ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

কক্সবাজারে পর্যটকের জোয়ার, সেন্টমার্টিনে ভাটা

তারেকুর রহমান, কক্সবাজার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫২, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪  
কক্সবাজারে পর্যটকের জোয়ার, সেন্টমার্টিনে ভাটা

সেন্টমার্টিন প্রায় পর্যটকশূন্য

দীর্ঘদিন পর্যটক খরায় ছিল কক্সবাজার। জাতীয় নির্বাচনসহ নানা কারণে ভরা মৌসুমের শুরুতেও কম পর্যটক এসেছেন। কিন্তু মৌসুমের শেষ মুহূর্তে পর্যটকের ঢল নেমেছে এ পর্যটনশহরে। গত সাপ্তাহিক ছুটির দিনে লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটেছে। বিপুল সংখ্যক পর্যটকের আগমনে হোটেল মালিক ও সংশ্লিষ্ট পর্যটকসেবীদের মাঝে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে। এখন পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেলের কোনো কক্ষ খালি নেই বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কাসেম সিকদার। 

তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মার্চের শেষ পর্যন্ত পর্যটন মৌসুম থাকবে বলে আশা করছি। নানা সংকটময় পরিস্থিতির কারণে এতদিন কক্সবাজারে পর্যটক আসতে পারেনি। এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে বিপুল সংখ্যক পর্যটক আসতে শুরু করেছে। এতে করে ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছে পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। আমরা পর্যটকদের স্বাগত জানাই। তবে পর্যটকদের অনুরোধ থাকবে অনলাইনে যেন তারা হোটেল রুম বুকিং দেন।’

কক্সবাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপচারিতা হয়। তারা বলছেন, ‘এ মাসে প্রচুর পর্যটকের আগমন ঘটেছে কক্সবাজারে। মাস শেষে আরও পর্যটক আসবে বলে আশা করছি। অন্তত এবার ভালো মতো ব্যবসা করতে পারছি। অনেক দিন ক্ষতিতে ছিলাম। সেই ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখতে পাচ্ছি।’

টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় দেশের অন্যতম পর্যটন খাত সেন্টমার্টিনে ভরা মৌসুমেও পর্যটকে ভাটা পড়েছে। এতে পর্যটনখাত হুমকিতে বলে জানিয়েছেন দ্বীপটির একাধিক ব্যবসায়ী। টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে সমস্ত পর্যটন জাহাজ চলাচল বন্ধ করে দেয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন তারা।

শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারে চলমান সংঘাতের মধ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণ দেখিয়ে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল সাময়িক বন্ধ করেছে জেলা প্রশাসন।

সেন্টমার্টিন মারমেইড রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ তৈয়ব উল্লাহ বলেন, ‘এই মাসে ২১ ফেব্রুয়ারিসহ বন্ধের সময়ে সেন্টমার্টিনে পর্যটকের যে চাপ আশা করেছিলাম, তা আর হয়ে ওঠেনি। টেকনাফ থেকে যে সকল পর্যটকের আসার কথা ছিল, এ রুট দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বুকিং করা রুম বাতিল করছেন। এতে করে আমাদের ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এ সময়ে কম বাজেটে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ সেন্টমার্টিনে বেড়াতে আসে। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন এলে খরচ ও সময় কম হয়, তাই অনেক মধ্যবিত্ত পর্যটক কম সময় ও খরচের মধ্যে টেকনাফ ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে রওনা দেন। কিন্তু এ ঘাট থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হওয়ায় বহুগুণ পর্যটক কমেছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। আমার নিজের হোটেলে ১০০, ১৫০ ও ৫০ জনের বুকিং দেয়া ১৫টি গ্রুপ বুকিং বাতিল করেছে। অন্যান্য সময় সেন্টমার্টিনের শতাধিক হোটেলে হাজার হাজার পর্যটক থাকে। এখন পুরো দ্বীপ মিলে এক হাজার পর্যটক পেতেও কষ্ট হচ্ছে। শিগগিরই টেকনাফ ঘাট থেকে জাহাজ চলাচল চালু না করলে সেন্টমার্টিনের পর্যটনখাত ধ্বংস হয়ে যাবে।’

সেন্টমার্টিন বিচ ইকো রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন শুভ বলেন, ‘সেন্ট মার্টিনের নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্বীপের একজন ভ্যানগাড়ি চালক আগে দৈনিক ২ হাজার টাকা আয় করতে পারতেন। অথচ এখন তার হাতখরচের টাকা তুলতেও কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সবকটি জাহাজ চলাচল করলে ভরা মৌসুমের ছুটির দিনে দ্বীপে ৭ থেকে ৮ হাজার পর্যটক আসতে পারে। ফলে পর্যটন ব্যবসায় ভালো হয়। কিন্তু এখন মাত্র ৩টি জাহাজে এক থেকে দেড় হাজার পর্যটক আসছে। এতে সবক্ষেত্রে লোকসান গুনতে হচ্ছে। হোটেল-রেস্টুরেন্টে ১০-১৫ জন স্টাফের বেতনের টাকাও তুলতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যবসায়ীরা।’

তিনি আরও বলেন, ‘টেকনাফ থেকে জাহাজ এলে সেন্টমার্টিনে যারা ঘরোয়া পরিবেশে আবাসিক ও রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা করেছে, তাদের মোটামুটি একটা আয় থাকে। কিন্তু কক্সবাজার থেকে জাহাজ আসাতে দ্বীপের বেশির ভাগ হোটেল প্রায় অচল।’

সেন্টমার্টিন সী প্রবাল বিচ রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী আবদুল মালেক বলেন, ‘নানা সমস্যার কারণে সেন্টমার্টিনের পর্যটনখাত হুমকিতে পড়েছে। গত বছর গেল নাব্যতা সংকটে। নির্বাচনে গেল কয়েক মাস। সামনে মাহে রমজান, তার পরে ভরা বর্ষা এ অবস্থায় অর্থনৈতিকভাবে ধসে পড়ছে ব্যবসা। এমন হলে টিকে থাকা কঠিন হবে।’

এদিকে পর্যটকাবাহী জাহাজ সিন্ডিকেটের কারণে সেন্টমার্টিনের পর্যটন ব্যবসায় ধস নামছে বলে মনে করছেন দ্বীপটির বেশিরভাগ ব্যবসায়ীরা। অদৃশ্য শক্তি ব্যবহার করে টেকনাফ ঘাট থেকে জাহাজ বন্ধ করে কক্সবাজার ঘাট থেকে ৩টি জাহাজ চলাচলের অনুমতিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না তারা। তাদের দাবি, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের প্রভাব টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে নেই। সংঘাতকে কেন্দ্র করে সুবিধা নিয়েছে অসাধু কিছু জাহাজ ব্যবসায়ী। বিভিন্ন সংকটে তারা বার বার টেকনাফ-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধে ষড়যন্ত্র করে আসছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ব্যবসায়ীর অভিযোগ, টেকনাফ ঘাট থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধের পর কক্সবাজার থেকে যে জাহাজগুলো সেন্টমার্টিন যাচ্ছে, তারা ভাড়া বাড়িয়ে পর্যটক হয়রানি করছে। অথচ ইনানীতে নতুন জেটি হওয়ায় অন্তত ২ ঘণ্টা সময় বেচেছে। তারপরও তারা বিভিন্ন হারে ভাড়া বাড়িয়েছে। এই লাভের জন্য মূলত টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ করতে চায় তারা।

সেন্টমার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহিম জিহাদী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকার কারণে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পর্যটক অনেক কম। অথচ এই ভরা মৌসুমে দ্বীপে দৈনিক ৪ থেকে ৫ হাজার পর্যটক থাকার কথা। এখন পর্যটক আছে হাজার খানেক। এছাড়াও টেকনাফ জেটিঘাট থেকে জাহাজ চলাচল না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপ সেন্টমার্টিন বেড়াতে আসতে পারছে না। কারণ কক্সবাজার থেকে এলে খরচ অনেক বেশি। এতে করে সেন্টমার্টিন ছাড়াও প্রতিটি পর্যটন খাতে ধস নামতে শুরু করেছে। শিগগিরই টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচল চালু না করলে সেন্টমার্টিনের মানুষ না খেয়ে মরে যাবে।’

সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ এই দুই মাস সেন্টমার্টিনে ব্যবসায়ের উপযুক্ত সময়। এ সময় যা আয় হয় তার উপর চলে বছরের অন্যান্য মাসগুলো। কিন্তু হঠাৎ করে টেকনাফ থেকে জাহাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই দ্বীপের নিম্নআয়ের মানুষ থেকে শুরু করে প্রতিটি ব্যবসাক্ষেত্রে ক্ষতির সম্মুখিন হতে হচ্ছে। কারণ কক্সবাজার থেকে ৩টি জাহাজে যে পর্যটক সেন্টমার্টিনে আসবেন তা ব্যবসা খাতে পর্যাপ্ত না।’

কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. ইয়ামিন হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, উদ্ভূত সীমান্ত পরিস্থিতিতে টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌপথে শনিবার (১০ ফেব্রুয়ারি) থেকে সাময়িকভাবে জাহাজ চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌপথে প্রয়োজনীয় অনুমোদন সাপেক্ষে জাহাজ চলাচল করবে। 

কবে নাগাদ টেকনাফ ঘাট থেকে আবারও ভ্রমণ করা যাবে— এমন প্রশ্নে ইয়ামিন হোসেন বলেন, ‘এটি সাময়িক সিদ্ধান্ত এবং পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
 

/বকুল/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়