ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মায়ের আহাজারি

আমার বাবারে মারলো ক্যান, কার কাছে বিচার দিমু?

বেলাল রিজভী, মাদারীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৪, ৩০ জুলাই ২০২৪   আপডেট: ১৪:০৫, ৩০ জুলাই ২০২৪
আমার বাবারে মারলো ক্যান, কার কাছে বিচার দিমু?

‘আমি ক্যামনে এই যন্ত্রণা সহ্য করবো। আমার তো একটাই মানিক আছিল, খোদা। আমার এই সন্তান ছাড়া তো আর কেউ নাই। কষ্ট কইরা মানুষ করলাম, পড়াইলাম, লেখাইলাম, এখন কী পাইলাম, মানুষের হাতে গুলি খাইয়া আমার মানিকের মরতে হইলো, কী দোষ ছিল ওর। মারলো ক্যান? কার কাছে বিচার দিমু? আমার বাবারে তোমরা আইনা দাও। আমি তো মা, আমি তো সহ্য করতে পারছি না। আমি ক্যামনে বাঁচমু, হায় আল্লাহ।’ 

বিলাপ করছিলেন মাদারীপুর সদর উপজেলার খোয়াপুর ইউনিয়নের চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রামের নাজমা বেগম। তার ছেলে নাজমুল হাসান (২১) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে কোটা সংস্কার আন্দোলনে। 

নাজমুলের পরিবার প্রায় একযুগ আগে থেকে ঢাকার আফতাবনগরে ভাড়া থাকতেন। ওর মা নাজমা বেগম বনশ্রী এলাকার ফরাজী হাসপাতালে চাকরি করতেন। অভাবের সংসারে এক বছর আগে মায়ের সাথে একই হাসপাতালে চাকরি নেন নাজমুল। অনার্স প্রথম বর্ষে পড়ালেখার পাশাপাশি হাসপাতালে পার্ট টাইম কাজ করতেন। মাস শেষে মা-ছেলের যা রোজগার হতো তা দিয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। 

১৯ জুলাই শুক্রবার বাসা থেকে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান নাজমুল। 

নিহত নাজমুল কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার চাপাতলি এলাকার সৈয়দ আবুল কায়েসের ছেলে। তবে নাজমুল তার মায়ের সঙ্গে নানা বাড়ি মাদারীপুর সদর উপজেলার চরগোবিন্দপুর উত্তরকান্দি গ্রামের মাতুব্বরবাড়ি থাকতেন। মাদারীপুরই ছিল নাজমুলের স্থায়ী ঠিকানা। 

নাজমুলের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাতুব্বরবাড়ি জামে মসজিদের পাশে কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে নাজমুলকে। বাড়ির সবাই শোকাহত, সবার মাঝেই আতঙ্ক।

নাজমা বেগম বলেন, ‘মা-ছেলে একলগে কাম করতাম, ঘর ভাড়া দিতাম, সমান সমান থাকতাম, বাবজান আমারে কইতো, ‘‘মা তোমার আর কষ্ট করতে হইবে না। আমি টাকা জমিয়ে বিদাশ জামু, আপু চাকরি করবো, তোমার আর কষ্ট থাকবো না। এগুলো মনে পড়লে আমার বুকের মধ্যে যে ক্যামন করে তা কইতে পারতাছি না। সরকারের কাছে একটা জিনিসই চাই, আর কোন মার বুক যেন খালি হয় না।’

মা নাজমা বেগম চোখের সামনে তার ছেলেকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন। সেই করুণ পরিস্থিতির কথা বলতে গিয়ে নাজমা বেগম আরও বলেন, ‘আমার চোখের সামনে সব ঘটনা ঘটলো। কিন্তু কোন চেষ্টাতেই আমার ছেলেডারে বাঁচাইতে পারলাম না। চোখের সামনে বাপজান আমার মইরা গেলো। বিজিবি ওরে গুলি করে মারছে। আমার বাবায় তো কোন ঝায়ঝামেলায় থাকতো না। দেশের কোনো ক্ষতি করে নাই। তাহলে ওরে কেন গুলিতে জীবন দিতে হইলো?

নাজমুলের পরিবারের সূত্র জানায়, ঘটনার দিন দুপুরের খাবার খেয়ে নাজমুল আফতাবনগর থেকে বনশ্রী ফরাজি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। এই হাসপাতালে পার্ট টাইম ফিজিওথেরাপিস্ট হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ঢাকায় ওই দিন কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। তখন নাজমুল সংঘর্ষ এড়াতে গুদারাঘাট এলাকা দিয়ে বনশ্রীর দিকে হেটে যাচ্ছিল। গুদারাঘাটের সেতুতে ওঠার পরেই গুলিবিদ্ধ হন নাজমুল। পরে কয়েকজন আন্দোলকারী শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ নাজমুলকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে গুদারাঘাট এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন। পরের ওই দিন সন্ধ্যায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় নাজমুল মারা যায়। পরে তার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে করে ওই দিন রাতেই তার মাদারীপুরে আনা হয়। পরে নাজমুলকে জানাজা শেষে নানা আব্দুল রহমান মাতুব্বরের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

নাজমুলের বড় বোন তানজিলা আক্তার বলেন, ভাইডা যে এভাবে মরতে হইবে, এটা এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। বুকের ভিতরটায় যে কি হচ্ছে তা কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমার ভাইকে কেন গুলি করে মারা হলো, এটার বিচার আমি আল্লাহ ছাড়া কার কাছে দিবো?’

নাজমুলের খালাত ভাই সুমন কাজী বলেন, নাজমুল গত বছর ঢাকা ইমপিরিয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে অর্নাস প্রথম বর্ষে পড়তো। পড়ালেখার পাশাপাশি নাজমুল একটি বেসরকারি হাসপাতালে পার্ট টাইম কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা পেতো। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাতে তার মাকে সহযোগিতা করতেন নাজমুল।

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মারুফুর রশীদ খান বলেন, ‘সহিংসতায় অনেকেই মারা গেছেন। তবে কোন স্থানের সেই তথ্য আমাদের কাছে আপাতত নেই। তবে নিহতের পরিবার কোন সহযোগিতার জন্য আমাদের কাছে আবেদন জানালে আমরা তাদের সাধ্যমত সহযোগিতা করবো।’

/টিপু/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়