ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৪ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

পোশাক খাতে আগ্রহ কমছে নারী শ্রমিকদের 

রেজাউল করিম, গাজীপুর  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১০, ২ জুলাই ২০২৫   আপডেট: ১৫:১৮, ২ জুলাই ২০২৫
পোশাক খাতে আগ্রহ কমছে নারী শ্রমিকদের 

গার্মেন্টস খাতে কর্মরত নারী শ্রমিকদের একাংশ

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বাংলাদেশ। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত এটি এবং মোট রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে এই খাত থেকে। পোশাক শিল্পের বিপ্লবের মূল ধারক-বাহক হলেন শ্রমিক। বিশেষ করে নারী শ্রমিক। তবে সেই পোশাক খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ ক্রমশ কমছে। 

পোশাক শিল্পে বাংলাদেশে একসময় মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশের বেশি ছিল নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ। তবে বিভিন্ন গবেষণা ও পরিসংখ্যান বলছে বর্তমানে তা কমে ৫৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ কমে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ উঠে এসেছে। 

কলকারখানা ও শিল্পপুলিশ সূত্রে জানা যায়, শিল্পঅধ্যুষিত গাজীপুরে ২ হাজার ১৭৬টি নিবন্ধিত কলকারখানা রয়েছে। এরমধ্যে ১ হাজার ১৫৪টি পোশাক কারখানা। এসকল কারখানায় কাজ করেন লাখ লাখ নারী শ্রমিক। 

এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত ১০ বছর আগে গার্মেন্টস কারখানায় কাজের ক্ষেত্রে নারীদের যে পরিমাণ অংশগ্রহণ ও আগ্রহ ছিল, তা এখন অনেকাংশে কমছে। এর কারণ অনুসন্ধান করতে বিভিন্ন কারখানার অন্তত ৫০ জন্য নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। 

তাদের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন বিষয়ে উঠে এসেছে। এসবের মধ্যে রয়েছে সন্তান লালন পালনের অসুবিধা, স্বামীর আয়ের উৎসবৃদ্ধি, কম মজুরি, দীর্ঘ সময় কাজ করা, পারিবারিক দায়িত্ব পালন। এছাড়াও তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে বিভিন্ন কর্পোরেট হাউজে কাজের সুবিধা আরেকটি কারণ। 

নারী শ্রমিকরা জানান, পোশাক শিল্পে কাজের ক্ষেত্রে দীর্ঘসময় কারখানাতেই ব্যয় করতে হয়। এতে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। কাজের দক্ষতা ও কর্ম ঘণ্টা অনুযায়ী মজুরি তুলনামূলক কম। পাশাপাশি প্রত্যেকটি কারখানায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা চাপিয়ে দেওয়া হয়, এতে তাদের কাজের প্রতি অনিহা তৈরি হয়। 

প্রযুক্তি খাত উন্নত হয়েছে, অথচ এসব শ্রমিকদের তেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। ফলে কর্মক্ষেত্রে দক্ষ হতে সময় লাগছে। এছাড়াও পোশাক কারখানার বাইরে অন্যান্য খাতে কাজের সুযোগ বেড়েছে। যেখানে কর্মঘণ্টা কম ও কাজের পরিবেশ ভালো। সেখানে কাজ করে পরিবারকে যথেষ্ট সময় দেওয়ার সুযোগ থাকে। 

অটোমেশন ও স্পিনিং, উইভিং, ডাইং এবং ফিনিশিং সেক্টরগুলো মূলত পুরুষ শ্রমিকেরা পরিচালনা করেন। ফলে নারী শ্রমিকদের প্রভাব সেখানেও কমে গেছে। অটোমেশনের সময়ে দক্ষ হয়ে ওঠার মতো সময় ও সুযোগ নারীরা পাচ্ছেন না বলে জানান তারা।

পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এই শিল্পে ১৯৮০ সালে নারী শ্রমিকের হার ছিল ৮০ শতাংশ। যা ২০২১ সালে কমে দাঁড়ায় ৫৩ দশমিক ৭ শতাংশে। অর্থাৎ পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার মতে, পোশাক খাতে নিযুক্ত মোট শ্রমিকের মধ্যে নারীর সংখ্যা কমে ৫৭ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রথম দিকে কম বেতনের চাকরি হলেও অনেক নারী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করতে আগ্রহী ছিলেন। তবে তারা করতে চান না। 

সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার তাসলিমা খাতুন। ১০ বছর আগে গাজীপুরে এসেছিলেন চাকরি করতে। তারপর গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক কারখানায় কাজ করেছেন। সেসময়ে ছোট্ট সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে স্বামী-স্ত্রী মিলে কাজ করতেন। দেড় বছর ধরে তিনি আর কাজ করেন না। 

তিনি বলেন, “দুজনে পরিশ্রম করে কিছু টাকা জমা করেছি। তখন পরিশ্রম গায়ে সইতো, এখন চাপ নিতে কষ্ট হয়। এরমধ্যে ছেলে বড় হয়ে গেছে, ওরে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। ছেলেকে মানুষ করতে হবে এজন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।” 

শ্রমিক ও নারী অধিকারকর্মী তাসলিমা আক্তার বলেন, “নারী শ্রমিকদের অটোমেশনে দক্ষ হতে যে মনোযোগ দিতে হয়, ঘরে-বাইরে কাজ করে তা দেওয়া সম্ভব হয় না। সে কারণেও নারী শ্রমিক এ খাতে কমে যাচ্ছে। এছাড়া কর্মপরিবেশ, মাতৃকালীন ছুটি ও ডে কেয়ার ব্যবস্থার আরও উন্নয়ন করা দরকার।”

জামালপুর থেকে একযুগ আগে স্বামী-স্ত্রী চলে আসেন গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায়। এরপর দু'জন চাকরি করেন বিভিন্ন পোশাক কারখানায়। স্বামী আলফাজ হোসেন বলেন, “প্রথম যখন গাজীপুরে কাজ করতে আসি বেতন খুব কম ছিল। দু'জনে কাজ করে বাড়িতে টাকা পাঠাতাম এবং কিছু করে সঞ্চয় করতাম। এখন বেতন বেড়েছে, সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে গ্রামে জমি করেছি। গতবছর আমার স্ত্রীকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। কারণ সে আর গার্মেন্টসে কাজ করতে চায় না। শরীরও আগের মতো চাপ নিতে পারে না।” 

শ্রমিক নেতা অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার আন্দোলনের সংগঠক আরমান হোসাইন বলেন, “‎আমাদের দেশের অর্থনীতির বড় একটি চালিকাশক্তি হলো পোশাক শিল্প। এই খাতেই বড় অংশ শ্রমিক নারী। কিন্তু, আজ প্রশ্ন উঠছে- যখন নারীরা সংখ্যায় এত বেশি, তখন কেন তারা নেতৃত্বে এত কম। কাজ শেষে পরিবার সামলানো, সন্তান লালন পালন করা, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়াও স্বামীর স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে অনেকেই চাকরি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। তারা পরিবারকে সময় দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। এসব নানা কারণে নারীদের অংশগ্রহণ কমছে।”

ঢাকা/এস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়