতে চাকরিটাও যাবে না। আন্দোলন এড়াতে ইদানীং অফিসগুলো সবার পদে ‘অফিসার’ যোগ করে দেয়া হয়েছে। অফিস গার্ড থেকে পিয়ন পর্যন্ত আনা হচ্ছে সিকিউরিটি সার্ভিস কোম্পানি থেকে। প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে সিবিএ সংগঠনগুলো। আমাকে পেয়ে তহিদুল একেবারে উদ্বাহু হয়ে উঠল। সারা দিন এসএমএস, মেইলিং আর ফেসবুকিং নিয়ে আছে। আমাকেই ওর কাজগুলো করে দিতে হচ্ছে। টানা কয়েক দিন ল্যাপটপ-মোবাইলে ডুবে থাকার পর ও হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। ফিরবে তিন-চার দিন পর।

পরের সন্ধ্যায় আবার বেরিয়ে পড়লাম টাকা পরিশোধ করতে। যাওয়ার পথেই বুথ থেকে টাকা তুলে নিলাম। এই পাড়াটা অন্তত ভালো, কখনো বুথে টাকার অভাব হয় না। শুনেছি শহরের অন্য এরিয়ার তুলনায় এখানে ট্রানজেকশন নাকি একটু বেশি। বার কাম কফি হাউসের গেটের তুলনায় শর্ট-কোর্টের মতো ক্ষুদ্র দরজা দুটি ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এবার কোনো কথা না বলে সোজা টিফানিসের পাশের টেবিলে বসলাম। তখনো ওই নারী মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছেন। খেয়াল করলাম তিনি কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত্ত নন, মোবাইলে ক্রিকেট স্কোর দেখছেন।
‘আমি কালকের টাকাটা দিতে এসেছি’ কিছুক্ষণ বসে থেকে শুরু করার জন্য আমি বললাম। 
‘ওটা ক্যাশে দিলেই হবে’— তিনি প্রায় চোখ না তুলেই বললেন। 
‘কিন্তু আপনি কেন টাকার দায় নিতে গেলেন? ওরা তো আমাকে ছাড়তে চাইছিল না।’ 
‘আপনি যে কারণে বারে ঢুকে মদ না খেয়ে কফি খান, সেই কারণেই দিয়েছি।’ 
এর মীমাংসা আমার কাছেও ছিল। উত্তেজনা চড়ে যাওয়া আগেই ওয়েটার একটা গ্রিল করা মুরগি আর একটা কফি নিয়ে এল। ‘আমি তো কোনো অর্ডারই দেইনি’— বিস্ময় নিয়ে বললাম। 
‘স্যার, আমরা কাস্টমারের প্রথম অর্ডার রেকর্ড রাখি। এটাকে আমরা ট্যাগ মেনু কাউন্ট করি।’ ওয়েটার সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করল। তাই কাস্টমার কিছু না বললে এটাই পরিবেশন করে। এমনকি কফি আর গ্রিল (পেগের কথা উহ্য রেখে) তাদের সর্বনিম্ন মেনু। 
‘আমার এখন একেবারেই খিদে নেই। আপনিও আমার সঙ্গে শেয়ার করলে খুশি হব।’ টিফানি নারীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম। 
 ‘সরি, উনি আপনার সঙ্গে বসবেন না, আপনাকে ওই টেবিলে বসতে হবে স্যার’— দুই টেবিল পরের নির্দেশ দিয়ে ওয়েটার বলল। 

আমাকে বসিয়ে দেয়া হলো ছবি টাঙান দেয়াল ঘেঁষা একটা ফাঁকা টেবিলে। ছবির অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, তবে বোঝা যায়। একটা বহির্জাহাজের চোঙ দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে, কিন্তু সমুদ্রের ঢেউগুলো বোঝা যাচ্ছে না। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ওয়েটার জানাল— এটা নেক-হেড বার মালিকের দাদার সময়ের ছবি। তিনি বহির্জাহাজের নাবিক ছিলেন। তিনি জাহাজেরই মারা গিয়েছিলেন এবং তার সলিল সমাধি ভাগ্যে জুটেছিল। ছবিটা জাহাজ কোম্পানি বদান্যতাবসত একটা নিয়োগপত্রের সঙ্গে ডাকে পাঠিয়েছিল। যার ফলে মালিকের বাবাও একজন নাবিক হতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার কপালে সলিল সমাধি না জোটায় এবং সমুদ্রের নিঃসঙ্গতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় ছেলেকে সেখানে যেতে দেননি। তবে বাবা-দাদার সুবাদে এই বার-কাম-কফি হাউসটা জাহাজ ফেরতে নাবিক আর শহরে আসা নৌ-সেনাদের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাদের সঙ্গে থাকত বাহুলগ্না সুন্দরীরা। নারী নৌ-সেনারাও আসত অহরহ। তাদের আগমন এতটাই স্বতঃস্ফূর্ত ছিল যে, অনেক কিছুর উদাহরণ তৈরি করত নৌ-সেনাদের দিয়ে। 

আমি যেখানে বসেছিলাম সেখান থেকে উত্তরের হাফ ওয়ালের ওপর লাগান বোতল গ্রিন কাচের ওপাশটা ক্ষীণ দেখা যাচ্ছিল। সেখানে পরিত্যক্ত চেয়ার-টেবিলের একটা স্তূপ। ডিজাইন দেখে বলা যায়, তা কয়েক সেট হবে। কোনো মতে কফিটা শেষ করলাম। বিল দিতে গিয়ে দেখি নতুন বিপত্তি। ওদের ট্যাগ মেনুর চেয়েও তিন হাজার টাকা বাড়তি লেখা। 
‘পাঁচশ আজকের জন্য। বাকিটা কাল এসে পাঁচ মিনিট কথা বলে যাবেন।’— আমাকের প্রশ্নোন্মুখ দেখে ক্যাশিয়ার নিজেই বলল। 
এটা ছিলে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার কৌশল, যেখানে কোনো না-কোনো অজুহাতে টাকা হাতিয়ে নেয়াই তাদের ধান্দা। ওয়েটার আর ক্যাশিয়ারের হাসি থেকে আমার তা-ই মনে হলো। কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে এলাম। তবে এসবের মধ্যে ওই নারীটা এলেন কী করে? দুই দিন প্রায় এই কথাই ভাবলাম। 
বুড়োদের অবস্থা অনেকটাই ষাট-সত্তর দশকের ইউরোপীয় ব্যান্ড দলের সদস্যদের মতো— লিকলিকে শরীরের ওপর ঢোলা শার্ট চাপান। এবং অবশ্যই ঝুড়ি ছাপার ফুল হাতা শার্ট। পড়নে খাকি রঙা প্যান্ট, বিশেষ করে থাই স্ক্রিন কিংবা বেশ ঢিলেঢালা। শার্টের প্রান্ত চলে গেলে প্যান্টের গভীরে আর হাতায় কফ বোতাম লাগান। তাদের কাকতাড়ুয়া বলা যাবে না অবয়বের কারণে। ভাঙা চোয়াল আড়াল করেছে খুবই যত্নে ছাটা কাঁচা-পাকা দাঁড়ি এবং তার নির্দিষ্ট মাপ। হাতের শিরাগুলো অবশ্যই ফুলে থেকে প্রমাণ করছে তাদের শরীর একেবারে রক্ত শূন্য হয়ে যায়নি। পায়ের তুলনায় খানিকটা লম্বা ও প্যান্টের রঙে মলিন মহিষের চামড়ার জুতার অগ্রভাগ কিছুটা খালিই রয়ে গেছে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে।

তৃতীয়বারের মতো গিয়ে আবার হাজির হলাম সেই বার কাম কফি হাউসে। প্রত্যাশা অনুযায়ী টিভিতে ক্রিকেট চলছে আর টিফানি নারী সেখানেই বসে আছেন; তবে টেবিলটা আগের চেয়ে বেশি ঘোরানো। একেবারে ঘরের কোণের দিকে তাকিয়ে আছেন। তবে এই প্রথম তার কাছে কোনো বাধা ছাড়াই পৌঁছতে পেরে ছিলাম, যখন আগে থেকেই জানতাম আমার হাতে পাঁচ মিনিট সময় আছে। কিন্তু আমার পাঁচ মিনিটের প্রতি তার কোনো আন্তরিকতাই ছিল না। একইভাবে মোবাইলে খেলা স্কোর দেখছেন। আর সবচেয়ে মর্মান্তিকভাবে আমাদের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এক বাউন্সার। 
‘ব্রিটিশ রাজবধূর ব্যাপারটা দারুণ ছিল, তাই না?’ আমি শুরু করি, ‘একদিনের জন্য জীবনের ভাঁজ ভাঙা।’ 
‘হুম, সেটা একদিনেরই ব্যাপার। কিন্তু আপনি নিশ্চয় সাংবাদিক বা গোয়েন্দা নন, যিনি রাজবধূকে মুক্ত করতে পারেন।’ মোবাইল স্ক্রিনে নখের আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে তিনি বললেন। 
‘কাউকে মুক্ত করার জন্য নিশ্চয় সাংবাদিক বা শখের গোয়েন্দা বা আইনজীবী হওয়ার দরকার নেই।’ আমিও আভিজাত্য বজায় রাখলাম কথায়। 
‘না, একজন শিল্পী বা ফ্যাশন ডিজাইনার কিংবা একজন পাঠকও শহরের মানুষের রুচি-আচার বদলে দিতে পারেন। বাই দা ওয়ে,’ খানিকটা দম নিলেন, ‘আমি কিন্তু ব্রেক ফাস্ট অ্যাট টিফানিস ফিল্মটা দেখিনি।’ 
টিফানি চেয়ারে বসা মানুষটাই সিনেমাটি দেখে নাই! ঔপন্যাসিক ট্রুম্যান ক্যাপোটের চেয়ে সিনেমার অড্রে হেপবার্নকে বেশি চেনা হয়তো স্বাভাবিক। বিষয়টা ঠিক ততটাই আশ্চর্য করছিল, তার নীল রঙা প্রিন্টের জামা যতটা আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল। আরবদের মতো করে বানানো সুতি জামার হাতের দিকে খড়িমাটি রঙের মোটা ফেট্টি দেয়া, অনেকটা নাবিকদের হাতের স্টেপগুলোর মতো। সাদা পায়জামা সমর্থন করে কাঁধে ঝুলান সুতি ওড়নাটার প্রান্ত দুটি ঝুলিয়ে দেয়া। ‘রুমে টিভি থাকতে মোবাইলে স্কোর দেখছেন কেন!’ আমি তার প্রতি ব্যথিত হওয়ার চেষ্টা করলাম অসংকোচ চেপে না রেখে। 
‘এটা ক্রিকেট বেটিং’ তিনি বকশিশের মতো করে বললেন। ঠিক তখনই এক বাউন্সার গলা খাকিয়ে উঠলেন ‘উঁহু, ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা যাবে না। শুধু ফুল-লতা-পাতা নিয়ে আলাপ করতে হবে।’ পরক্ষণে তিনি ভর দিয়ে বললেন, ‘আপনি অনেক বেশি সময় নিয়ে ফেলেছেন, আসুন অন্য সিটে বসুন, আসুন।’ 
‘কিন্তু আমি তো কথা শেষ করতে চাই।’ আহত সৈনিকের মতো আমি বললাম। কিন্তু বাউন্সার প্রায় টেনে নিয়ে যেতে যেত বললেন, ‘সেটা অন্যদিন। ইনি এতবার এতজনের কাছ থেকে এই ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিস সিনেমার গল্প শুনেছেন যে, প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। বুঝলেন? কিন্তু তার আগে আমাকে কাউন্টারের টাকা জমা দিতে হবে মশাই।’ প্রথম দিনের ওয়েটার এসে আমাকে বলল। একটা চাপা হাসির রোল পড়ে গেল বারের ভেতর। 

‘কাতারে আসো ভাইয়া, লাইনে দাঁড়াও’ এক বুড়ো পেগ তুলে নিয়ে বললেন। তিনি একটু একটু কাঁপছেন। ঢোলা শার্ট মনে হচ্ছে তার শীর্ষ শরীর ক্ষতিপূরণ আর চামড়ার নিচে যেন কেঁচো ঢুকে পড়েছে এতটাই শিরা ওঠা তার হাত। তিনি জানালেন, এই বার কাম কফি হাউসের সবাই নাকি একজন নারীর জন্য অপেক্ষা করছে। কারও কারও অপেক্ষা কয়েক যুগেরও বেশি। কিন্তু তাদের দেখা নারী আলাদা আলাদা। কেউ তাকে সুন্দরী বলেন তো কেউ বলেন হুর, কেউ দেবী বলেন তো কেউ বলেন অড্রে হেপবার্ন। কিংবা কেউ বলেন তাকে প্রত্যাখ্যান করা নারীর কথা। এক সময় এ নিয়ে বেশি হট্টগোল হতো। এখনো বয়সের কারণেই হয়তো কমে এসেছে। কিন্তু আমার কাছে তাকে করপোরেট অফিসের চৌকস নারী মনে হলো। আশ্চর্য হলো, সবার দেখা নারীর পোশাক একই রকম। অনন্ত পক্ষে তার হাতে কারুকাজ করা হাড়ের পলা আর আঙুলে কালচে আংটির কথা সবাই বলেন। তারা অপেক্ষা করছেন, ওই নারীকে চূড়ান্ত রকমে দেখার জন্য, যার প্রতিশ্রুতি কফি হাউসের পক্ষ থেকে তাদের দিয়ে রেখেছে। তারা সবাই এতটাই মাতাল যে, আমাকে ঘিরে ধরেন, চাউর গল্পের মতো নতুন করে তার দেখা নারীর কথা বলতে চান। আর শুনতে চান আমি তাকে কেমন দেখলাম।

একজন গোপনে হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন। ‘আমার কাছে এই কয় টাকাই আছে ভাই’ একেবারে কাতর কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আপনি কালকে আরেকবার টিকিট করবেন। তারপর তাকে দেখে শুধু বলবেন, এখন কেমন দেখলেন।’ জোরে জোরে দম নিচ্ছিলেন লোকটা। আমি ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। 
একজন চেয়ারের কোণ ধরে প্রায় কাপা কণ্ঠে বলে ফেললেন, ‘তুমি আমার কথা শুনো, তুমি তরুণ মানুষ, তাই উত্তেজনাটা বুঝবে। বলত পারো, স্ত্রী-সন্তান, বাসাবাড়ি, ভালো চাকরি ছেড়ে একজন মানুষ কার জন্য কফি হাউসের টেবিলে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে পারে, বলত পারো?’ অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার মতো কণ্ঠ নামিয়ে বললেন, ‘আমার স্ত্রী-সন্তানরা এখনো এই কফি হাউসের সমস্ত বিল পরিশোধ করছে আমার ফিরে যাওয়ার জন্য।’ তারপর খানিকক্ষণ বিড়বিড় করলেন। যে শব্দগুলো কানে আসে তা যোগ করলে দাঁড়ায়: জানোয়ারগুলো আমার সব সম্পত্তি বিক্রি করে খাচ্ছে, এখন...। 

যৌন বিকৃতি নেই যদিও, এরা যে খানিকটা দুর্বল চিত্তের পুরুষ, তা বুঝতে সময় লাগে না। নাস্তিতে পৌঁছতে পারেননি, বরং চূড়ান্ত রকমের আস্তি এদের। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন অপেক্ষা আর প্রার্থনার করুন সভায়। একটু পরিশ্রম করে জয় করার চেয়ে বরং করুণা ভরে প্রাপ্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। 
এদিন আমি বিল দিলাম দশ হাজার টাকার ওপরে। ক্যাশের পাঞ্চ মেশিন সচল হওয়ায় তাৎক্ষণিক অসুবিধা হয়নি। কিন্তু সঞ্চয় কমে আসছিল দ্রুত। বিলের কাগজ দেখে বেশি টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে একই উত্তর দিল—বাকিটা কাল শোধ করে নিবেন। 

চতুর্থবারের মতো কফি হাউসে যাওয়ার ব্যাপারটা ছিল উৎসুক ধরনের। এমন গুরুতর একটা অনিয়মের পরও হাউসটা চলে কী করে! এবার চোখ রাখছিলাম বুড়ো টেবিলের ওপর। সেখানে একজন বুড়ো কিছুই করছেন না, হাঁ করে তাকিয়ে আছেন টিভি স্ক্রিনের দিকে। তার ঘোলাটে চোখ আর মাঝে সিঁথি কেটে পাকা চুলগুলো নামিয়ে দিয়েছেন মাথার দুই পাশে। আমাকে আশ্চর্য করে, দিব্যি বলে দিচ্ছেন খেলায় কোন বলের পর কী হবে, এমনকি রানের কথা বলছেন নির্ভুলভাবে। যেন আদিষ্ট সর্বদ্রষ্টার মতো খেলার রহস্য ফাঁস করে দেয়ার গূঢ় দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। কিন্তু তার এ বলার মাঝে কারও আগ্রহ ছিল না। 
‘এভাবে বসে আছেন! কার্ড খেলছেন না কেন?’ কয়েকবার ডাকার পর সংবিৎ ফিরল তাঁর। 
‘এই তো। টাকা নেই।’ পরে খানিকটা উৎসাহী হলেন। 
‘কিন্তু যেভাবে বল-রান নির্ভুল বলে দিচ্ছেন, তাহলে আপনার তো হারার কথা না।’ একটা সন্দেহ লুকিয়ে রেখে বললাম। 
তিনি মৃদু হাসলেন। ‘হুম, বলেছেন বটে। তবে কি, এটা ওরা সবাই জানে।’ খানিকটা থেমে আবার— ‘সমস্যা নেই, টাকা চলে আসবে।’ পুরোনো জুতায় পা গলাতে গলাতে তিনি বলছিলেন। খেয়াল করলাম তাদের কারও টেবিলে টাকার চালাচালি নেই, মুখে মুখে হিসাব রাখছেন। কিন্তু তার অঙ্কও কম নয়। টাকা বদলে নড়াচড়া হচ্ছে প্লাস্টিকের গোল মুদ্রা। 

‘শোনেন, কার খুতিতে কয় টাকা আছে তা আমাদের জানা হয়ে গেছে। আর এতবার এই পয়সা লেনদেন হয়ে যে, সবাই ভুলেই গেছে কার কয় টাকা। এখন সবার সমান টাকা।’ বুড়ো লোকটাকে ডেকে নিতে নিতে আরেকজন বললেন। মূলত কফি হাউসের আসন এতটাই নির্দিষ্ট যে, একজন না খেললে অন্যদের ব্যাঘাত হয়। তাই চালিয়ে নেয়। ‘Everything is your property, but nothing is your own.’ শেষবারের মতো পরিষ্কার উচ্চারণে লোকটা বলল, ‘এখানে কেউ হারে না, কিন্তু সবাই খেলে।’ 
এ দিন লক্ষ্য করলাম ওয়েটারদের একজন আমার সঙ্গে সৌজন্য কথা বলতে চায়। বিষয়টা কৌতূহল জাগানিয়া। ‘এই বুড়োগুলো একসময় অনেক টাকা নিয়ে এসেছিলেন। এগুলো সব প্লাস্টিকের কয়েনে রূপান্তর করে নিয়েছেন। কিন্তু বুড়োগুলো হার-জিৎ নিয়ে এতটাই মত্ত যে পয়সাগুলো কোথায় হারিয়ে ফেলেছেন কে জানে, এখন আর টাকা ফেরত পাওয়া কোনো সম্ভাবনা নেই।’ টিস্যু দিয়ে টেবিল মুছতে মুছতে খাটো স্বরে বলছিল ওয়েটার। ‘এরা বছরের পর বছর এখানে বসে থাকলেও উচ্ছেদের চিন্তা করে না। এরাও খেলা বন্ধ করে না। তাদের বাড়ির লোকজন তাদের নিয়ে গেলেও আবার দিয়ে যায়। এই বুড়োদের দিয়ে হবে কী বলেন? বৃদ্ধাশ্রমে থাকার চেয়ে এখানেই ভালো আছে।’

খেলোয়াড় হিসেবে এদের চেহারা অনেক বেশি শুল্ক বিভাগের কর্মকর্তাদের মতো চিন্তামগ্ন মনে হলেও, আসলে তারা ভেতরে-ভেতরে যখন-তখন আমুদে হয়ে উঠতে পারেন। তাঁদের টাকা দিয়ে হাউসের মালিক বিপুল বিত্তের মালিক হয়ে গেছেন। এখন আর বিল না নিলেও তবু চলছে। ‘খেলা বন্ধ হলে তারা টাকা ফেরত চাইত এ জন্য তো!’ —জিজ্ঞেস করলাম। 
‘হ্যাঁ।’ প্রায় বোধহীন মাথা ঝাঁকাল সে, ‘হাউসের মালিক এই বোকা বুড়োদের একটা অদ্ভুত গল্প বলে আটকে রেখেছে।’ ছেলেটার চোখেমুখে এক গোপন উৎসাহ বুঝতে পারছিলাম। ‘আপনার সম্ভব হলে টিফানিকে এখান থেকে নিয়ে যান। না হলে মালিকের গল্পে তিনি চিরদিনের জন্য বন্দী হয়ে যাবেন।’ 
হঠাৎ করে ছেলেটা এতটা হিতাকাঙ্ক্ষি হয়ে ওঠা সন্দেহজনক। ‘আপনি তাকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন,’ স্বর নামিয়ে বলছিল ওয়েটার। 
‘তাতে আপনার আগ্রহ?’ চোখ ফেরালাম তার দিকে। বসে থেকে তার গলার কণ্ঠনালী দেখা যাচ্ছিল। মাথায় ক্যাপ আর পড়নে নির্ধারিত জামা। ছেলেটা প্রথমে মুখ খুলতেই চাইছিল না। তারপর অবনতভাবে বলল, ‘ওকে মুক্ত করার সাধ্য আমার নেই। একেবারে বেহাত হয়ে যাওয়ার চেয়ে আপনার কাছে ভালো থাকবে।’ আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলাম বুড়োদের হট্টগোল আর টিভিতে ক্রিকেটের শব্দের মধ্যে। 
‘আপনি জানেন না,’ ছেলেটা শঙ্কা নিয়ে বলল, ‘যে কোনো মুহূর্তে এই পুরোনো ভবনটা ধসে পড়বে। সবার নির্ঘাত মৃত্যু। তখন মিডিয়াতে স্রেফ সিমপ্যাথি জাগানিয়া নিউজ ছাড়া কিছু হবে না। সব ঠিকঠাক করাই আছে।’ আর আগে তিনি মালিকের কয়েকটা মিডিয়া হাউস, টিভি চ্যানেল আর ব্যাংকের খবর আমাকে জানিয়েছেন। 

পুরোনো মেনু অর্ডার করলাম আমি। সঙ্গে পিৎজা অর্ডার করলাম যেন খাবার নিয়ে আসতে একটু বেশি সময় লাগে। টিফানি টেবিলে একটা আসন, তা ওই নারীই দখল করে রাখায় কখনো সেখানে বসার সুযোগ ছিল না। আমি বসলাম ঠিক তার পেছনে নয়, তবে পাশাপাশিও নয়, কোনাকুনি— টেবিলে যেখান থেকে তার মুখের কিঞ্চিৎ দেখায় যায়। 
‘আমি ঠিক জানি না।’ অনুদ্বেগে টিফানি নারী বললেন। আমরা কথা বলছিলাম সমুদ্র চষে বেড়ান নৌ-ডাকাতদের মতো ইঙ্গিতময় ভাষায়। ‘বেশ কিছু বছর আগে শহরে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়লে যে, কফি হাউসে এক নারীকে দেখে চারজন পুরুষ নিজের শিশ্ন কেটে আত্মহত্যা করেছেন। ব্যাস। তারপর আর কিছু নয়। কোত্থেকে যে এটা শুরু হলো কে জানে! কফি হাউসের মালিক ঘোষণা দিলেন— সেই নারী এখন নেক-হেড হাউসে। একেবারে রমরমা ব্যাপার।’ নিজের ব্যাপার সম্পূর্ণ উদাসীনভাবে বললেন, ‘আমাকে বলা হয়েছে শুধু একটা কফি হাউসে মডেল হিসেবে বসে থাকতে, তবে কাউকে মুখ দেখান যাবে না।’ খানিকটা দম নিয়ে আবার বললেন, ‘মডেলিংয়ে ভালো যাচ্ছিল না বলে রাজি হয়ে গেলাম।’ 
‘কিন্তু আপনার জন্য অতগুলো বুড়ো জীবন জুয়ায় নেমে পড়েছেন— তা কী বলবেন?’ আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না, এর মীমাংসা কী হতে পারে। 
‘হাহ্’ ফুৎকার দিয়ে উড়িয়ে দেয়ার মতো বললেন টিফানি নারী, ‘তারা অনেক আগেই জীবনে ফতুর হয়ে গেছে, এখন তারই অনুরণন বলতে পারেন।’ তাদের ক্রিকেট নিয়ে বাজি ধরাও নাকি স্রেফ ছেলে-খেলা। 
‘ওগুলো অনেক পুরোনো খেলা,’ মাথা নিচু করেই বললেন, ‘হাউসের মালিকের চালিয়ে রাখা ভিডিও। ওগুলো এতবার এই হাউসে চলছে যে, প্রতিটা বল পর্যন্ত মুখস্থ হয়ে গেছে তাদের। তাই এখন আর কেউ হারে না, বরং নিজেদেরই এক-একদিন ঠিক করতে হয় কে হারবে কে জিতবে। স্রেফ রুটিন ওয়ার্ক।’ 
‘আর আপনার ক্রিকেট বেটিং?’ ছোট্ট করে আমি জিজ্ঞেস করলাম তার কথার গতি অক্ষুণ্ন রেখেই। 
‘এত বছরে বেতন এক পয়সা বাড়েনি। এখানে বসে আমি যা পাই, তার চেয়ে বেটিংয়ে বেশি পেতে পারি। এই চুক্তি শেষ হলে দূর দেশে গিয়ে থাকা যাবে।’ তিনি আবার খেলায় মনোযোগ দিলেন। তার হাতের মোটা পলা টেবিলে ঠক ঠক আওয়াজ তুলছিল।

এদিন বিল দেয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রশ্ন করলাম না। পার্সেল এগিয়ে দেয়ার নামে ওয়েটার আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে দিতে কিছু ক্লু ধরিয়ে দিল। প্রথম দিকে কফি হাউসে শুধু ধনাঢ্যদের আমন্ত্রণ জানান হতো। চলতো দামি মদ। তখন টিফানির সঙ্গে মিশতে পারত সবাই। চাহিদা বাড়তে থাকায় জামানত নেয়া শুরু হলো আর টিফানিকে ঘুরিয়ে দেয়া হলো দেয়ালের দিকে। তারপর বলে দেয়া হলো সপ্তাহে একদিন দেখতে পারবেন তাকে। কিন্তু কাস্টমার জানতেন না সেই দিনটা কবে। 
‘কিন্তু এখন তো তেমন কেউ আসে না।’ রাতের গভীরতাকে উপেক্ষা করে আমি বললাম। 
‘এ কারণে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে, এই নারীর জন্য যে সব চেয়ে ত্যাগ স্বীকার করবে, তার জন্যই একটা স্থায়ী আসন বরাদ্দ হবে। তাতেও লোক কম পাওয়া গেল না।’ 
‘তাদের ভোলানোর জন্য জুয়ার আসর বসিয়ে দেয়া হলো।’ বিদায় নেয়ার আগে বললাম। 
‘হুম। আর বলা হলো, যিনি সবাইকে ফতুর করতে পারবে তারই সঙ্গে রাত্রিযাপন করবেন ওই নারী।’ হতাশ হয়ে থামল ছেলেটা। ‘এই টিফানির চেয়ারে আগে অনেকেই বসেছে, কিন্তু তখন ভবন এত ঝুঁকিপূর্ণ ছিল না।’ আক্ষেপ করল ওয়েটার।

রাস্তার পাশে নেক-হেড বারের অনুজ্জ্বল ও সংক্ষিপ্ত সাইনবোর্ডটা পেরিয়ে যাওয়ার পর একজন চল্লিশোর্ধ্ব নারী এগিয়ে এলেন। সুশ্রী ও পরিশীলিত, তবে স্থূল। গা থেকে দীর্ঘক্ষণ ঘোরতর এসির ভেতর থাকার স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ রেব হচ্ছে। মাথায় জর্জেটের পাতলা ওড়না একটু টেনে বললেন— ‘কেমন দেখলেন?’ 
‘কী?’— কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম। তবে গুপ্তচরও মনে হয়নি তাকে। 
‘আমি লক্ষ্য করেছি, এই যে কয়েক দিন যাবৎ আপনি ভেতরে যাচ্ছেন। বাদলের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে, ওয়েটার বলেছে।’ খানিকটা দম নিয়ে বললেন, ‘ভেতরের মানুষগুলোর কি কোনো বদল আছে।’ 
‘না’— আমি এড়ানোর জন্য বলি। আসলে তাদের সম্পর্কে আমি কতটাই বা জানি। 
তিনি ধীরে ধীরে পার্স থেকে একটা পারিবারিক ছবি বের করলেন। সমুদ্র সৈকতে একজন পুরুষকে ঘিরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। খেয়াল করে মনে হলো, পুরুষটাকে আমি বারের ভেতর দেখেছি। সেই লোক যারা স্ত্রী-সন্তানরা এখনো তার সমস্ত খরচ বহন করা কথা স্বীকার করেন, কিন্তু একটা ঘৃণার ভেতর দিয়ে। 
‘হ্যাঁ, ইনি ভালো আছেন।’ দ্রুত পায়ে তাঁকে ছড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। 
‘ওই ভবনটা তো অনেক পুরোনো। আমরা চিন্তায় থাকি’— শেষ বারের মতো তিনি বললেন। 
‘তিনিও আপনাদের স্মরণ করেন’— ঘাড় ফিরিয়ে বললাম তাকে। ঘরে ফেরার আগে চোখ গেল, দূরে নেক-হেড বারের বেয়ারাটা তখনো দাঁড়িয়ে আছে। 

রাত এতটা গভীর হয়েছে যে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা রাস্তা ঝাড়ু দিতে লেগে পড়েছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল টিফানি আসলে বিস্মৃত এক ঘুমন্ত সুন্দরী, যে আসলে জানে না তার কারণে চারপাশে সব তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে জাগানো দরকার। সে-ই মুক্ত করতে পারে বিগগত যৌবনা বুড়োদের। নয়তো এই ভবন ধসে মৃত্যু ছাড়া কপালে কিছুই লেখা নেই। 
বাসার গেটে তহিদুলকে দেখে প্রায় সংবিৎ ফিরল। চাবির জন্য দাঁড়িয়ে আছে। ও ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছিল আমাকে একা বাইরে দেখে। আমি ওকে নেক-হেড কফি হাউসের কথা বললাম, বারের কথা ঊহ্য রেখে। তহিদ বাসায় এসে ছিল আরও কয়েক দিনের জন্য লাপাত্তা হওয়ার জন্য জামা-কাপড় নিতে। 
‘তুই ওখানে গেলি কী করে,’ টিফানির কথা জিজ্ঞেসের আগে ও বলল, ‘ওটা একটা অদ্ভুত বার!’ 
‘আমি ওই টিফানিকে নিরাপদে উদ্ধার করতে চাই।’ আমার কথায় কোনো সংকোচ ছিল না। 
‘তুই উদ্ধার করতে চাস বলেই ওকে বন্দী মনে হচ্ছে, এটা কিছু নয়, স্রেফ খেলা।’ কথা না বাড়িয়েই বেরিয়ে গেল এক সপ্তাহের কথা বলে। শুধু বলল, ‘আমি ফিরে আসা আগে কিছুই করিস না।’ 
বারের ভেতর ভাস্কর্যের মতো বুড়োদের দৃঢ়তা আর অপেক্ষা দেখে তাদের প্রতি মনের ভেতর শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়; তা আসলে মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকা বালির সৌকর্য, একটু স্পর্শে ঝুর ঝুর করে ভেঙে পরতে শুরু করবে। শুধু টিফানি নারী নয়, অনন্তকাল অপেক্ষায় থাকা এই বুড়োদের জন্য বসে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের জাগিয়ে তুলতে পারলে টিফানিকে উদ্ধার করা সহজ হবে।

পঞ্চমবারে মতো কফি হাউস-কাম-বারে ঢুকে পরলাম কোনো দিকে চোখ না দিয়ে। প্রথমেই বারের পুরোনো টেবিলগুলো উপড়ে ফেললাম। খুদে রাজনীতিকের মতো তাদের জানালাম—তাঁরা স্রেফ একটা ধোঁকায় পড়ে আছে। টাকা জমা দিয়ে তারা যে পয়সা অর্জন করেছে, তা ছেলে ভোলান মাত্র। ক্রিকেট আর নারীর গল্প নিতান্তই হত্যার নকশা। কিন্তু বুড়োরা এতটাই ভাটিতে চলে গেছে যে, আত্মরক্ষার স্পৃহাটুকু ক্লান্তি মনে করে। তবে হাউসের ভেতর একটা সোরগোল পড়ে গিয়েছিল। বাউন্সারগুলো এগিয়ে আসার আগেই আমি পৌঁছে গেলাম টিফানির টেবিলে। ‘আমি আপনাকে উদ্ধার করতে চাই।’ উত্তেজনায় টিফানির হাত ধরে বলি। 
‘কিন্তু এই কফি হাউস ভেঙে পড়ার আগে তো আমার মুক্তি নেই। আমি বেরিয়ে যাওয়া মানে তো এটা ধসে গেছে’—টিফানি নারী বললেন কোনো প্রকার বিস্ময় না নিয়ে; যেন প্রেমিকের সংখ্যায় তিনি গর্বিত, কিন্তু যত্নহীন। প্রতিটা মানুষের মতো তিনি কাউকে অনুগত রেখের মনের সামন্তীয়তা বজায় রেখেছেন। 
ঠিক তখনই ব্যাপারটা ঘটে গেল। বারের দুইজন হৃষ্টপুষ্ট বাউন্সার তেড়ে এল আমার দিকে। কাছে এসে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে হামলে পড়ল। বেদম মার শুরু করল তারা। একেবারে হাঁটু থেকে চোয়াল পর্যন্ত লাঠি পেটা। আমার চোখের সামনে ভবনটা কাঁপছিল। যেন ভূমিকম্প। যেকোনো মুহূর্তে ধসে পড়বে ভবন। আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয়া হলো একটা বিড়াল ছানার মতো জানলা দিয়ে। সম্ভবত রাস্তায় গিয়ে পড়েছিলাম। এতটাই অবহেলায় পড়লাম যে, রাস্তা থেকে আর উৎখাতের প্রয়োজন বোধ করল না। যেন পলিথিনে মোড়া গৃহস্থালি ময়লায় স্তূপ, যা কেবল পরিচ্ছন্নতা কর্মীরাই অপসারণ করবে। 

কিন্তু আশ্চর্য লাগছিল, হাউসের বুড়োগুলো কিছুই করছিল না যখন আমাকে ফ্রাই প্যান দিয়ে পেটাচ্ছিল আর একটা মরচে পড়া ছুড়ি দিয়ে ফালা ফালা করছিল আমার শরীর। অথচ আমি এত দিন তাদের প্রেমময় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখার চেষ্টা করেছি। শুধু সভায় শোকপ্রস্তাবের পর গর্দভের মতো এক মিনিট নীরবে দাঁড়িয়ে ছিল ঘড়ি ধরে। আমার জন্য এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। যত্ত সব ভগ্নযাত্রী, যারা হয়তো আত্মহত্যার সামর্থ্য হারিয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর জন্যই অপেক্ষা করছে। এমনকি হেলাফেলায় কেউ তাকে খুন করুক, সেটাও সমর্থন করার মতো ন্যুব্জ মৌন গ্রহণ করেছে। এরপর আর কিছুই মনে নেই। 
যখন চোখ খুললাম তখন হাসপাতালের বেডে। আমাকে ভর্তি করা হয়েছে সমুদ্র ফেরত নৌ-সেনাদের চিকিৎসার জন্য তৈরি বিশেষায়িত হাসপাতালে। সারা শরীরের প্রচণ্ড ব্যথা আর ক্ষত জর্জরিত। পাশে তহিদুল বসা। 

‘তোকে এত করে বললাম একা রেব হোস না। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান না ফিরলে তো আশাই ছাড়তে হতো।’ তহিদুল আক্ষেপ করল, ‘ছিনতাইয়ের কবলে পড়লি কী করে? তোকে দেখার কেউ ছিল এখানে!’ 
‘হুম’ আত্মসমর্পণ করলাম অসমর্থন রেখেই। ‘ওই নেক-হেড বারে গণ্ডগোল হয়েছিল।’ 
‘এ কথা তোর মতো গাড়লের কাছে থেকেই শুনতে হয়।’ হাসিতে দুলে ওঠার আগে, ও প্রায় করুণভাবে তাকে দমিয়ে আনল, ‘ওটা এই শহরের পৌরাণিক গল্পের অংশ। বহু আগেই বিলীন হয়ে গেছে। আসলে ছিল কি না তারও ঠিক-ঠিকানা নেই।’ 
এ সময় আমার বেডে দায়িত্বে থাকা নার্স এলেন হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে। আমাদের চোখে বিস্ময়, একই সঙ্গে উপেক্ষাও। 
‘কে দিয়েছে?’ 
কিছু বলতে পারলেন না নার্স। নির্দিষ্ট সময়ে রোগীর ওষুধের নাম মনে করিয়ে দেয়ার মতো কেবল বললেন— একজন নারী, হাতে কারু কাজ করা মোটা পলা আর রেশমি চুল তার। চেহারার কোনো বর্ণনা দিতে না পেরে বললেন। আমাদের পীড়াপীড়িতে খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, মুখটা নৌ-বাহিনীর নারীদের মতো ফ্রেমে বাঁধান নয়। 

‘ঘুমন্ত সুন্দরী!’ আমরা এক সঙ্গে বলে উঠলাম। 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়