ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার চাকমা রাজবাড়ি

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৮, ২ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১২:৫৯, ২ নভেম্বর ২০২০
নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার চাকমা রাজবাড়ি

জীর্ণশীর্ণ কাঠামো, খসে খসে পড়ছে ইট বালির আস্তরণ। পুরো অবকাঠামো জুড়ে ঝোঁপঝাড় জঙ্গল। এটি এক সময়ের রাজবাড়ি।  যার সাথে জড়িত ৩শ বছরের ঐতিহ্য।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নে অবস্থিত এই রাজবাড়িটি ছিল চাকমা রাজত্বের রাজধানী। ঐতিহ্যের রাজবাড়িটি সংরক্ষণের অভাবে ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।

চট্টগ্রাম-কাপ্তাই সড়কপথে ৩৫ কিলোমিটার এবং চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক পথে ৪৫ কিলোমিটার পেরোলেই রাজানগরে এই রাজবাড়ির অবস্থান। 

রাঙ্গুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের নাম রাজানগর, রাজাভুবন, মোগলের হাট, রাজার হাট, রাণীর হাট, শুকবিলাস, কালিন্দিরাণী সড়ক ইত্যাদি নামকরণ হয়েছে এই চাকমা রাজত্বকে ঘিরেই।

প্রত্নতত্ত্ব গবেষক ও রাঙ্গুনিয়ার তরুণ রাজনীতিক এনায়েতুর রহিম রাইজিংবিডিকে বলেন, ১৭৩৭ সালে চাকমা রাজা সেরমুস্ত খাঁ এই অঞ্চলে রাজত্ব করেন। বান্দরবানের আলী কদমে ছিল তার রাজধানী। তার রাজ্যসীমা ছিল উত্তরে ফেনী, দক্ষিণে শঙ্খ নদী, পূর্বে লুসাই পাহাড় এবং পশ্চিমে নিজামপুর রাস্তা। সেই সময় আরাকানিদের অত্যাচারে তিনি মোগল নবাবের সঙ্গে মিত্রতা করেন। তখন চট্টগ্রামের নবাব ছিলেন জুলকদর খাঁ। তিনি সেরমুস্ত খাঁকে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনুমতি দেন। ১৭৫৭ সালে সেরমুস্ত খাঁর মৃত্যুর পর রাজা হন শুকদেব রায়। তিনি ছিলেন সেরমুস্ত খাঁর পোষ্যপুত্র। রাজা শুকদেব রায় আলীকদম ছেড়ে চাকমা অধ্যুষিত রাঙ্গুনিয়ার পদুয়ায় শিলক নদীর তীরে প্রাসাদ তৈরি করেন। নাম দেন শুকবিলাস (যেখানে বর্তমান তথ্যমন্ত্রীর গ্রামের বাড়ি)। সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেন রাজধানী। তার রাণীর নাম ছিল ছেলেমা। রাণীর নামানুসারে রাজপ্রাসাদের পশ্চিম দিকে একটি পুকুরের নামকরণ করা হয় ছেলেমা পুকুর। রাজা শুকদেব রায়ের সন্তান ছিল না। ১৭৭৬ সালে রাজার মৃত্যুর পর তাদের বংশধর শের দৌলত খাঁ রাজ্যভার নিয়ে রাঙামাটির রাজবাড়িতে রাজত্ব স্থানান্তর করেন। সেই থেকে রাঙ্গুনিয়ার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের রাজাভূবণ গ্রামের রাজপ্রাসাদ, সৈন্যশালা ও বন্দিশালা পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।

সেই থেকেই রাঙ্গুনিয়ার রাজ বাড়িটি অযত্ন-অবহেলায় ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হতে থাকে। বাড়িটি এখন লতাপাতা আচ্ছাদিত। ইট-সুরকি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল এই লোহাবিহীন অট্টালিকা। এটি ৫২ একর জায়গাজুড়ে। দেয়ালগুলো প্রস্থে দুই হাতেরও বেশি। দেয়ালগুলোতে এখন নানা রকম আগাছা ও লতা জন্মেছে। খসে পড়ছে ছাদ।  রোদ-বৃষ্টিতে প্রাসাদটির একেবারে নড়বড়ে অবস্থা। এরই মধ্যে প্রায় হারিয়ে গেছে প্রাসাদটির রাজদরবার, হাতিঘোড়ার পিলখানা, বিখ্যাত সাগরদিঘি, পুরাকীর্তি, বৌদ্ধ-বিহারসহ গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

গবেষক এনায়েতুর রহিম বলেন, ২০০৮ সালের মাঝামাঝিতে রাজা দেবাশীষ রায় সরকারিভাবে রাজবাড়ি এলাকা পরিদর্শনের সময় সংরক্ষণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখনো কোনো সংস্কার করা হয়নি। চট্টগ্রাম থেকে খুব বেশি দূরে নয় বলে এটিকে সংস্কার করে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় বলেও মতামত প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে সম্প্রতি খাগড়াছড়ি নৃতাত্ত্বিক সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট-এর অর্থায়নে রাঙ্গুনিয়া চাকমা রাজার রাজপ্রাসাদ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সমীক্ষা, মাপজোখ, অনুসন্ধান ও উৎখনন শুরু হয়েছে বলে জানালেন গবেষক এনায়েতুর রহিম। তিনি বলেন, বিলুপ্ত রাঙ্গুনিয়া চাকমা রাষ্ট্রের রাজধানী রাজানগরের রাজপ্রাসাদের সমীক্ষা শেষ হলে গড়ে উঠবে রয়েল চাকমা জাদুঘর, আদিবাসি ভিলেজ ও পর্যটন। সংস্কার ও সংরক্ষণ হবে ইতিহাসের সপ্তদশ শতাব্দীর চাকমা রাজত্বের হারানো গৌরব।

জানা যায়, বর্তমানে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগরের রাজপ্রাসাদের সমীক্ষা করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্বতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোকাম্মেল হোসেন ভূঁইয়া, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা, স্থপতি আশিষ চাকমাসহ প্রত্নসম্পদ বিশেষজ্ঞ টিম।  সাথে আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি টিম। সহযোগিতা করছেন স্থানীয় সমাজকর্মী আব্দুল মান্নান তালুকদার, হেলাল তালুকদার, রাজবংশের সদস্য রুমেল দেওয়ান।

চট্টগ্রাম/টিপু

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়