পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের সারা দেশে ‘কাফন মিছিল’
রাইজিংবিডি ডেস্ক || রাইজিংবিডি.কম

মাথায় কাফনের কাপড় বেঁধে শুক্রবার বিক্ষোভ মিছিল করেন পলিটেকনিকের শিক্ষার্থীরা
ছয় দফা দাবিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) জুমার নামাজের পর থেকে তারা এ কর্মসূচি পালন করেন।
ঢাকা: ছয় দফা দাবি আদায়ে আজ জুমার নামাজ শেষে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের হল মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে কাফনের কাপড় পরে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা ‘তুমি কে, আমি কে, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’, ‘কুমিল্লায় হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দেন।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) জুমার নামাজ শেষে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের হল মসজিদ প্রাঙ্গণ থেকে কাফন মিছিলটি বের হয়। বিক্ষোভকারীদের মাথায় কাফনের কাপড়ের টুকরা বাঁধা দেখা যায়।
ফরিদপুর: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক ফলপ্রসূ না হওয়া এবং কুমিল্লায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আজ দুপুরে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে গণমিছিল করেছে ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠানের অডিটোরিয়ামের সামনে জড়ো হয়ে তারা এ কর্মসূচি পালন করেন।
ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্টের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী বুলবুল আহমেদ মাহিম বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের দাবি জানালেও কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় আমাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। শিক্ষার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। কুমিল্লায় আমাদের সহপাঠীদের ওপর হামলা রাষ্ট্রেরই ব্যর্থতা।”
কম্পিউটার ডিপার্টমেন্টের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী নাফিজুল রোহান বলেন, “আমরা কাফন পরেছি এই বার্তা দিতে যে, যদি আমাদের ন্যায্য দাবি না মানা হয়, তবে আমরা মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করতে প্রস্তুত। সরকারকে অবিলম্বে আমাদের দাবিগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।”
ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় সেমিস্টারের শিক্ষার্থী লামীম ইসলাম বলেন, “আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ নই, আমরা শুধু আমাদের অধিকার চাই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় যদি আমাদের সমস্যা সমাধানে আন্তরিক না হয়, তাহলে আন্দোলন আরো তীব্র হবে।”
ফরিদপুর কোতোয়ালি থানার ওসি আসাদুজ্জামান বলেন, "জুমার নামাজের আগে থেকেই আমরা ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবস্থান করছিলাম, যাতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি না হয়। শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি পালন করেছেন। কোনো ধরনের উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটেনি।”
রংপুর: একই দাবিতে দুপুরে কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে শিক্ষার্থীরা রংপুর পলিটেকনিক ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে তারা সেখান থেকে একটি গণমিছিল বের করেন। মিছিলটি শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে পুনরায় ক্যাম্পাসে ফিরে আসে। এসময় সেখানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জানান, দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করা হলেও কর্তৃপক্ষ তাদের কথা শুনছে না। তাই বাধ্য হয়ে এবার তারা প্রতীকী ‘কাফনের কাপড়’ পরে মাঠে নেমেছেন। অতি দ্রুত দাবি আদায় না হলে সামনে আরো কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন শিক্ষার্থীরা।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমান, ইলেকট্রিক্যাল বিভাগের সাব্বির হোসেন ও সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২১ শিক্ষাবর্ষের ফুয়াদ।
গোপালগঞ্জ: শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা ৩টার দিকে গোপালগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের সামনে জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। তারা মাথায় কাফনের কাপড় পরে বিক্ষোভ মিছিল করেন। মিছিলটি বিভিন্ন সড়ক ঘুরে সদর উপজেলার চন্দ্রদিঘলীয়া এলাকায় ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে গিয়ে শেষ হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরত পাঠায়।
এর আগে, সমাবেশে শিক্ষার্থীরা জানান, সরকারকে বলব, তারা যেনে দাবিগুলো দ্রুত মেনে নেয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছেড়ে দেব। কারিগরি শিক্ষা সেক্টরে যে বৈষম্য আছে, শিক্ষার্থীরা চায় সরকার যেন তা দূর করে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
সমাবেশে বক্তব্য রাখেন- শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল, মো. রাব্বি, মো. ফজলে রাব্বি বাঁধন ও মো. মোস্তাকিন মিয়া।
নরসিংদী: কুমিল্লায় পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ও ছয় দফা দাবি আদায়ে মিছিল করেছে নরসিংদীর সরকারি-বেসরকারি সব পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থীরা।
শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) দুপুরে বিক্ষোভ মিছিলটি নরসিংদী সরকারি পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট থেকে শুরু হয়। সেটি শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সাহেপ্রতাপে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানে সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানান, বাংলাদেশ কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্বতা পোষণ করে তারা ছয় দফা দাবি জানিয়ে আসছেন। তাদের দাবি মেনে নিতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হলে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক কঠোর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তারা।
ফেনী: জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি পাস ‘ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের’ পদোন্নতির প্রতিবাদে কাফনের কাপড় মাথায় বিক্ষোভ মিছিল করেছেন ফেনী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। প্রতিষ্ঠানটির জামে মসজিদের সামনে থেকে বের হওয়া মিছিলটি শহরের সদর হাসপাতাল মোড়সহ বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। পরে ‘জুলাই ২৪ শহীদ স্মৃতি চত্বরে’ গিয়ে সমাবেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
ফেনী পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী রাতুল বলেন, ‘আমরা ৬ দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন করছি অনেকদিন। সরকার বলেছে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হবে। কিন্তু কাল যে বৈঠক ডাকা হয়েছিল, সেখানে কেউই ছিল না। তাহলে আমাদের যৌক্তিক দাবি মানতে গড়িমসি কেন?’
শিক্ষার্থী সানি বলেন, “ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরদের বেশির ভাগই অষ্টম শ্রেণি বা এসএসসি পাস। তাদের পক্ষে ডিপ্লোমা শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়।’
কারিগরি শিক্ষার্থীদের ছয় দাবি
জুনিয়র ইন্সট্রাক্টর পদে ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের অবৈধ পদোন্নতির রায় হাইকোর্ট কর্তৃক বাতিল করতে হবে। পাশাপাশি, ক্রাফট ইন্সট্রাক্টর পদবি পরিবর্তন ও মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের স্থায়ীভাবে চাকরিচ্যুত করতে হবে।
২০২১ সালে রাতের আঁধারে নিয়োগপ্রাপ্ত ক্রাফট ইন্সট্রাক্টরদের নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে বাতিল এবং সেই বিতর্কিত নিয়োগবিধি অবিলম্বে সংশোধন করতে হবে।
উপ-সহকারী প্রকৌশলী ও সমমানের (১০ম গ্রেড) পদ চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ও মনোটেকনোলজি (সার্ভেয়িং) থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত থাকা সত্ত্বেও যেসব সরকারি, রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের নিম্নস্থ পদে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
কারিগরি সেক্টর পরিচালনায় পরিচালক, সহকারী পরিচালক, বোর্ড চেয়ারম্যান, উপসচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সব পদে কারিগরি শিক্ষাবহির্ভূত জনবল নিয়োগ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং তা আইনানুগভাবে নিশ্চিত করতে হবে। এ পদগুলোতে অনতিবিলম্বে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত জনবল নিয়োগ এবং সব শূন্য পদে দক্ষ শিক্ষক ও ল্যাব সহকারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে।
কারিগরি শিক্ষায় বৈষম্য ও দুরবস্থা দূর করার পাশাপাশি দক্ষ জনসম্পদ তৈরিতে ‘কারিগরি ও উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়‘ নামে স্বতন্ত্র মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে কারিগরি শিক্ষা সংস্কার কমিশন গঠন করতে হবে।
পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার সুযোগের লক্ষ্যে একটি উন্নত মানের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পাশাপাশি, নির্মাণাধীন চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (নড়াইল, নাটোর, খাগড়াছড়ি ও ঠাকুরগাঁও) পলিটেকনিক ও মনোটেকনিক থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য অস্থায়ী ক্যাম্পাস ও ডুয়েটের আওতাভুক্ত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আগামী সেশন থেকে শতভাগ সিটে ভর্তির সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিরা।
ঢাকা/মাসুদ/রাসেল