ঢাকা     সোমবার   ০৭ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২২ ১৪৩১

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

‘ছেলের কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে’

জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪   আপডেট: ২৩:০৪, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪
‘ছেলের কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ঢাকার মিরপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত পারভেজের পরিবার

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ধন্যপুর গ্রামের মো. নবী উল্যা ও ফাতেমা বেগমের ছেলে পারভেজ। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। বাবা মানসিক রোগী হওয়ায় আর্থিক কারণে চতুর্থ শ্রেণিতেই পড়ালেখা শেষ হয়ে যায় তার। এরপর এলাকায় বিভিন্ন কাজকর্ম করে পরিবারের হাল ধরেন। কষ্টের চেয়ে উপার্জন কম হওয়ায় মাত্র ১২ বছর বয়সে পারভেজ চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। মিরপুর ১০ নম্বরের সেনপাড়া এলাকার একটি থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতেন তিনি। 

গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ নম্বর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন পারভেজ। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। সেদিন রাতেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে তার মাথায় অস্ত্রোপচার (অপারেশন) করা হয়। সেখানে ১ মাস ৮ দিন থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর মারা যান পারভেজ। সন্তান হারিয়ে এরপর থেকেই স্তব্ধ হয়ে গেছেন মা ফাতেমা বেগম। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটচ্ছে পরিবারটির।

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) পারভেজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাটির মেঝে এবং মরিচা ধরা ভাঙা টিনের জীর্ণ ঘরে নির্বাক বসে আছেন পারভেজের বাবা-মা। ছোট দুই ভাই এখনো বুঝে উঠতে পারেনি কখনোই ফিরবে না তাদের বড় ভাই। আদর করে টেনে নেবে না কাছে। 

আরো পড়ুন:

পারভেজের মা ফাতেমা বেগম  বলেন, ‘আমার ছেলের বয়স যখন ১২ বছর, তখন সংসারের অভাব-অনটন দেখে সে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতো। তার টাকায় আমাদের সংসার ও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা চলতো। সে মারা যাওয়ায় পরিবারে আর কেউ উপার্জনের মতো রইল না। স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোনো রকম ভাঙা ঘরে থাকি। এখন সংসার চলছে না। মানুষের সহযোগিতায় কোনো রকম চলে। আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই, যাতে আমি স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি। দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন। বড় ছেলেটা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। তার মৃত্যুতে স্বামী-সন্তানদের নিয়া নিঃস্ব হয়ে গেলাম। ছেলের কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে।’ 

নিহত পারভেজের বাবা নবী উল্যা মানসিক রোগী। গুছিয়ে কথা বলতে পারেন না তিনি। তারপরও এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেটা গুলি খেয়ে মারা গেছে। যদি বাড়িতে থাকতো, তাহলে হয়তো মরতো না।’ 

পারভেজের বোন নাহিদা আক্তার বলেন, ‘আমার ভাই যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি, আমি তখন ওর সঙ্গে দেখা করতে যায়। দেখলাম, সে কথা বলতে পারছে না। আমার হাত ধরে কথা বলার চেষ্টা করছিল। ইশারা দিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। আমি কিছুই বুঝলাম না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের আয়েই আমাদের সংসার চলতো। তাকে হারিয়ে এখন আমরা নিঃস্ব।’ 

নিহত পারভেজের চাচাতো ভাই আরাফাত হোসেন বলেন, ‘পারভেজ বাড়িতে আসলে আমার সঙ্গে বেশি চলতো। গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখন তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ছিলো। দেখা আর হলো না। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। এই আক্ষেপটা সারাজীবন থেকে যাবে। তার রুজির ওপর তাদের সংসার চলতো। এখন এই পরিবারটির হাল ধরবে, এমন কেউ নেই। তার বাবাও মানসিক রোগী।’ 

চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত গ্রাম পুলিশের সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার চাকরি এই ওয়ার্ডে প্রায় ৯ বছর। আমি সবসময় দেখতাম তাদের (পারভেজের পরিবার) অনেক অভাব-অনটন। ছেলেটা অল্পবয়স থেকেই কাজ করতো। তার আয়ে সংসার চলতো। বাবা মানসিক রোগী হওয়ায় কাজকর্ম করতে পারেন না। পারভেজ মারা যাওয়ার পর এলাকার লোকজন এবং স্থানীয় মেম্বার তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করছে। এখন যদি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসেন ও সহযোগিতা করেন তাহলে তারা উপকৃত হবেন।’ 

প্রসঙ্গত, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ নম্বর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পারভেজ মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই দিন রাতেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের তার মাথায় অস্ত্রোপচার (অপারেশন) করা হয়। পরে দীর্ঘ ১ মাস ৮ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে গত ১২ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় পারভেজ। গত ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার তার মরদেহ বাড়িতে আনা হয়। জানাজা শেষে বাড়ির পাশের কবস্থানে তাকে দাফন করা হয়। 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়