ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

বিদায় সুরের সরস্বতী 

সন্দীপন ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৬, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৩:২১, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
বিদায় সুরের সরস্বতী 

সঙ্গীত জগতের সম্রাজ্ঞী হওয়ার আগে শিশু অভিনেতা হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ শুরু করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম শিল্পী লতা মঙ্গেশকর। জীবনের প্রথম গান গাওয়া রেডিওতে ১২ বছর বয়সে এবং ১৩ বছর বয়সে মারাঠি সিনেমায় প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে যাত্রা শুরু। যদিও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সিনেমাটি রিলিজ হলেও গানটি বাদ পড়েছিল। পরের বছর মারাঠি ছবি ‘গাজাভাউ’-এর জন্য ‘মাতা এক সুপুত কি দুনিয়া বদল দে তু’ গানটি রেকর্ড করেন লতা মঙ্গেশকর। এটি ছিল তাঁর প্রথম হিন্দি গান।

সাত দশকের দীর্ঘ কেরিয়ারে ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় এবং কিছু বিদেশি ভাষায় ৩০ হাজারের অধিক গান গেয়ে হয়ে উঠেছিলেন সকলের প্রিয় লতাদি, লতাজি কিংবা লতা বইন। জন্ম ১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর তৎকালীন ইন্দোর রাজ্যের রাজধানী ইন্দোরে, মারাঠি সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর এবং শেবন্তীর ঘরে। তাঁর প্রথম নাম ‘হেমা’। পরবর্তীকালে বাবা দীননাথ মঙ্গেশকরের ‘ভাওবন্ধন’ নাটকের লতিকা চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে নাম রাখা হয় ‘লতা’।

শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তাঁর। বাবা চাইতেন তিনি শুধু ধ্রুপদী গান নিয়েই থাকুন। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তাঁর বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিও কেনার পর নব ঘুরাতেই প্রথম যে খবরটি তাঁকে শুনতে হয় তা হলো― কে এল সায়গল আর বেঁচে নেই। 

মঙ্গেশকর পরিবারের সবাই কোনো না কোনোভাবে শিল্প জগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন ধ্রুপদী সঙ্গীতপিয়াসী। অভিনয়ের পাশাপাশি গায়ক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। একবার তিনি এক ছাত্রকে একটি বিশেষ রাগ অনুশীলনের কথা বলেন। ছাত্রটি অনুশীলন করছে। এর মধ্যেই ছোট্ট লতা তার ভুল ধরিয়ে দেয়। সেদিন বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর বুঝতে পারেন, তাঁর বড় মেয়ে গায়িকা হতে চলেছে। বাবা ছাড়াও লতা মঙ্গেশকর গানের তালিম নিয়েছেন আমানত খান, আমান আলী খানের মতো কিংবদন্তির কাছে।

১৯৪২ সালে বাবার মৃত্যু আর অর্থনৈতিক সংকট মুশকিলে ফেলে দেয় মঙ্গেশকর পরিবারকে। কিছুটা অর্থের প্রয়োজনেই প্রায় ছ’বছর পেশাদার অভিনয় জীবনে আটটি সিনেমায় অভিনয় করেন পাঁচ ভাই-বোনের সবচেয়ে বড় লতা মঙ্গেশকর। তবে অভিনয় কেরিয়ার তেমন আর এগোয়নি। লতা মঙ্গেশকরের জীবনেও ব্যর্থতা এসেছিল! তাও কেরিয়ারের শুরুতেই। সেই সময় নূরজাহান, শামসাদ বেগমের রমরমা সময়। একটু নাঁকি ভারি গলার চল তখন। অনেকেই বলেছিলেন, লতা মঙ্গেশকরের গলা বড্ড সরু। প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘শহীদ’ সিনেমায় গান গাওয়ার ইচ্ছে বাতিল করে দিয়েছিলেন এ কারণে। লতার গলা পাতলা―মন্তব্য ছিল তাঁর। সঙ্গীত পরিচালক গুলাম হায়দার অবশ্য সেদিন বেশ কিছু কথা শুনিয়ে এসেছিলেন শশধরকে। জোর গলায় বলেছিলেন, ‘প্রযোজকরা এরপর লতার পা ধরে তাঁদের ছবিতে গাওয়ার জন্য অনুরোধ জানাবে।’ হয়েছিলও ঠিক তাই। ১৯৪৯ সালে ‘মহল’ সিনেমার সুপারহিট ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানের পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ওঁকে।

অনিল বিশ্বাস, এসডি বর্মন, সলিল চৌধুরীর মতো সঙ্গীত পরিচালকদের পছন্দের গায়িকা ছিলেন লতা। অনেকেই হয়তো জানেন না আরডি বর্মনের কেরিয়ারের প্রথম ও শেষ গানটি লতার কণ্ঠে রেকর্ড করা। নতুন শতাব্দীতে গানের জগত থেকে নিজেকে অনেকটাই গুটিয়ে নিয়েছিলেন লতা। তবুও ‘বীর জারা’, ‘রং দে বাসন্তি’র মতো ছবির অ্যালবামের শোভা বাড়িয়েছে তাঁর সুমধুর কণ্ঠ। ২০১৯ সালে ভারতীয় আর্মিকে শ্রদ্ধার্ঘ্য দেন লতা। রেকর্ড করেন ‘তেরি মিট্টি কি সওগন্ধ’। এটিই লতা মঙ্গেশকরের রেকর্ড করা শেষ গান।

লতা মঙ্গেশকরের বিখ্যাত গানের তালিকা অগুনতি―এই তালিকা শেষ হওয়ার নয়। ১৯৭৪ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত বিশ্বে সর্বাধিক গান রেকর্ডের জন্য গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ নাম ওঠে শিল্পীর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৩০ হাজারের বেশি গানে কণ্ঠ দেন। 

১৩ বছরের মেয়ে যে অনুশীলন, স্বশাসন আয়ত্ব করেছিল তিলে তিলে জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও সেই নিয়মই লালন করেছেন। ‘লতা মঙ্গেশকর মিউজিক কোম্পানি’র অধিকর্তা, সুরকার ময়ূরেশ পাই একবার এক সাক্ষাৎকারে সেই বাংলা গান রেকর্ডের দিন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘লতাজিকে বলেছিলাম, আপনি লাঞ্চ করে নিন, তারপর আমরা কারেকশনগুলো ঠিক করে নেব।’ শুনে বললেন, ‘যে দিন রেকর্ডিং থাকে আমি তো সে দিন কিছু খাই না। ভরপেটে রেকর্ডিং হয় নাকি! স্রেফ চায়ে পিতি হুঁ। তুমি আমার জন্য পারলে আধ বাটি স্যুপ আনিয়ে দাও।’

দীর্ঘ কেরিয়ারে দেরি করে সেটে আসা ছিল অপছন্দের। বাঙালি এবং কলকাতার মানুষের প্রতি এক অদ্ভুত টান, অন্যরকম ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ছিল তাঁর। কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে আশা ভোঁসলে বলেছিলেন―উনি যখন কলকাতায় প্রথম শো করতে আসেন তখন তাঁকে তিনি বলেছিলেন ‘বাঙালিরা এবং কলকাতার মানুষ গান খুব ভালোবাসে এবং গান বোঝেও। সুতরাং তুমি যেখানেই গান গাও, মন প্রাণ ঢেলে গান গেও। যাতে তোমার গান দর্শক উপভোগ করতে পারে।’

তাঁর এই স্বর্ণময় ৭০ বছরের সঙ্গীত জীবনে ২০০টির বেশি বাংলা গান রেকর্ড করেছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রের প্লে ব্যাক গায়িকা হিসেবে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। বাংলা ভাষায় অনেক বেসিক গানও গেয়েছিলেন এই সুর সম্রাজ্ঞী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী―কার সুরে গান করেননি লতা? সেসব গান আজও লোকের মুখে মুখে ফেরে। লতার কণ্ঠে প্রাণ পেয়েছে বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত। হেমন্ত-লতা জুটির গাওয়া ‘তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা’ গানটি তো অনবদ্য। 

১৯৬৩ সালে দিল্লির রামলীলা ময়দানে একটি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুসহ বহু বিশিষ্টজনের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকরও। লতাজিকে দেখতে ভিড় উপচে পড়েছে। তিনি গাইলেন ‘আয়ে মেরে ওয়াতন কি লোগো’। রামলীলা ময়দানে তখন কারও মুখে কথা নেই। মঞ্চে বসা নেহেরুর দু’চোখে তখন জলের ধারা। তাঁর আশপাশে বসে থাকা বিশিষ্টদের চোখও ছলছল। 

পরবর্তীকালে লতাজির কণ্ঠে এই গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। সি রামচন্দ্র সুরারোপিত এ গানের গীতিকার কবি প্রদীপ। তারপর থেকেই দেশের স্বাধীনতা দিবস কিংবা সাধারণতন্ত্র দিবসে লতার কণ্ঠে এই গানটি দেশের প্রায় সর্বত্র শোনা যায়। আজও সেই গান প্রাসঙ্গিকতা হারায়নি।

দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। ১৯৮৯ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। ২০০১ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসমারিক নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করা হয়েছিল লতা মঙ্গেশকরকে। ২০০৭ সালে ফ্রান্স তাদের দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার (অফিসার অব দি লেজিয়ান অব অনার) দিয়ে সম্মানিত করে লতা মঙ্গেশকরকে। 

লতা মঙ্গেশকরকে রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়েছিল। অসুস্থতার জন্য তিনি রাজ্যসভার সেশনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু উনি এক টাকা বেতন বা বাড়ি ভাড়া বা কোনো বাড়তি সুবিধা নেননি, যা সাধারণত দেওয়া হয় সাংসদদের।

গানের রয়্যালটি নিয়ে হয়েছিলেন সরব। অথচ ডিপ্লোম্যাটিক আখ্যাও বয়ে বেড়াতে হয়েছে আজীবন। সত্যিই কি তিনি পলিটিক্যালি কানেক্ট ছিলেন? ঘনিষ্ঠরা বলেন, নিভৃত জীবন বেছে নিলেও সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে ৯২-তেও ওয়াকিবহাল ছিলেন লতা। প্লে ব্যাক সিঙ্গিংয়ে বর্তমান সময়ে এক্সেলেন্সের পরম্পরা ধরে রাখতে না পারা নিয়েও হয়েছেন সরব। আবার নিজের গান ১০০ বছর পরেও লোকের মনে থাকবে কিনা তা নিয়েও প্রকাশ করেছেন সন্দেহ। বলেছিলেন, ‘যুব সমাজের মনোযোগের স্থায়িত্ব এখন বড় কম’। অভিমান না চরম সত্য? নিভৃতে থেকেও নিভৃতে থাকেননি লতা। গত বছর জন্মদিনের আগেও সংবাদমাধ্যমে হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘আমার যে ৯২ হলো মনেই হয় না’। 

তাঁর ‘রঙ্গিলা বাঁশি’র সুরেলা গলা একটা গোটা প্রজন্মকে প্রেমে করতে শিখিয়েছিল। জীবনের এপিটাফে রোম্যান্টিসিজমের কাব্য রচনা করেছিলেন তিনি। তিনি কিন্তু মৃত্যুকে বড় ভয় পেতেন। মৃতদেহের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে রক্তচাপ বেড়ে যেত কয়েক গুণ। অতীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘চোখের সামনে মৃত্যু দেখলেই আমার প্রেশার বেড়ে যায়। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছেন বাড়ি বসে দুঃখ করুন। মৃতদেহের কাছে যাবেন না।’ 

জানুয়ারি মাসের ৮ তারিখ কোভিডে আক্রান্ত হয়ে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি হন কোকিলকণ্ঠী। সেই থেকে আস্তানা হয়েছিল আইসিইউ-তে৷ কখনও তিনি চিকিৎসায় সাড়া দিতেন৷ কখনও তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির খবর পাওয়া যেত৷ কিছুদিন আগে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন, লতা মঙ্গেশকরের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে৷ কিন্তু শনিবার সন্ধ্যার পর ফের তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। কিন্তু যখন চলছে সরস্বতী মূর্তির বিসর্জন, সেই আবহেই ‘সুরের সরস্বতী’ চিরতরে বিদায় নিলেন রবিবার সকাল ৮.১২ মিনিটে! জীবিত অবস্থায় কোভিড মুক্ত পৃথিবী দেখে যেতে চেয়েছিলেন মানুষটি। এক অর্থে সেই কোভিডই কেড়ে নিলো তাঁকে। 

একটা যুগ শেষ হলো। পঞ্চভূতে বিলীন হবে তাঁর নশ্বর দেহ। কিন্তু তিনি রয়ে গেলেন। বলে গেলেন, ‘লাগ যা গলে কে ফির ইয়ে হাসি রাত… হো না হো… সায়েদ ফির ইস জনম মে মুলাকাত হো না হো…’

/তারা/ 

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়