ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ছেলের ‘প্রতিবন্ধী কার্ড’ না পেয়ে ভিক্ষা করছেন মা 

রফিক সরকার, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৮, ৩০ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৭:১৪, ৩০ এপ্রিল ২০২১
ছেলের ‘প্রতিবন্ধী কার্ড’ না পেয়ে ভিক্ষা করছেন মা 

মায়ের আদরে আবেগাপ্লুত আওলাদ। চুমু খাচ্ছে মাকে।

সালমা বেগম।  স্বামী মারা গেছেন বহুদিন আগে। ঠিক কত বছর আগে মারা গেছেন, তাও মনে করতে পারেন না। সংসারে আপনজন বলতে শারীরিক-মানসিক প্রতিবন্ধী একমাত্র ছেলে আওলাদ। তাকে নিয়েই থাকেন গাজীপুরের চা-বাগান এলাকায়। কিন্তু ছেলের জন‌্য ‘প্রতিবন্ধী কার্ড’ পাচ্ছেন না তার নিজের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নেই বলে। ফলে বাধ‌্য হয়ে রাস্তায় নেমেছেন এই মা। পথ থেকে পথে ঘুরে ঘুরে করছেন ভিক্ষা।  বলছেন, এনআইডি-প্রতিবন্ধী কার্ড পেলে ছেলের জন‌্য আর এভাবে কষ্ট করতে হতো না। 

এই মা রাইজিংবিডিকে জানান, স্বামীর মৃত্যুর পর ভিটেমাটি হারিয়েছেন তিনি। এরপর জীবন বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে চলে এসেছেন গাজীপুরে। প্রায় এক যুগ ধরে আছেন চা-বাগান এলাকায়। এখানে ভাড়া করা একটি টিনশেড ঘরে থাকেন।  ঘর-ভাড়া, বিদ্যুৎ বিলসহ মাসে ১৫০০ টাকা গুনতে হয় তাকে। তিনি যখন বাইরে ভিক্ষা করতে যান, তখন ছেলেকে ঘরের ভেতরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। কারণ, ছেলে একা-একা বাইরে যেতে পারে না। কেবল নিজে যখন ঘরে থাকেন, তখনই ছেলের পায়ের শেকল খুলে দেন। 

আরো পড়ুন:

গাজীপুরের জয়দেবপুর রেল জংশনের পূর্ব পাশে ঐতিহ্যবাহী নাটমন্দির। এই মন্দিরের প্রধান ফটকের পাশেই দেখা মিললো সালমা বেগম ও তার ছেলে আওলাদের। পাকা মহাসড়ক ও ফুটপাথের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় রেল লাইনের একটি লোহার রড দেবে গেছে। এই রডের সঙ্গেই  শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে আওলাদকে। মাথার ওপরে প্রখর সূর্য। তবে, সেই তীব্র খরতাপের কিছুই যেন তাকে স্পর্শ করছে না। মুখে সব সময় ফুটে আছে হাসি। পাশে মা বসে আছেন। সামনে একটি বাটি। পথচারীরা দান করেন এই বাটিতে। এতেই তাদের সংসার চলে। 

তীব্র রোদে দুরন্ত হয়ে উঠতে চায় আওলাদ। মা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন

এখানেই কথা হয় সালমা বেগমের সঙ্গে।  সালমা বেগম বলেন,  ‘আমার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। আগে তো বুঝতাম না। তাই ভোটার হই নাই। এখন গাজীপুর থাকি। এই খানে ভোটার হমু কেমনে? তবে, এই খানের এক কাউন্সিলরের কাছে গেছিলাম। তিনি বলছেন, আবার ভোটার তালিকা যখন হবে, তখন ভোটার করবেন। ভোটার কার্ড ছাড়া প্রতিবন্ধী কার্ড পাবো না। কার্ড ছাড়া ভাতা পাওয়া যায় না।’

এই মা আরও জানান, ভিক্ষা করে প্রতিদিন যে টাকা পান, সেই অর্থ থেকে ঘর-ভাড়া, ছেলেকে নিয়ে আসা-যাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে, তা দিয়ে টেনে টেনে তাদের সংসার চলে। তবে, ছেলের একটি প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড আর তার নিজের জন‌্য একটি বিধবা ভাতা কার্ড থাকলে সংসারে সচ্ছলতা আসতো। তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলের জন‌্য ‘প্রতিবন্ধী ভাতা’ আর আমার জন‌্য বিধবা ভাতার কার্ড চাই। তাহলে অন্তত খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারমু।’’ 
 
গাজীপুর মহানগরীর চা-বাগান এলাকার ২৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শাহজাহান বলেন, ‘আসলে বেশ কিছুদিন আগে একবার ভোটার আইডি কার্ডের বিষয় নিয়ে সালমা বেগম আমার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু তখন ভোটার হালনাগাদের কাজ বন্ধ ছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, পরে যখন ভোটার হালনাগাদ শুরু হবে, তখন যেন তিনি যোগাযোগ করেন। কিন্তু এরপর  তারা আর কার্ডের বিষয়টি আমাকে বলেননি। বললে হয়তো সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে একটা ব্যবস্থা করা যেতো। তবে, যেহেতু আপনার কাছ থেকে বিষয়টি জানলাম, দেখি কী করা যায়।’  

শেকলবন্দি আওলাদের মাথায় হাত বুলিয়ে তার দুরন্তপনা থামানোর চেষ্টা করছেন মা   

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন গাজীপুর মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি মানবিক। আমাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসা দরকার। এছাড়া, প্রতিবন্ধী আওলাদকে ‘প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড’ দেওয়ার পাশাপাশি তার মা’কেও বিধবা ভাতার আওতায় আনা যেতে পারে। ’ 

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় গাজীপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক এসএম আনোয়ারুল করিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা শুনেছি। ইতোমধ্যে ডিসির সঙ্গে কথা হয়েছে। যেহেতু ওই প্রতিবন্ধী ছেলে ও তার মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, সেহেতু জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে দ্রুতই ব্যবস্থা নেবেন বলেও ডিসি জানিয়েছেন।’

এই বিষয়ে জানতে চাইলে গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম বলেন,‘এই বিষয়ে ইতোমধ্যে সমাজসেবা অফিসারকে বলা হয়েছে। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।’ 

/এনই/

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়