ঢাকা     বুধবার   ০৯ জুলাই ২০২৫ ||  আষাঢ় ২৫ ১৪৩২

ত্রুটিপূর্ণ সিইটিপি নির্মাণ, সংকটে দেশের চামড়া খাত

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:২৯, ১২ জুন ২০২৫   আপডেট: ১৭:৩২, ১২ জুন ২০২৫
ত্রুটিপূর্ণ সিইটিপি নির্মাণ, সংকটে দেশের চামড়া খাত

বিসিক শিল্প নগরী

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত চামড়া শিল্প এক দশক ধরে চলছে সংকটে। এর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থাপিত বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর সেন্ট্রাল এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (সিইটিপি)। যা এক সময় আধুনিক, পরিবেশবান্ধব শিল্প গড়ার স্বপ্ন ছিল, এখন তা হয়ে উঠেছে ব্যর্থতার প্রতীক।

ঈদুল আজহার পর এবারও সিইটিপির ব্যর্থতার করুণ চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। তরল বর্জ্য শোধনে এটি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ; আর সলিড বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ এখনও শুরুই হয়নি। এতে অভ্যন্তরীণভাবে পরিবেশগত বিপর্যয়ের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও আস্থা সংকট দেখা দিয়েছে। এবার সরকার দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও প্রশ্ন রয়ে গেছে—এত দেরিতে কেন?

ত্রুটিপূর্ণ নকশা, দায়সারা নির্মাণ
২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি স্থানান্তর করে সাভারে নেওয়া হয় পরিবেশসম্মত শিল্প গড়ার লক্ষ্য নিয়ে। প্রায় ১ হাজার ১৬ কোটি টাকার বিসিক চামড়া শিল্প নগরী প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় ২০০৩–২০২১ মেয়াদে, যার অর্ধেকের বেশি অর্থ ব্যয় হয় সিইটিপির পেছনে। কিন্তু পুরো পরিকল্পনা ও নির্মাণপর্বেই ছিল চরম অব্যবস্থাপনা।

ঠিকাদারের দায়সারা কাজ, বিপদে উদ্যোক্তারা
সিইটিপি নির্মাণের দায়িত্ব ছিল চীনের প্রতিষ্ঠান জিয়াংসু লিংজাই এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন কোম্পানির হাতে। বিসিক ও উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, চাপের মুখে ঠিকাদার দায়সারা কাজ করেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে শাস্তির হুমকি দিয়েছিল বিসিক, যার ফলে প্রকল্পটি দ্রুত কিন্তু ত্রুটিপূর্ণভাবে শেষ হয়।

ট্যানারি মালিকদের অভিযোগ, কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেও তারা এখন হুমকির মুখে। সিইটিপি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ইউরোপীয় ক্রেতারা চুক্তি বাতিল করছেন। অধিকাংশ ট্যানারি LWG (লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ) সনদ না পাওয়ায় রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে।

পরিবেশ বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক সংকট
প্রতি ঈদুল আজহায় কোটি টাকার কাঁচা চামড়া আসে সাভারে। এবার কোরবানিতে ৮০–৮৫ লাখ পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অনেক চামড়া লবণ না পেয়ে নষ্ট হয়েছে। সিইটিপি সচল না থাকায় তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে, আর কঠিন বর্জ্য খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভ্রাটে জেনারেটরের সাহায্যে সাময়িকভাবে প্ল্যান্ট চালু রাখা হয়, যা পুরো ব্যবস্থাপনার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে পরিবেশ ধ্বংসের পাশাপাশি শিল্পে আস্থার মারাত্মক ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, “আমরা প্রস্তুত, ইউরোপীয় ক্রেতারাও আগ্রহী। কিন্তু সিইটিপি না থাকায় এলডব্লুজিকে আমন্ত্রণ জানানো যাচ্ছে না। তারা বাস্তব অবস্থা দেখলে চামড়ার প্রতি আস্থা হারাবে।”

সরকারের হস্তক্ষেপ ও তদন্তের আশ্বাস
বর্তমান সরকার প্রথমবারের মতো দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মাধ্যমে তদন্ত শুরু করেছে। শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, “সিইটিপি নির্মাণে যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।”

তিনি জানান, একটি ইউরোপীয় গবেষক দল সিইটিপির প্রকৃত অবস্থা যাচাই করছে বিনা পারিশ্রমিকে। সেই ভিত্তিতে আধুনিক ও কার্যকর নতুন প্ল্যান্ট স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে।

শিল্প সচিব মো. ওবায়দুর রহমান বলেন, “আমরা বাধ্য হয়ে সিইটিপিকে সীমিতভাবে চালু রেখেছি। কিন্তু এই ভুল প্রকল্পের দায় সরকার নেবে না। এবার আন্তর্জাতিক মানের প্রকৌশল নির্ভর সিইটিপি স্থাপন করা হবে।”

চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ
বর্তমানে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে ১১২টি ট্যানারিতে কাজ করছেন প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক। গার্মেন্টসের পর এই খাতই দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাত। অথচ একটি প্ল্যান্টের নির্মাণ ত্রুটি এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যর্থতায় গোটা খাত আজ অনিশ্চয়তার মুখে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবু ইউসুফ বলেন, “সিইটিপি ছিল বাজেটের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখানে ভুল ঠিকাদার নির্বাচন করাই ছিল মূল ব্যর্থতা। ভবিষ্যতে অবশ্যই ইউরোপীয় মানসম্পন্ন কোম্পানিকে দায়িত্ব দিতে হবে।”

এ শিল্প মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা বলেন, “সিইটিপির ব্যর্থতা বাংলাদেশের চামড়াশিল্পকে শুধু আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলেনি, বরং আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। সরকার এবার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যা অতীতে কখনো দেখা যায়নি। প্রশ্ন একটাই এই তদন্ত এবং প্রতিশ্রুতি কি বাস্তব পদক্ষেপে রূপ নেবে? নাকি আগের মতোই তদন্ত চলবে, কিন্তু সমস্যার সমাধান আসবে না? সচেতন নাগরিক, উদ্যোক্তা ও রপ্তানিকারকেরা আশায় আছেন এবার হয়তো সত্যিকারের জবাবদিহি ও কার্যকর সিইটিপি বাস্তবায়িত হবে। নইলে চামড়া শিল্পের ভবিষ্যৎ রয়ে যাবে গভীর অনিশ্চয়তায়।”

ঢাকা/এএএম/এসবি


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়