১০৫ মণ সবজি, ১৫ মণ চাল-ডাল দিয়ে ৬ হাজার লোকের খিচুড়ি উৎসব
পাবনা প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম

১০৫ মণ সবজি কেটেকুটে রাখা হয়েছে বিশাল টেবিলজুড়ে
১০৫ মণ বিভিন্ন ধরনের সবজি, ১২ মণ চাল আর ৩ মণ ডাল মিলিয়ে রান্না করা হলো ১২০ মণ সবজি খিচুড়ি। ছয়টি মহল্লার প্রায় ছয় হাজার মানুষ অংশ নিয়েছেন সেই খিচুড়ি উৎসবে।
ব্যতিক্রমী এই আয়োজন করা হয়েছে পাবনার বেড়া পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া মহল্লায়। আয়োজনের নাম ‘সবজি খিচুড়ি উৎসব’। এই উৎসব এক পর্যায়ে পরিণত হয় প্রাণবন্ত মিলনমেলায়।
প্রতি বছরের মতো এবারও শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) সবজি খিচুড়ি উৎসবের এই আয়োজনে বেড়া পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া, দাসপাড়া, কর্মকারপাড়া, শেখপাড়া, শাহপাড়া ও হাতিগাড়া মহল্লার অন্তত ছয় হাজার নারী-পুরুষ রাত আটটা থেকে ১২টা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া করেন।
আয়োজনে অংশ নেওয়া এলাকাবাসী সজীব জানান, বেড়া পৌর সদরের ‘দক্ষিণপাড়া যুবসমাজ’ এর উদ্যোগে ১১ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে এই ‘খিচুড়ি উৎসব’। সুবিধা মতো বছরের কোনো একটি দিনকে মহল্লার ছোট থেকে শুরু করে মুরুব্বিরা মিলে উৎসবের জন্য বেছে নেন। তবে শীতের মধ্যে অল্প দামে নানা রকম সবজি পাওয়া যায় বলে শীত মৌসুমেরই কোনো একটি দিনকে সবার সম্মতিতে ‘সবজি খিচুড়ি উৎসব’ হিসাবে বেছে নেওয়া হয়। এবার সবাই মিলে শুক্রবার (২৪ জানুয়ারি) দিনটিকে সবজি খিচুড়ি উৎসবের দিন হিসেবে বেছে নিয়েছে।
নারী সদস্যরা মিলে সবজি কাটাকুটি ও ধোয়ার কাজ করছেন
এরাকাবাসী মামুন জানান, ২০১৫ সালে বেড়া পৌর এলাকার দক্ষিণপাড়া মহল্লার দশ থেকে বারোজন যুবক এ খিচুড়ি উৎসবের শুরু করেন। ওই বছর সবজি খিচুড়ি রান্না করে খাওয়ানো হয় মহল্লারই শতাধিক নারী-পুরুষকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই আয়োজনের পরিধি প্রতি বছরই বেড়ে চলেছে। এক সময় এই আয়োজনের সঙ্গে শুধু দক্ষিপাড়া মহল্লার যুবকরা জড়িত থাকলেও এখন দলমত ও ধর্মবর্ণ মিলিয়ে আশেপাশের ছয়টি মহল্লার বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।
এবারের সবজি খিচুড়ি উৎসব দক্ষিণপাড়া মহল্লায় অনুষ্ঠিত হলেও এতে অংশ নেন দাসপাড়া, কর্মকারপাড়া, শাহপাড়া, শেখপাড়া ও হাতিগাড়া মহল্লার প্রায় ছয় হাজার নারী-পুরুষ।
আয়োজক সদস্য সোহেল হোসেন জানান, শুক্রবার ভোরেই তারা সবজি বিক্রির হাটগুলো থেকে প্রায় ১০৫ মণ বিভিন্ন ধরনের শীতকালীন সবজি কেনেন। এসব সবজির মধ্যে আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, লাউ, সিম, টমেটো, গাজর, মুলা, কাঁচা মরিচ, বেগুন, শালগম, বরবটিসহ আরও কয়েক রকমের সবজি থাকে। সবজি কিনে আনার পর দক্ষিপাড়া, দাসপাড়া ও কর্মকারপাড়া মহল্লার অন্তত ২৫টি বাড়িতে সেগুলো কাটা, বাছা ও ধোয়ার জন্য দেওয়া হয়। সকাল থেকেই মহল্লার বিভিন্ন বয়সী নারীরা ওইসব বাড়িতে জড়ো হয়ে সবজি কোটাবাছায় অংশ নেন। চার থেকে পাঁচশ’ নারী অন্তত ২৫টি দলে ভাগ হয়ে ১০৫ মণ সবজি দুপুরের মধ্যেই কাটা, বাছা ও ধোয়ার কাজ শেষ করেন।
দশটি ডেগে তিন বার করে রান্না করা হয় খিচুড়ি
এরপর দক্ষিণপাড়া মহল্লার সবচেয়ে বড় ফাঁকা জায়গায় রান্না করার জন্য বসানো হয় ১০টি অস্থায়ী চুলা। এর পাশেই তৈরি করা হয় প্যান্ডেল। কাটা সবজি সাজিয়ে রাখার জন্য একের পর এক টেবিল জোড়া দিয়ে বানানো হয় বিশাল আকারের টেবিল। বিকাল চারটা থেকে ১০টি চুলায় ১০টি ডেগ চাপিয়ে শুরু হয় সবজি খিচুড়ি রান্না।
রান্নায় ১০৫ মণ সবজির সঙ্গে যোগ করা হয় ১২ মণ চাল ও ৩ মণ ডাল। তিন দফায় এই রান্না শেষ হয়। তবে প্রথম দফা রান্না শেষে হওয়ার পরে রাত আটটা থেকেই শুরু হয় খাওয়া-দাওয়া। পরে আরও দুই দফা রান্না চলে। রাত আটটা থেকে শুরু করে ১২টা পর্যন্ত দক্ষিণপাড়াসহ ছয়টি মহল্লার অন্তত ছয় হাজার নারী-পুরুষ সবজি খিচুড়ি খাওয়ায় অংশ নেন।
এদিকে উৎসবটি সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হওয়ায় এত বড় আয়োজনের অনুষ্ঠানে সবজি, চাল, ডালসহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ হয়ে যায় খুব সহজেই। দক্ষিণপাড়া, দাসপাড়া ও কর্মকারপাড়াসহ কয়েকটি মহল্লার লোকজন স্বতঃস্ফুর্তভাবে সবজি, তেল, চাল, ডাল দিয়ে থাকেন। কেউ কেউ আবার অর্থ দিয়েও সহায়তা করেন। ফলে সবজি খিচুড়ির উপকরণের অভাব কখনই হয় না। বরং বছর বছর এর পরিমাণ বাড়ছে।
টেবিলে সাজিয়ে রাখা সবজি গুলো ডেগে নেওয়া হচ্ছে
খিচুড়ি উৎসব আয়োজনের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণপাড়া মহল্লার মানুষ একদিকে যেমন আনন্দে মেতে ওঠেন তেমনি মহল্লাটি পরিণত হয় প্রাণবন্ত মিলনমেলায়।
উৎসবের অন্যতম উদ্যোক্তা দক্ষিণপাড়া মহল্লার ফজলুর রহমান বলেন, “এই আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য হলো পারস্পারিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার বন্ধন দৃঢ় করা। দক্ষিণপাড়াসহ আশেপাশের কয়েক মহল্লার মানুষ সারাবছর ধরে এই সবজি খিচুড়ি উৎসবের জন্য অপেক্ষা করেন।”
এদিকে অনেক বাড়িতেই উৎসবকে সামনে রেখে শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে মেয়েরা বাবার বাড়িতে নাইওরে আসেন। এছাড়া, দূর-দূরান্তে বাস করা মহল্লার অনেক বাসিন্দাও উৎসবকে সামনে রেখে বাড়ি আসেন।
দক্ষিণপাড়া মহল্লার জুয়েল মোল্লা সাভারের একটি ট্রেক্সটাইল কারখানায় চাকুরি করেন। সেখানে তার ভাই, বোনসহ আরও কয়েকজন আত্মীয় কর্মসূত্রে বাস করেন। জুয়েল মোল্লা বলেন, ‘‘খিচুড়ি উৎসবের জন্য আমাদের পরিবারের সবাই সারা বছর জুড়ে অপেক্ষা করি। এই খিচুড়ি উৎসবকে সামনে রেখে আমার ভাই, বোনসহ পরিবারের ১২ জন বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বিকালে গ্রামের বাড়িতে আসি। এছাড়া আমার অনেক বন্ধুও এই উৎসবকে সামনে রেখে গ্রামে এসেছে। খিচুড়ি খাওয়া বড় ব্যাপার না, কিন্তু এই উৎসবকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্তে থাকা থাকা গ্রামের সবার সঙ্গে দীর্ঘদিন পর দেখা হওয়াটা অনেক ভাললাগার একটি বিষয়।’’
একযোগে দশটি ডেগে রান্না চলছে
উদ্যোক্তা দক্ষিণপাড়া মহল্লার ফজলুর রহমান বলেন, ‘‘এই উৎসবটি কয়েকটি মহল্লার মানুষের মধ্যে সম্প্রীতি ও মিলনমেলার সৃষ্টি করেছে। গত তিন-চারদিন ধরে মহল্লায় উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে আছে। আমাদের মহল্লাসহ আশেপাশের কয়েকটি মহল্লায় অন্তত এক হাজার নারী-পুরুষ এই উৎসবকে ঘিরে দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে এসেছেন।’’
দক্ষিণপাড়া মহল্লার বাসিন্দা ও মনজুর কাদের মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘‘খিচুড়ি উৎসব এখন এ এলাকার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে। দক্ষিণপাড়া মহল্লার তরুণেরা এই উৎসবে মূল ভূমিকা পালন করলেও আশেপাশের মহল্লাগুলোর সর্বস্তরের মানুষ এতে সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। এই উৎসব অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে গেলে পারস্পরিক সম্প্রীতি বন্ধন দৃঢ় হবে। কমে আসবে হিংসা বিদ্বেষ।”
ঢাকা/শাহীন/এস