ঢাকা     শনিবার   ১৭ মে ২০২৫ ||  জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩২

কলকারখানার দূষিত পানিতে ফসল নষ্টের শঙ্কা

রফিক সরকার, গাজীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫৫, ২৫ এপ্রিল ২০২৫   আপডেট: ২৩:০৬, ২৫ এপ্রিল ২০২৫
কলকারখানার দূষিত পানিতে ফসল নষ্টের শঙ্কা

বিলের পানি হয়ে পড়েছে চরমভাবে দূষিত ও কৃষিকাজের জন্য অনুপযোগী। 

গাজীপুরের কালীগঞ্জে চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে এই ফলনে স্থানীয় কৃষকের মুখে চওড়া হাসি থাকার কথা থাকলেও কপালে পড়ছে চিন্তার ভাঁজ। বেলাই পাড়ের জেলার টঙ্গী, সদর ও শ্রীপুর এলাকার বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার নির্গত দূষিত পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে বিলে। ফলে বিলের পানি হয়ে পড়েছে চরমভাবে দূষিত ও কৃষিকাজের জন্য অনুপযোগী। 

ধান কাটার মৌসুমে এসে এই দূষণের ফলে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ শ্রমিক সংকট। আর শ্রমিক সংকটের কারণে উৎপাদিত বোরো ধান নষ্টের আশঙ্কা দিন কাটছে কৃষকের। 

এই মৌসুমে এমনিতেই কৃষি কাজের শ্রমিকের সংকট থাকে। কিন্তু ফলন ভাল হওয়ায় কৃষক অতিরিক্ত মজুরীতে শ্রমিক রাখলেও তারা ১/২ দিন কাজ করে চলে যাচ্ছে। বিলের পানিতে নেমে ধান কাটতে গিয়ে শ্রমিকদের হাতে, পায়ে ও শরীরে দূষিত পানির কারণে চুলকানি, জ্বালাপোড়া ও চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।

স্থানীয় কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ বছর কালীগঞ্জ উপজেলায় মোট ৯৮১০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এরমধ্যে হাইব্রিড জাতের ধান ২৮৭৫ হেক্টর ও উফশী জাতের ধান ৬৯৩৫ হেক্টর। নমুনা শষ্য কর্তনের হিসাব অনুযায়ী গড়ে উফশী জাতের ধান বিঘা প্রতি ২১ মণ ও হাইব্রিড বিঘা প্রতি ২৬ মণ উৎপাদন হয়েছে

তবে ব্রিধান-২৮ জাতের তুলনায় স্বল্প মেয়াদী ব্রিধান-৮৮, ব্রিধান-৯৬, ব্রিধান-১০০ ও অন্যান্য জাতের মত স্বল্প জীবনকাল এবং বেশি ফলনশীল ও কম ঝুঁকিপূর্ণ জাতের দিকে বেশি ঝুঁকছেন। এছাড়া এ উপজেলায় ব্রিধান-১০২, ব্রিধান-১০৪, ব্রিধান-১০৫, ব্রিধান-১০৮ নতুন জাতের চাষ হচ্ছে। 

কৃষকরা জানান, এবার বাম্পার ফলন হলেও ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অতিরিক্ত পারিশ্রমিক দিলেও যারা আসছেন, তারা এক-দুদিন কাজ করার পরই চলে যাচ্ছেন। কারণ, পানিতে নামার পর তাদের হাতে-পায়ে চুলকানি, জ্বালাপোড়া ও চর্মরোগ দেখা দিচ্ছে।

উপজেলার বক্তাপুর ইউনিয়নের উত্তর খৈকড়া গ্রামের হাশেম খন্দকার নামের সত্তোর্ধ একজন স্থানীয় কৃষক বলেন, “আমার তিন বিঘা জমির ধান পাকছে। দুজন শ্রমিক পেয়ে কাজ শুরু করেছিলাম কিন্তু তারা একদিন পরই জানায় পানিতে নামা যায় না, গা জ্বালা করে, ফুসকুড়ি উঠে যায়।”

কথা হয় একই গ্রামের সত্তোর্ধ শুক্কুর আলী, ষাটোর্ধ মিলন মিয়া ও গিয়াসউদ্দিন বাগমার ও চল্লিশোর্ধ আসাদ খন্দকারের সাথে। 

তারা বলেন, “বিলে কলকারখানার দূষিত পানি পড়া বন্ধ না হলে ধান কাটা তো দূরের কথা, ভবিষ্যতে এখানে চাষাবাদই করা যাবে না। তাই তারা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পরিবেশ কর্মীদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।” 
 
শ্রমিকদের অভিযোগ, দূষিত পানিতে কাজ করতে গেলে হাতে-পায়ে পানি কামড় দেয়, পরে ফোসকা পড়ে এবং চুলকানি সহ্য করা যায় না। তাই তারা বাধ্য হয়ে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।

জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে আসা চল্লিশোর্ধ শ্রমিক মনজু মিয়া বলেন, “কয়েকদিন হয় এখানে এসেছি, কাজ করছি। হাতে-পায়ে ঘা ধরছে, তাই কাজ করতে পারছি না। বিলের পানি ভাল না। পানি খুব কালো, নষ্ট হয়ে গেছে।” 

বাংলাদেশ নদী পরিব্রাজক দল কালীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি আব্দুর রহমান আরমান বলেন, “এই পরিস্থিতি শুধু কৃষি নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। অবিলম্বে শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কঠোর নজরদারি এবং আইন প্রয়োগ না করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।”

কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, “বেলাই বিলে বড় একটি সমস্যা হচ্ছে আশপাশের এলাকা বিশেষ করে টঙ্গী, গাজীপুর সদর ও শ্রীপুর উপজেলার বিভিন্ন শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি বিলে ফেলা হয়। এতে করে ধান কাটার সময় দেখা যায় ধান অনেক সময় পানিতে তলিয়ে যায়। আবার অনেক সময় দূষিত পানির কারণে শ্রমিকরা মাঠে নামতেই চায় না। তারা বলে শরীরে চুলকানি ও চর্মরোগ হয়।”

তিনি আরও জানান, এই অবস্থায় শ্রমিকরা অতিরিক্ত মজুরী দাবি করে। অনেক সময় উচ্চ মজুরিতেও কাজ করতে আগ্রহ দেখায় না, দু-একদিন পরই কাজ ছেড়ে চলে যায়। ফলে কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

কৃষিবিদ ফারজানা বলেন, “এই সমস্যা নিয়ে আমি জেলা অফিসের মিটিং, সার্বিক মনিটরিং কমিটি এবং উপজেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় বারবার বিষয়টি তুলে ধরেছি। কিন্তু এখনো স্থায়ী সমাধানের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি।”

পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুরের উপ-পরিচালক মো. আরেফীন বাদল বলেন, “ইতিমধ্যেই বিলাই বিলসহ গাছা খাল, লবলঙ্গ খালসহ যেখানেই দূষণ হচ্ছে সেগুলো নিয়ে আমরা কাজ শুরু করেছি। সর্ট টাইম, লং টাইম কাজ শুরু করেছি। সেগুলো চলমান আছে। সুতরাং আমরা আশা করছি সহসাই হয়তো একবারেই দূষণমুক্ত হবে না, তবে আমরা ভালো একটা জায়গা নিয়ে যেতে পারবো বলে আশা করছি।”

উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, “বেলাই বিলের সাথে গাজীপুর সদর, টঙ্গী, শ্রীপুরের কিছু অংশ রয়েছে। ওই সকল এলাকার জেলার বেশির ভাগ শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। সেই সব শিল্প কারখানা দূষিত পানিগুলো বিভিন্ন খালের মাধ্যমে কালীগঞ্জে বেলাই বিলের কৃষি জমিগুলোতে এসে পড়ছে। আমি ইতিমধ্যে গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছে কোন কোন শিল্প কারখানা দূষিত পানি বেলাই বিলের পানি দূষিত করছে, সেটার তালিকা তৈরির কাজ তারা শুরু করেছেন। তো সেই তালিকা হাতে পেলেই জেলা পরিবেশ অধিদফরের মাধ্যমে তাদেরকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব।”

ঢাকা/রফিক/এস


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়