ঢাকা     সোমবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৭ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বান্দরবানে বনমোরগ-মুরগির খামার

চাইমং মারমা, বান্দরবান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:০৪, ৮ অক্টোবর ২০২৩  
বান্দরবানে বনমোরগ-মুরগির খামার

ঘরের চারপাশে বেড়া দিয়ে বিভিন্ন গাছগাছালির লাগিয়ে বনের পরিবেশ তৈরি করে অভিনব পদ্ধতিতে বনমোরগ ও বনমুরগির খামার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন হ্লাশোয়ে অং মারমা (৪০) ও শোয়ে মে চিং (৩৬) মারমা দম্পতি।

বান্দরবান সদর থেকে প্রায় ২২-২৩ কিলোমিটার আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে যেতে হবে রাজবিলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডে মেওয়া পাড়ায়। এ পাড়ায় দেখা মিলবে অভিনব কৌশলে বনমোরগ ও মুরগির খামারের দৃশ্য।

এলাকাবাসীরা জানান, বনমোরগ ও বনমুরগি একমাত্র গহীন বনে থাকে। পোষ মানার তো দূরের কথা, মানুষের আওয়াজ শোনামাত্রই উড়াল দেয়। সেই বনের প্রাণিকে ঘরে এনে পোষ মানিয়ে পালন করার দৃশ্য দেখে গ্রামে ও আশপাশে এলাকার মানুষেরা অবাক হয়েছেন। এই দম্পতির নাম এখন এলাকার সবার মুখে মুখে। 

এই দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, লেখাপড়া না জানার কারণে বাংলাও বলতে পারেন না এই দম্পতি। হাস্যোজ্জ্বল মুখে মারমা ভাষায় বলেন, ‘আজ থেকে ৫ বছর আগে গহীন পাহাড়ে জুম কাটতে যাওয়ার সময় ৬-৭টি ডিমসহ একটি বনমুরগির বাসা দেখতে পাই। সেখান থেকে তিনটি ডিম নিয়ে এসে ঘরে দেশি মুরগি ‘তা’ দিতে থাকা বাসায় রেখে দেই। সেখান থেকে ১টা ডিম পঁচে যায়, আর দুটো ডিম থেকে একটি মোরগ ও একটি মুরগির বাচ্চা ফোটে। এরপর তারা দেশি মুরগির মায়ের সঙ্গে বড় হতে থাকে। এক দিন দেখলাম, বনের মুরগির বাচ্চা দুটো প্রায় মৃত অবস্থায় ঘাসে পড়ে আছে। বাচ্চা দুটোকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করি। পাহাড়ি লতা-পাতা থেকে শুরু করে বনৌষধি প্রয়োগ করি। কোনোভাবে উন্নতি হয়নি। কোনো উপায় না পেয়ে ধানের শক্ত দানা খাওয়াতে লাগলাম এবং পাশের জঙ্গলে গিয়ে পিঁপড়ের ডিমসহ হরেক রকম পোকা-মাকড় এনে খাওয়ানোর পর দেখি অনেকটা সুস্থ হয়ে হাঁটা-চলা করছে। আর ছোট-ছোট পাখাগুলোও নাড়াচাড়া করছে। তখন আর বুঝতে বাকি থাকল না, দেশি মুরগির মতো নরম ভাতের সঙ্গে ভূষী মিশিয়ে দিয়ে খাদ্য দিলে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন থেকে তাদের নিয়ে একটু আলাদা যত্ন করা শুরু করি। ঘাসের ফড়িং, পোকা-মাকড়, আর ধানের দানা দিলে খুব দ্রুত খেয়ে ফেলে। এরপর তাদের আলাদাভাবে খাবার দিতে শুরু করি। এভাবে চলতে চলতে গত পাঁচ বছরে দেড়শোর মতো বন মুরগি হয়েছে।’ 

বর্তমানে তার খামারে ২২টি মুরগি পরিপক্ক (ডিম দেওয়ার উপযুক্ত), ১৩টি পরিপক্ক মোরগ, ২টি শিকারি মোরগ, ১৭টি বাচ্চাসহ তিনটি মা, ৯টি ডিম নিয়ে ‘তা’ দেওয়া মা আছে একটি। পরিপক্ক মোরগ প্রতিটি আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকায়, আর মুরগি এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা করে বিক্রি করেন বলে জানান হ্লা শোয়ে অং মারমা। এ বছরে ৮টি মুরগি ও ৫টি মোরগ বিক্রি করেছেন। এখনো বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার করা আছে বলেও জানান।   

বনমোরগ ও বনমুরগির ওজনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওজন দেশি মুরগির মতো নয়। এদের সাইজ দেশি মুরগির তুলনায় ছোট, ওজনও কম। পরিপক্ক মোরগের ওজন সর্বোচ্চ ৭০০-৮০০ গ্রাম হয়। আর মুরগির ওজন হয় ৬০০-৭০০ গ্রাম। তবে মা মুরগির ক্ষেত্রে ডিম থাকলে ওজন একটু বেশি হতে পারে বলে জানান তিনি।

হ্লা শোয়ে অং মারমা আরও বলেন, এই মুরগি বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন এবং বেশ ভালো দামও পাওয়া যায়। ছোট বাচ্চা, মাঝারি ও বড় মিলে প্রায় ৫৫টি মুরগির জন্য প্রতিদিন ৬ কেজির মতো ধানের প্রয়োজন হয়।  

এই বনের মুরগিকে মারমা ভাষায় ‘তহক্রাক’, আর যখন পোষ মানিয়ে ঘরে পালন করা হয় তখন সেই মুরগিকে ‘তোয়াইং গ্যাং’ বা ‘তইক ক্যাং’ বলে। পোষমানা বনের মোরগের গঠন, আকার-আকৃতি, ডাক সবই এক এবং অভিন্ন। তাই পাহাড়ে অন্য বন মোরগকে ফাঁদে ফেলে শিকার করার জন্য ‘তোয়াইং গ্যাং’ বা ‘তইক ক্যাং’ কে ব্যবহার করা হয়।

যেহেতু পাহাড়-জঙ্গলে বনমুরগি অনেক কমে গেছে, আবার এদের চাহিদাও অনেক। তাই দেশি মুরগির মতো এই বনমুরগির বাণিজ্যিক উপায়ে বড় আকারে খামার বানিয়ে চাষ করার স্বপ্ন দেখছেন এই দম্পতি। 

বান্দরবান বন বিভাগের বন্যপ্রাণি বিষয়ক বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রফিকুল ইসলাম চৌধুরী মোবাইল ফোনে জানান, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরাসরি বন থেকে বন্যপ্রাণি ধরে নিয়ে এসে বাড়িতে রাখলে বা পোষমানার চেষ্টা করলে সেটা বন্যপ্রাণি নিধন আইনে অপরাধী হবেন। যে বন্য মুরগির কথা বলা হয়েছে, সেটির ক্ষেত্রে মুরগিগুলো একপ্রকার গৃহপালিত বলা যেতে পারে। আমার মতে, তিনি নতুন কিছু উদ্ভাবন করেছেন। তাঁর ঘরে থাকা ৫০-১০০টা মুরগি যদি ঘরেই উৎপাদন হয়ে থাকে, তাহলে সেটা বন্য আইনে অপরাধী হবেন না। বরং তাকে একজন ভালো উদ্যোক্তা বললেও ভুল হবে না।

এ ব্যাপারে জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. পলাশ কান্তি চাকমা জানান, দেশি মুরগির মতো বনমোরগেরও রোগ বালাই কম হয়। মাঝে মধ্যে রাণিক্ষেত, কলেরা, ফক্স এ রোগগুলো হয়ে থাকে। তবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে এই রোগ থেকেও প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে। খামারি যদি প্রাণি সম্পদ কার্যালয়ে এসে যোগাযোগ করেন, তাহলে চিকিৎসা ও পরিচর্চার ক্ষেত্রে পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করবেন বলে জানান তিনি। 

/বকুল/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়