ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব’ বইটি ঐতিহাসিক দলিল

মাহামুদুল হক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ২৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:২০, ৫ এপ্রিল ২০২১
‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব’ বইটি ঐতিহাসিক দলিল

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (১৯৬৭-৬৯) সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদ্য উত্তীর্ণ দুই তরুণ ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরজিৎ ঘোষাল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহের জন‌্য বাংলাদেশে আসেন। এরপর আর তাদের খোজ মেলেনি। ধারণা করা হয়, তারা রণাঙ্গনে শহীদ হয়েছেন। শুধু এই দুজন নন, মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন কলকাতার অনেক সাংবাদিক। কলকাতার লেখক-সাংবাদিক তথা সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে।

কলকাতা প্রেসক্লাবও বাদ যায়নি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনায়। অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার নিরব সাক্ষী কলকাতা প্রেসক্লাব। এর মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম অন্যতম। অসিযুদ্ধের সঙ্গে মসিযুদ্ধও চলত সমান তালে কলকাতা প্রেসক্লাবে ও কলকাতার গণমাধ্যমে। তবে বেশিরভাগ কলমযুদ্ধ কলকাতা থেকেই হতো। কারণ, যুদ্ধরত বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের কালি-কলম নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে, কলকাতার সাংবাদিকরা খবর সংগ্রহ করেছেন রণাঙ্গন থেকে। কলকাতা প্রেসক্লাবে বসে মুক্তিযুদ্ধের খবর লিখেছেন, বিদেশি গণমাধ্যমকর্মীদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। প্রতিবেশী দেশ ভারতে যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলমযুদ্ধ চলেছে তা বিশ্বের অন্য কোনো যুদ্ধের ইতিহাসে দেখা যায়নি। বিবিসি, আকাশবাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর আর ভারতের ছোট-বড়-মেজো-সেজো সব সংবাদপত্র যুদ্ধের খবর প্রচারে ব্যস্ত থেকেছে।

সে সময় বাংলাদেশের খবরই প্রধান খবর ছিল ভারতে। কলকাতার সাংবাদিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হামলা ও হত্যাকাণ্ডের সব খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছেন। রণাঙ্গনের ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে সবকিছুর দ্রষ্টা হয়ে রিপোর্টাররা লিখেছেন। কলকাতার রিপোর্টাররা সে সময় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের কলমযোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ সরকার ভোলেনি সেসব কলমযোদ্ধাদের। মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে তাদের সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। কলকাতার সাংবাদিকদের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং যুদ্ধের নির্মমতা ও হত্যাযজ্ঞের অজানা সব কাহিনী বর্ণিত হয়েছে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব’ শীর্ষক সংকলনে।

প্রথমেই ভারতীয় ওই দুই নির্ভীক শহীদ সাংবাদিককে উৎসর্গ করে তাদের অবদানের স্বীকারোক্তির চিহ্ন এঁকেছেন গ্রন্থস্বত্বাধিকারী। বইয়ের প্রায় অর্ধশত পৃষ্ঠায় ওই সময়ে কলকাতার গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশিষ্ট লেখক ও সাংবাদিকদের লেখা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কলাম/মতামত স্থান পেয়েছে। সেসব তথ্যবহুল লেখা পত্রিকার পাতা থেকে তুলে এনে স্থান দেওয়া হয়েছে এই বইয়ে। এসব লেখা কলকাতার সংবাদমাধ্যম কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের মর্মস্পর্শী ভূমিকাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সুনীল বসুর মতো প্রথিতযশা লেখক-সাংবাদিকরা মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে লেখনির মাধ্যমে সংহতি জানিয়েছিলেন। এছাড়া, ৪৭ জন প্রথিতযশা সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধে কীভাবে খবর সংগ্রহ করেছেন, খবর ব্যবস্থাপনা করেছেন, কীভাবে দেখেছেন মুক্তিযুদ্ধ— এসব অভিজ্ঞতা-সাক্ষ্য বর্ণনাসহ তাদের প্রবন্ধে অজানা ইতিহাস রচিত হয়েছে। ৩৬৮ পৃষ্ঠার বইটি একটি প্রবন্ধ শুধু ইংরেজিতে লেখা। বাকি সবই সাবলীল বাংলায় পশ্চিম বাংলার ভাষারীতিতে রচিত।

‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: কলকাতার সাংবাদিক কলকাতা প্রেসক্লাব‘ বইটি সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর। ২০১৯ সালে কলকাতা প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৭৫তম বর্ষ উপলক্ষে বইটি প্রথম প্রকাশ করে কলকাতা প্রেসক্লাব। ২০২০ সালে বইটি ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন বাংলাদেশ জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এবছর বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করা হয়েছে। নিপুণভাবে শব্দসজ্জা-পৃষ্ঠাসজ্জাসহ পুনঃমুদ্রণে গ্রন্থের অবয়বে মুকুট পরিয়েছে ঢাকার ফ্রেন্ডশিপ প্রিন্টার্স। ঢাকা প্রকাশনার দ্বিতীয় সংস্করণে বইটির দাম ধরা হয়েছে ৮৫০ টাকা।    

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। আর কলকাতা ছিল মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী দপ্তর ও লাখ লাখ বাংলাদেশি শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। এসব কারণেই ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই কলকাতা আন্তর্জাতিক সংবাদ সংগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশ্বের প্রথম শ্রেণির নিউজ এজেন্সি থেকে শুরু করে ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপানের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা প্রায়ই কলকাতায় যেতেন বাংলাদেশের খবর সংগ্রহের জন্য। ব্রিটেনের টেলিগ্রাফ, টাইমস, গার্ডিয়ানও বাদ যায়নি। সংবাদমাধ্যম, শরণার্থী, ত্রাণ প্রতিষ্ঠান, কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, আমলা-মন্ত্রী গোয়েন্দাসহ সবাই কলকাতায়। সোভিয়েত ইউনিয়নের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, আমেরিকান সিনেটর, জাতিসংঘের মহাসচিব থেকে আগা খান পর্যন্ত যুদ্ধের অবস্থা জানতে কলকাতায় এসেছেন। বাংলাদেশের যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা প্রেসক্লাবে কমপক্ষে চারবার এসেছেন এবং দুবার সংবাদ সম্মেলন করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধ কাভার করার জন্য কলকাতার গ্র‌্যান্ড হোটেল হয়ে ওঠে বিদেশি সাংবাদিকদের আস্তানা। কেউ আসেন খবর সংগ্রহ করতে, কেউ খবর হতে। কলকাতার সংবাদ মাধ্যমের সংবাদ ও ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। বিশ্ববাসী জানতে পারে মুক্তিকামী জনগণের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পৈশাচিক বর্বরতা। এভাবেই বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে তৎকালীন কলকাতার সাংবাদিকরা অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন এই গ্রন্থে। 

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই আমেরিকা ও পাকিস্তান সাড়ে ৭ কোটি বাঙালিকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। মুজিবনগর সরকারের বিদেশমন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ, তার সচিব মহাবুবুল আলম চাষী, সাংবাদিক তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও চার-পাঁচজন মিলে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে তারা ভাষণ দেবেন এই বলে যে, তারা স্বাধীনতা চান না, পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চান। রাওয়ালপিন্ডিতে প্রস্তুতকৃত ভাষণের ওই খসড়াটি ভারতীয় গোয়েন্দোদের হাতে আসে। নিউইয়র্কের যাত্রার জন্য বিমানে ওঠার আগেই ভারতীয় গোয়েন্দারা ধরে ফেলেন তাদের। গোয়েন্দাদের ইঙ্গিতে সাংবাদিকরা বিমানবন্দরে যান। দেখেন কীভাবে ওই ষড়যন্ত্রের যাত্রা ভণ্ডুল করে দিলো ভারতীয় গোয়েন্দারা।

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে বর্তমান চুয়াডাঙ্গায় ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে আমেরিকান সাংবাদিকের বাকযুদ্ধ হয়। কারণ, ওই আমেরিকান সাংবাদিক ভারতীয় সাংবাদিকের কাছে জানতে চান, ইজ ইট ইস্ট পকিস্তান? ভারতের পিটিআইয়ের রিপোর্টাররা উত্তরে বলেছিলেন, নো, দিস ইজ বাংলাদেশ। ইতিহাসের এমন চরম সত্য ঘটনা সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখনিতে উঠে এসেছে, স্থান পেয়েছে এ বইয়ে। তাই বইটি ইতিহাসের আরেকটি আকর গ্রন্থ বলা যায় নির্দ্বিধায়।

গ্রন্থের বাংলাদেশ সংস্করণের প্রকাশক জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কত বড়, কত বিস্তৃত ছিল তার আরেকটি উদাহারণ মেলে এ বইয়ে, যেখানে ভারতের সব বিখ্যাত সাংবাদিক মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার বয়ান করেছেন। ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করেছে। কারণ, ভিন্ন দেশের সংবাদিকদের ভাষ্য বিশ্ববাসীর কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠে। বাংলাদেশের ইতিহাস জানতে বর্তমান প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, সিক্রেটস ডকুমেন্টসের মতো আকর গ্রন্থগুলো অবশ্যই পড়তে হবে। এছাড়া, সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতায় মুক্তিযুদ্ধকে জানার জন্য আবশ্যকীয় পাঠ্য এ বইও।’ মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ভারতের দুই তরুণ শহীদ সাংবাদিককে স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ইন্দিরা গান্ধীসহ ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কলমযোদ্ধাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।    

কলকাতা প্রেসক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস সুর তার গ্রন্থাভাষে বলেছেন, ‘একটি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিবেশী দেশের সহায়তা এবং এর ফলে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম, এই বিশাল কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের অভিজ্ঞতায় ভরা এই সংকলন গ্রন্থটি এক ঐতিহাসিক দলিল...।’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে বইটি ইতিহাসের নতুন দলিল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে, যা মুক্তিযুদ্ধের অনেক অজানা ইতিহাস জানাবে। বইটি সাংবাদিক, শিক্ষার্থী, গবেষকসহ ইতিহাসপিপাসুদের জ্ঞানপিপাসা মেটাবে বলেই আমার বিশ্বাস।

সাংবাদিকরা ইতিহাসের স্রষ্ট্রা নন, ইতিহাসের দ্রষ্ট্রা। ইতিহাসের নির্মম সত্য উৎঘটিত হয় সাংবাদিকদের লেখনিতে। গ্রন্থখানি সাংবাদিক তথা কলমযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা-সমৃদ্ধ লেখনিতে ভরপুর বাংলাদেশের ঐতিহাসিক তথ্যের নিরেট দলিল। অসিযুদ্ধ, মসিযুদ্ধ ও বাকযুদ্ধের ফলেই এই স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ। এসবের বয়ান-বিবরণ উঠে এসেছে কলমযোদ্ধাদের লেখনিতে। তাই বইটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে অবশ্য পাঠ্য। 

লেখক: শিক্ষক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এবং স্থায়ী সদস্য, জাতীয় প্রেসক্লাব।

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়