ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

সর্বজনীন পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করবে কর্তৃপক্ষ

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৩০, ২১ অক্টোবর ২০২৩  
সর্বজনীন পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করবে কর্তৃপক্ষ

সর্বজনীন পেনশন তহবিলের অর্থ বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে অর্থ বিভাগের জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ। আগামীকাল ২২ অক্টোবর অর্থ বিনিয়োগের বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে অবহিত করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। 

রোববার দুপুরে অর্থ বিভাগের সভাকক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অর্থ বিভাগের সচিব ড. মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার সভাপতিত্ব করবেন। অনুষ্ঠানে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কবিরুল ইজদানী খান অর্থমন্ত্রীর কাছে সর্বজনীন পেনশন তহবিলের অর্থে ক্রয় করা ট্রেজারি বন্ড হস্তান্তর করবেন বলে জানা গেছে।

দেশে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন। তার আগে তিনি বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তবে জীবদ্দশায় সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি তিনি।

সে সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছিলেন, ‘আমি সরকারি চাকরি শেষে যখন পেনশন তুলতে গিয়েছিলাম তখন নানা ধরনের আইনি জটিলার মুখে পড়েছিলাম। অবশ্য পেনশন তোলা নিয়ে নানা ধরনের ভোগান্তির কথা আগে থেকেই জানতাম। তা প্রত্যক্ষ করলাম নিজের পেনশন তুলতে গিয়ে সেই সময় থেকে আমার পরিকল্পনা ছিল কোন দিন সুযোগ পেলে পেনশন ব্যবস্থা ভোগান্তিহীন করবো।’

তিনি বলেছিলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বিষয়টি নিয়ে কাজ করার অনুমোতি দিয়েছেন। আশা করছি, আগামী বাজেটে এ বিষয়ে কিছু একটা বলতে পারবো। তবে প্রক্রিয়াটি অনেক দীর্ঘ। এটা বাস্তবায়ন করতে একটু সময় লাগবে। আমার সময়কালে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থার আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নেবো। ইতোমধ্যে একটি খসড়া তৈরির কাজ চলছে।’

তারই ধারাবাহিকতায় আবুল মাল আবুল মুহিত ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘ভবিষ্যতে প্রবীণদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে  সে জন্য পেনশন ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে সরকার। দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মাত্র ৫ শতাংশ, যাদের প্রায় সবাই সরকারি চাকুরে, এখন পেনশন সুবিধা পান। বাকি ৯৫ শতাংশের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশ গ্রাচ্যুইটি সুবিধা পেলেও অন্যদের জন্য সে সুবিধাও নেই।’

আবুল মাল আবদুল মুহিতের সেই ঘোষনার পর থেকে নানা পর্যায় অতিক্রম করার পর চলতি বছর ১৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুল প্রত্যাশিত সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক যাত্রার  উদ্বোধন করেন। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের হাতে যাত্রা শুরু করে বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের হাত ধরে তা বাস্তবায়ন হয়েছে। 

জাতীয় সংসদের বিগত অধিবেশনে সর্বজনীন পেনশন স্কিম আইনটি পাস হওয়ার পর গত ৩১ জানুয়ারি আইনটিতে সম্মতি দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। পরে গত ১৩ আগস্ট আইনটির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিধিমালা ২০২৩ জারি করেছে সরকার। এই স্কিমের বিধিমালা অনুযায়ী, জাতীয় পরিচয়পত্রের ভিত্তিতে ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক তাদের জন্য প্রযোজ্য পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য নিবন্ধন করতে পারবেন। প্রবাসী বাংলাদেশি যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

যেসব নাগরিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় রয়েছেন তারা এই পেনশনের আওতায় আসতে পারবে না। তবে তারা যদি এই সুবিধা ত্যাগ করেন তবে পেনশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। উল্লেখ্য, সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় বেশ কয়েকটি কর্মসূচি চালু রয়েছে। এর মধ্যে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা প্রভৃতি।

এ কর্মসূচিতে যুক্ত হলে ৬০ বছর বয়সের পর থেকে আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন গ্রাহক। চাঁদা পরিশোধের পর তিনি মারা গেলে তার নমিনি বা উত্তরাধিকারী পেনশন পাবেন ১৫ বছর। পঞ্চাশ বছরের ঊর্ধ্বের নাগরিকরাও পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন, তবে সে ক্ষেত্রে স্কিমে অংশগ্রহণের তারিখ থেকে নিরবচ্ছিন্ন ১০ বছর চাঁদা প্রদান শেষে আজীবন পেনশন প্রাপ্য হবেন।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, স্কিমের আওতায় চাঁদাদাতা স্কিমের স্বত্ব অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তর করতে পারবে না। তবে স্কিম চলাকালীন কেউ মারা গেলে মনোনীত নমিনির নামে হস্তান্তর করা যাবে। এছাড়া চাঁদাদাতা তার মোট জমানো অর্থের ৫০ শতাংশ ঋণ নিতে পারবেন। এটি পরবর্তী ২৪ কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।

চার ক্যাটাগরির মাধ্যমে পেনশন স্কিমটি বাস্তবায়ন করা হবে। মাসিক চাঁদা ধরা হয়েছে সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে কর্মসূচি পরিবর্তন এবং চাঁদার পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ থাকছে। পেনশন ব্যবস্থায় নগদ টাকায় কোনো লেনদেন হবে না। সব কর্মকাণ্ড হবে অনলাইনে। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করেও চাঁদা দেওয়া যাবে। চার ক্যাটাগরির পেনশন স্কিমের মধ্যে রয়েছে- প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য ‘প্রবাস স্কিম’, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিজীবীদের জন্য ‘গ্রগতি স্কিম’, অনানুষ্ঠানিক খাতে বা স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকদের (কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে, তাঁতি, রিকশাচালক ইত্যাদি পেশার) জন্য ‘সুরক্ষা স্কিম’ ও স্বকর্মে নিয়োজিত স্বল্প আয়ের নাগরিক ‘সমতা স্কিম’।

সমতা স্কিমের বিষয়ে বিধিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রকাশিত আয়সীমার ভিত্তিতে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের ব্যক্তি যাদের বর্তমান বার্ষিক আয়সীমা অনূর্ধ্ব ৬০ হাজার টাকা, তারা এই স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন।

সমতা স্কিমে চাঁদাদাতার অনুকূলে সরকারি অর্থ জমা প্রদানের বিষয়ে বিধিমালায় বলা হয়েছে, সমতা স্কিমে সরকারি অংশ প্রদানের জন্য যথেষ্ট অর্থ রয়েছে কি না বা যথেষ্ট অর্থ না থাকলে এ বাবদ কী পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হবে, পেনশন কর্তৃপক্ষ ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে নির্ধারণ-পূর্বক প্রয়োজনীয় অর্থের চাহিদাপত্র অর্থ বিভাগে প্রেরণ করবে এবং অর্থ বিভাগ প্রয়োজনীয় অর্থ প্রদান করবে।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, ধারাবাহিক তিনটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাব স্থগিত হবে। পরবর্তী সময়ে পুরো বকেয়া কিস্তি পরিশোধ না করা পর্যন্ত হিসাবটি সচল হবে না। নির্দিষ্ট তারিখে চাঁদা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পরবর্তী এক মাস পর্যন্ত জরিমানাবিহীন পরিশোধ করা যাবে। এরপর প্রতিদিনের জন্য ১ শতাংশ হারে বিলম্ব ফি জমা দেওয়া সাপেক্ষে হিসাবটি সচল করা যাবে। এছাড়া, একজন চাঁদাদাতা আগাম কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন। অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে ১২ মাস পর্যন্ত কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে পেনশন হিসাবটি স্থগিত হবে না।

বিধিমালায় বলা হয়েছে, কোনো চাঁদাদাতা ৭৫ বছরের আগে নিখোঁজ হলে এবং নিখোঁজ হওয়ার পর ৭ বছর অতিবাহিত হলে তার হিসাব স্থগিত করে নমিনিকে টাকা ফেরত দেওয়া হবে। এছাড়া, কেউ চাঁদা প্রদানকালে শারীরিক ও মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে স্থায়ী বা সাময়িকভাবে অর্থ উপার্জন করতে না পারলে তাকে অসচ্ছল চাঁদাদাতা ঘোষণা করতে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেবে।

‘সর্বজনীন পেনশন তহবিল’ শিরোনামের ব্যাংক হিসাবে পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী সবার জমাকরা অর্থ জমা থাকবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকারের ট্রেজারি বন্ডকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, কেননা এটি সবচেয়ে নিরাপদ বিনিয়োগ। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য লভ্যাংশের ভিত্তিতে পেনশনারদের মাসিক এন্যুয়িটি হিসাব করে একজন পেনমনারের মাসিক পেনমন দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি কত টাকা, কত সময় জমা দেন, কী পরিমাণ পেনশন প্রাপ্য হবেন, তার একটি সম্ভাব্য হিসাব দেখানো হয়েছে।  

সর্বজনীন পেনশন স্কিম বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে এখানে  https://upension.gov.bd/  । 

ঢাকা/হাসনাত/ইভা 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়