ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মাটির ঘরে ভাঙনের সুর 

রফিক সরকার, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২২, ২৬ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৩:২৯, ২৬ আগস্ট ২০২১
মাটির ঘরে ভাঙনের সুর 

মাটির ঘর, গাজীপুর

মাটির ঘর। গাজীপুরের ঐতিহ্য। কোনো এক সময় এই ঘর দিতে পারাটা ছিল গর্বের ব্যাপার। সমাজে একটি মাটির ঘর থাকা মানে তার অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জানান দেওয়া। আগে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই এই ঘর ছিল, এখন আর তেমনটি চোখে পড়ে না। হাতেগোনা যে কয়টি ঘর এখনো আছে, তাতে ভাঙনের সুর বাজছে। কিছু ঘর উইপোকাদের আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে।

বহুকাল আগে থেকেই মানুষ মাটির ঘরে বসবাস করে আসছে। মাটির সহজলভ্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশ আগ্রহী ছিল। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদার মণ্ডে পরিণত করে দুই-তিন ফুট চওড়া দেয়াল তৈরি করা হতো। ১০-১৫ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার ওপর খড় অথবা টিনের ছাউনি দেওয়া হতো। আর এত অল্প সরঞ্জামেই তৈরি হয়ে যেত শান্তির নীড়।

মাটির ঘরের অনেক বিশেষত্ব রয়েছে। শীত বা গরমে থাকার জন্য বেশ আরামদায়ক। শীতের দিনে ঘর থাকে উষ্ণ আর গরমের দিনে শীতল। তাই মাটির ঘরকে গরিবের এসিও বলা হয়ে থাকে। ঘরগুলো শুধু একতলা নয়, দোতলাও হয়ে থাকে। আর্থিক, সামাজিক অবস্থানের উপর নির্ভর করে ঘরগুলোকে দোতলায় রূপান্তর করা হতো। এসব ঘর তৈরি করতে কারিগরদের সময় লাগতো দেড় থেকে দু’মাস। সৌখিন গৃহিণীরা দেয়ালে বিভিন্ন রকমের আল্পনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতেন। আল্পনাগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ভেসে উঠতো। কাজের অভাবে পেশা বদল করেছেন বেশিরভাগ কারিগর। পুরো জেলা ঘুরলেও এসময় একজন কারিগরের দেখা মেলা ভার।

একসময় মাটির ঘর তৈরির কাজ করতেন কাপাসিয়ার দিঘিরপাড় এলাকার মো. রশিদ মিয়া (৬৫)। তিনি বলেন, আমি আমার বাবার কাছ থেকে এই কাজ শিখি। পরে নিজে একটি দল তৈরি করে পুরো জেলায় কাজ করতাম। এই পেশার সাথে প্রায় ৪০ বছর ধরে জড়িত। কাজের চাহিদা এখন আর নেই বললেই চলে। পুরো একটি বাড়ি শেষ করতে আমাদের প্রায় দেড় মাস সময় লাগত। দশ জনের একটি দল বিভিন্ন ভাগে ভাগ হয়ে কাজ করতাম। একটি বাড়িতে কাজ ধরলে একদিনে তিন ফিট দেয়াল তোলা যেত। দশ-বারোদিন শুকানোর ফাঁকে অন্য বাড়িতে কাজ শুরু করতাম। এভাবে মাসের প্রায় প্রতিদিনই কাজ থাকত। আমার মতো এমন ৪ থেকে ৫টা দল এই অঞ্চলে কাজ করতেন। পুরনো কারিগরদের কেউ কেউ মারা গেছেন আর বাকি যারা আছেন, তারা জীবনের তাগিদে অন্য কাজ শিখে নিয়েছেন। দালান-কোঠা বেড়ে যাওয়ায় এখন আর কেউ মাটির বাড়ি বানাতে আগ্রহী হয় না।

কাপাসিয়া এলাকার আরেক কারিগর মো. চাঁন মিয়া (৫৫)। তিনি জানান, তার পিতা একজন নামকরা মৃৎশিল্পী ছিলেন। তার বাবার কাছ থেকেই তার হাতেখড়ি। তিনি মাটির ঘরে কীভাবে আল্পনা করতে হয়, তা শিখেছিলেন।

বাবার স্মৃতিচারণ করতে করতে চাঁন মিয়া বলেন, প্রায় ৩০ বছর আগে একবার এক বাড়িতে আল্পনা করে দিয়েছিলাম। তখন বাড়ির মালিক আল্পনা দেখে খুশি হয়ে ১০০ টাকা বকশিস দিয়েছিলেন। আমার জীবনের প্রথম বকশিস ছিল ওইটা। আর এখন যন্ত্রপাতির যুগ আসার পরে মানুষ সব মেশিন দিয়েই করে নেয়। বাধ্য হয়ে পরিবার বাঁচাতে এখন রাজমিস্ত্রির কাজ করছি।

কালীগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া এলাকার মো. আশফাক আলী (৬৮) বলেন, আমার বাড়িতে চারটি মাটির ঘর ছিল। প্রতিটি ঘর করতে ওই সময়ে অনেক টাকা এবং পরিশ্রম লেগেছিল। যুগ পাল্টেছে দুই ছেলে প্রবাসী। আর্থিক অবস্থাও আগের থেকে সচ্ছল। তাই ছেলেরা আবদার করছে চারটি ঘর ভেঙে ইটের তৈরি দালান উঠাবে। তাই এই ঘরগুলো এখন ভেঙে ফেলার সময় এসে গেছে। মাঝে মাঝে খুব কষ্ট লাগে। প্রতিটি ঘরে আমার বাপ-দাদাদের স্মৃতি জড়িয়ে আছে। সময় তার নিজের নিয়মে সব পাল্টিয়ে দেয়। এক সময়ের আভিজাত্য অন্য সময়ের আবর্জনা। যুগ যুগ ধরে এমনটাই চলে আসছে ইতিহাস তার স্বাক্ষী। বড় বড় রাজপ্রাসাদের ধ্বংস স্তুপ এখন বিনোদন আর ইতিহাসের পাতাকেই সমৃদ্ধ করছে মাত্র এর বেশি কিছু নয়। মাটির ঘরও হয়তো একদিন বাঙালির ইতিহাসের পাতায় জায়গা নেবে কিন্তু এর ভেতরের অনুভূতি কতটুকু নাড়া দেবে, তা হয়তো সময়ই বলতে পারবে।

একই উপজেলার মোক্তারপুর ইউনিয়নের রামচন্দ্রপুর গ্রামের বৃদ্ধ মোহাম্মদ আলী ব্যাপারী। তার বাড়ির চার ভিটায় চারটি মাটির ঘর রয়েছে বলে জানান। তবে ছেলেরা অনেক বার তা ভেঙে ইটের তৈরি ঘর করতে চেয়েছিল, তিনি তা দেননি। তবে মাটির ঘর ঠিক রেখে তিনি রঙ কাজ করতে বলেছেন। আবার মূল ঘরের সাথে ইটের বারান্দাও দিয়েছেন। তবে এই মাটির ঘর একদিন থাকবে না বলেও তিনি আক্ষেপ করেন।

উপজেলার ঐহিত্যবাহী বিদ্যাপীঠ মসলিন কটন মিলস উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক আব্দুর রহমান আরমান বলেন, একদিন হয়তো পরবর্তী প্রজন্মকে মাটির ঘরের গল্প বললে তারা হাসবে। তখন তাদের যাদু ঘরে নিয়ে মাটির ঘরের ছবি দেখাতে হবে।

কালীগঞ্জ ‍উপজেলা নির্বাহী কর্তকর্তা মো. শিবলী সাদিক বলেন, মানুষ আভিজাত্যকে জানান দিতেই পুরনো মাটির ঘর ভেঙে নুতন নতুন দালান তৈরি করছেন। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব ছিল আভিজাত্যের পাশাপাশি কৃষ্টি-কালচার ও ঐহিত্যকে টিকিয়ে রাখা। তবে এটা ঠিক যে, একদিন এই মাটির ঘর দেখতে আমাদের পকেটের পয়সা খরচ করে টিকিট কেটে জাদুঘরে যেতে হবে।

/মাহি/ 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়