ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

৪ খুন: জগদল এখন আতঙ্ক-আহাজারির গ্রাম

শাহীন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:২৯, ১৬ অক্টোবর ২০২১   আপডেট: ১৯:০৩, ১৬ অক্টোবর ২০২১

মাগুরা জেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে জগদল গ্রামটি। দিগন্তজোড়া সবুজ মাঠ, মাঠজুড়ে কাচা-পাকা ধানের শীষ বাতাসে দুলছে। শান্ত পুকুরগুলোতে নির্বিঘ্নে চরে বেড়াচ্ছে হংস মিথুন। এমন শান্ত ও নির্মল পরিবেশ দেখে যে কারও মন ভরে যাবে। 

তবে গ্রামের এমন প্রশান্তিময় চেহারার সঙ্গে গ্রামবাসীর কর্মকাণ্ডের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। গতকাল (১৫ অক্টোবর) ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে চার জন খুন হয়েছেন। চারজনের মধ‌্যে আপন দুই ভাই, চাচাতো ভাই ও একজন প্রতিবেশি রয়েছেন। 

প্রশান্তিময় জগদল গ্রামের নির্মল বাতাস এখন স্বজন হারানোর আহাজারিতে ভারি হয়ে রয়েছে। গ্রামজুড়ে আতঙ্ক আর ভয়। পুরো গ্রাম পুরুষ শূন্য। ঘটনার প্রেক্ষিতে আবারও হামলা-লুটের আতঙ্ক বিরাজ করছে। গ্রামবাসী গৃহস্থালীর মালপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। গ্রামের সড়ক আর মোড়ে মোড়ে পুলিশের টহল।

শনিবার (১৬ অক্টোবর) সরেজমিনে জগদল গ্রামে গিয়ে এমন চিত্রই দেখা গেছে।

নিহতদের স্বজন, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে— দ্বিতীয় তফসিলে মাগুরা সদর উপজেলার জগদল ইউনিয়ন পরিষদে আগামী ১১ নভেম্বর ভোট গ্রহণ হবে। এই নির্বাচনকে ঘিরে মাগুরা সদর উপজেলায় ৮ নম্বর জগদল ইউনিয়ন পরিষদের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকরা শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে সংঘর্ষে জড়ায়। এতে চার জন নিহত হন।

সংঘর্ষে নিহতরা হলেন- জগদল গ্রামের লুৎফর রহমান মোল্যার ছেলে ইমরান মোল্যা (২৫), ফজলে করিম মোল্যার ছেলে রহমান মোল্যা (৫৫), শাহাবাজ উদ্দিনের ছেলে কবির হোসেন মোল্যা (৫০) ও তার আরেক ছেলে সবুর হোসেন মোল্যা (৫২)।

জানা গেছে— জগদল ইউপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল ইসলাম ও একই এলাকার মাতবর সবুর মোল্লার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিরোধ চলছিল। আগামী ১১ নভেম্বর ইউপি নির্বাচনে একই ওয়ার্ডে সৈয়দ হাসান নামের এক ব্যক্তি সদস্যপদে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন। সৈয়দ হাসানকে সমর্থন দেয় সবুর মোল্লার পক্ষ। বিষয়টি নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েক দিন ধরে উত্তেজনা চলছিল। গতকাল দুপুরের পর জগদল গ্রামের সৈয়দ রূপাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের কাছে দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে চার জন নিহত হন। উভয় পক্ষই স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত।

এছাড়া সংঘর্ষে উভয়পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন। এদের মধ‌্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দুই জনকে ফরিদপুর মেডিক‌্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা মাগুরা ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। 

এদিকে এ ঘটনার পর থেকে গ্রামজুড়ে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। গ্রামবাসী গৃহস্থালী সামগ্রী ও গবাদিপশু অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। সবার চেহারায় আতঙ্কের ছাপ। পুরো গ্রামপুরুষ শূন‌্য। বাড়িঘর পাহারা দিচ্ছেন বৃদ্ধা ও আত্মীয় স্বজন।

জগদল মধ্যপাড়ার রোকেয়া বেগম, মাঝি পাড়ার আশরাফ আলী ও দমদম পাড়ার আজিজ মিয়াকে ভ‌্যানে করে মালামাল সরিয়ে নিতে দেখা গেলো। 

তারা বলেন, ‘অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা জানি, ঘটনার বদলা নিতে আজ হোক-কাল হোক আবার সংঘর্ষ হবেই। আমারা কোনো অপরাধের যুক্ত নই। তারপরও জান-মাল বাঁচাতে পালাতে হচ্ছে। গ্রামে শান্তিতে বসবাসের কোনো পরিবেশ নেই।’

এদিকে মোল্যা পাড়ায় গিয়ে দেখা যায়— নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে পুরো এলাকা ভারি হয়ে আছে। একবাড়ির তিন জন ও এ পাড়ারই আরেকজনসহ মোট চারজনের মৃত‌্যু হয়েছে। তাদের স্বজনদের কান্নায় গুমোট হয়ে আছে পরিবেশ। কয়েকশ’ প্রতিবেশী ও স্বজনদের ভিড়ে পরিবেশের আড়ষ্টতায় মন খারাপ হয়ে উঠবে যে কারও।

বাড়ির উঠানে তিনটি খাটিয়া সাজিয়ে রাখা হয়েছে। ময়না তদন্ত শেষে রিপোর্ট দিলে লাশ ফিরে পাবেন স্বজনরা। এরপর দাফন। সেই অপেক্ষায় রয়েছেন স্বজনরা। 

নিহত কবির ও সবুরের ভাই হবিবর মোল্যা বলেন, ‘আমার ভাই কবির, সবুর ও চাচাতো ভাই রহমানকে আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিরোধ মেটানোর কথা বলে নজরুল মেম্বর তাদের শালিসে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে বর্তমান চেয়ারম্যান ও প্রার্থী রফিকুল ইসলামের উপস্থিত থাকার কথা ছিল। সেখানে তাদের ঠান্ডা মাথায় কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়েছে।’

নিহত সবুর মোল্লার স্ত্রী মেরিনা বেগমের অভিযোগ, প্রতিপক্ষ নজরুল ইসলাম ও তার সমর্থকরা প্রকাশ্যে মেরিনার স্বামীকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে।

নিহত ইমরানের বাড়ি গিয়ে দেখা গেলো সেখানেও শোকের মাতম। মাত্র সাত মাস আগে বিয়ে করেছেন ইমরান। তার স্ত্রী মাছুরা বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। তার বুকফাটা আহাজারি যে কারও চোখ সজল করে তুলবে।

এদিকে অভিযোগের বিষয়ে জানতে নজরুল ইসলাম ও সৈয়দ হাসানের মোবাইলে একাধিকবার ফোন দিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে। তাছাড়া এলাকায়ও তাদের কোনো খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।

জগদল ইউপির চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম মোবাইল ফোনে বলেন, ‘দুই পক্ষই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তবে আধিপত্য নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল। নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়া নিয়ে সেই বিরোধ চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে।’

মাগুরা সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চার জনকে আটক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। তারা এখন ময়না তদন্ত ও লাশ দাফনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিচ্ছে।’

মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তার ও দলাদলিকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানতে পেরেছি। রাজনীতি বা নির্বাচনের সঙ্গে এর যোগসূত্র আছে কি না, তাৎক্ষণিকভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে রাখা হয়েছে। এলাকায় পরবর্তী সংঘর্ষ এড়াতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ধরতে অভিযান অব‌্যাহত রয়েছে।’

মাগুরা/সনি

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়