ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ইশরাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে করোনা

মেহেদী হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৪, ৯ মার্চ ২০২৪  
ইশরাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে করোনা

শিক্ষকতা করছিলেন একটি স্কুলে। পাশাপাশি ছিল বেশকিছু টিউশনি। চাকরি, টিউশনি, সংসার- সব মিলিয়ে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে ভালোই চলছিল। ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপে প্রভাবিত হন সবার মতো তিনিও। হয়ে পড়েন গৃহবন্দী। চাকরি থাকলেও বন্ধ হয়ে যায় সবগুলো টিউশন। স্বল্প বেতনে মানবেতর জীবন থেকে উদ্ধার পেতে পথ খুঁজছিলেন। খুঁজেও পান, হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা।

বলছিলাম রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ইশরাত জাহানের কথা। শ্বশুড়বাড়ি রাজশাহীতে, স্বামীর চাকরির সুবাদে ২০১৬ সালে রাজধানীতে থাকা শুরু করেন। হোম ইকোনোমিক্স থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করা ইশরাত এরই মধ্যে একটি বে-সরকারি স্কুলে চাকরি শুরু করেন। এখন অবশ্য চাকরিটা আর নেই। ব্যবসা করার প্রবল ইচ্ছার কারণে গত বছর সেপ্টেম্বরে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। 'বাংলার ঐতিহ্য বুটিক হাউজ' নামে ফেসবুক পেজের মাধ্যমে পুরোদমে চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসা।

উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প বলতে গিয়ে তিনি বলেন, করোনার কারণে সবার মতো আমিও তখন চার দেয়ালে বন্দি। টিউশনিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। আবার চাকরিটাও এই আছে, এই নেই। এছাড়া নানা কারণে খুবই মানসিক চাপে ছিলাম। ঘুরে দাঁড়ানোর একটা রাস্তা খুঁজছিলাম। ঠিক তখনই খোঁজ পাই ‘উই’ প্লাটফর্মের।

ইশরাত উই প্লাটফর্মে দেখতে পান তার মতো হাজারো নারী নিজের পরিবারকে সাপোর্ট দিতে কাজ করছেন। তখন তার মনে হয়, এর মাধ্যমে হয়তো তিনি পায়ের নিচের মাটিটা শক্ত করতে পারবেন। তিনি সেখান থেকে কিভাবে খুব অল্প পুঁজি দিয়ে ঘরে বসে উদ্যোক্তা হওয়া এবং অর্থ উপার্জন করার মাধ্যমে পরিবারের পাশে দাঁড়ানো যায়, তা জানতে ও শিখতে পারেন।

সম্পূর্ণ নিজের কিছু একটা হবে এমন স্বপ্ন দেখা শুরু করেন ইশরাত। তার টেক্সটাইল জগতটা তার ভালো লাগতো। এরই ধারাবাহিকতাই বেছে নেন মহিলাদের পোশাক সেক্টর। ইচ্ছে, অন্যের ডিজাইন নয়, নিজের ডিজাইনে নিজের পছন্দমত পোশাকগুলো সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার। সেখান থেকেই নিজের শিক্ষাগত যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে এবং অনলাইনের মাধ্যমে আরও কিছু প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজের শিক্ষাটা আরও পাকাপোক্ত করে নেন এই নারী উদ্যোক্তা।

করোনাকালে কাজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ইশরাত বলেন, ঘরে বসে থাকলে জীবিকার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়, আর জীবিকার জন্য বাহিরে বের হলে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়। দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে শত বাধা পেরিয়ে কাঁচামাল সংগ্রহ করতে যেতাম। খুব সামান্য পুঁজি দিয়ে শুরু করি নিজের উদ্যোগ। কিন্তু কাঁচামাল সংগ্রহ করা ছিল সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, কাঁচামাল সংগ্রহ করতে গিয়ে মনে হতো, অন্য একটা জগতে বসবাস করছি। চারপাশে কেউ নেই, ফাঁকা রাস্তা। ঠিকানা নিয়ে চুপিসারে কাঁচামালগুলো সংগ্রহ করতাম। বাড়ি ফেরার পরে শুনতে হত বাড়িওয়ালাদের নানা কথা। বাসা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি তো ছিলই। এতোকিছুর পরও উদ্যোগটা ধরে রাখতে পেরেছিলাম, কারণ পুরো পরিবার আমার পাশে ছিল। আমার কারণে পুরো পরিবারকে ৫-৬ বার করোনা টেস্ট করতে হয়েছিল এবং আইসোলেশনেও থাকতে হয়েছিল।

যে করোনা হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান কেড়ে নিয়েছে, অনেক বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিতে তালা দিয়েছে, সেই করোনাই তাকে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলেছে।

তিনি গজ কাপড়, ব্লক করার কেমিক্যাল, কাঠের ডাইস, সুতা সংগ্রহ করে ডাইনিং টেবিলে ব্লক করতেন। সারাদিন সংসারের কাজের পাশাপাশি ডাইনিং টেবিলে ব্লকের শাড়ি, থ্রি পিস, বিছানার চাদর ইত্যাদি ডিজাইন করতেন। খাওয়ার সময় সবকিছু নামিয়ে রাখতেন। খাওয়া শেষ করে আবার ডাইনিং টেবিলে ব্লকের সব সরঞ্জাম নিয়ে শুরু করতেন কাজ।

এভাবেই দেড় বছর বাসার ডাইনিং টেবিলেই ব্লকের কাজ করেন ইশরাত। টাই-ডাইয়ের কাজ করে নিজের উদ্যোগকে একটু একটু করে বড় করতে থাকেন তিনি। করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ২০২১ সালের মাঝামাঝি ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া নেন। রাখেন তিনজন সহকারি সেখানে শুরু করেন ব্লক, বাটিক, স্ক্রিন প্রিন্টের কাজ। আর একটু প্রসারিত হলে রেডি পোশাকের জন্য আরও দুজন কর্মী রাখেন তিনি। দেশি পোশাক নিয়ে কাজ করার কারণে হাতের কাজের জন্য আরও ৪-৫ জন কর্মী রাখতে হয় তার। দাঁড়িয়ে যায় ছোটখাটো একটি কারখানা।

তিনি বলেন, আমাদের দেশি কাপড়ের সঙ্গে মিল থেকে সরাসরি সুতি কাপড়, রাজশাহীর সফট সিল্ক ও রাজশাহী মুসলিন কাপড় সংগ্রহ করতাম। তারপর সেগুলো নিজেরাই ডাইং, ব্লক, স্ক্রিন প্রিন্ট ও এমব্রোডারি করে শাড়ি, থ্রি-পিস, ওড়না, পাঞ্জাবি, ওয়ান পিস, কুর্তি ইত্যাদি পোশাক তৈরি করতে থাকি।

আত্মীয়, পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করে চেনা-অচেনা সবাই হয়ে ওঠে আস্তে আস্তে তার পণ্যের ক্রেতা। বাজারে হাজার হাজার বিদেশি ঝলমলে পোশাকের মাঝে ক্রেতারা তার ডিজাইন করা দেশি পোশাক যখন পছন্দ করেন, তখনই তিনি নিজেকে স্বার্থক মনে করেন।

অবশ্য তার দোকানটি গত বছর নভেম্বরে ছেড়ে দেন, সঙ্গে দীর্ঘ সাত বছরের শিক্ষকতার চাকরিটাও। কারণ তিনি নতুন করে শুরু করতে চান। হতে চান একজন বড় ব্যবসায়ী, সৃষ্টি করতে চান নতুন নতুন কর্মসংস্থান। তবে পুরোদমে কারখানা এবং 'বাংলার ঐতিহ্য বুটিক হাউজ' এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রি চলছে।

যারা উদ্যোক্তা হতে চান, তাদের উদ্দেশ্যে ইশরাত বলেন, যেকোনো কাজ করার আগে সে সম্বন্ধে একটা ভালো ধারণা বা অভিজ্ঞতা থাকা উচিত। এতে কাজ হবে যেমন সুন্দর, তেমনি ক্রেতারা পাবে ভালোমানের পণ্য। আর যেকোনো কাজের জন্য প্রশিক্ষণ খুব দরকার। আমি এখনো বিভিন্ন ধরনের ট্রেনিং করে থাকি। আমার উদ্যোগকে আরও বড় করার জন্য, সহকর্মীদেরকে শেখানোর জন্য নিজে প্রশিক্ষণ নেই এবং কর্মীদেরকে প্রশিক্ষণ দেই।

তিনি বলেন, বিদেশি পোশাকের ভিড়ে দেশের মানুষকে দেশি পোশাক পরিধানে আগ্রহী করে তুলতে, নিজের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি আরও ১০ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারা সবচেয়ে আনন্দের। এজন্য সবাইকে বলবো, চাকরির পেছনে না ছুটে, আসুন উদ্যোক্তা হই। নিজের কর্মসংস্থান নিজে তৈরি করে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখি। নিজের পাশাপাশি ১০ জনের কর্মসংস্থান তৈরি করে দেশের বেকারত্ব মোচনে সহায়তা করি।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়