ফুলের ভাষা যদি বুঝি
পলাশ মজুমদার || রাইজিংবিডি.কম
তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে পড়ি। একটি ঘটনায় আমি বেশ আলোড়িত। এক নিকটাত্মীয় বাসায় এসে বিপদ ডেকে এনেছিলেন আমার। সেই অস্থিরতার সময়কে ধরার জন্য প্রেক্ষাপটটিকে চিহ্নিত করি। তারপর ধীরে ধীরে তার ভেতর কিছু অভিজ্ঞতা ও জীবন-দর্শনকে প্রোথিত করতে ব্রতী হই।
আত্মজীবনী রচনার ইচ্ছে থাকলেও কোনো কারণে মন চায় না। কী আর হবে মানুষকে জানিয়ে। সেরকম কোনো ইচ্ছে কখনো লালন করিনি। উপন্যাসটি আত্মজীবনীর আদলে লেখা হলেও এটা আমার আত্মজীবনী নয়।
২০০৫ সালের গোড়ার দিকে কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমানের সম্পাদনায় যখন ‘সম্প্রীতি’ নামে মাসিক সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, তখন উপন্যাসটিকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বেছে নিই। অপ্রকাশিত হলেও সেই হিসেবে এটি আমার প্রথম উপন্যাস।
দীর্ঘ দুই বছর ধরে উপন্যাসটি সম্প্রীতি পত্রিকায় প্রকাশের সময় ব্যাপক সাড়া পড়ে। লেখকের জায়গায় ছদ্মনাম নাম ব্যবহার করায় পাঠকের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন আমাকে খুশি করলেও তৃপ্ত করতে পারেনি। সেসব কাঁচা হাতের লেখা। সত্য বলতে, তখন জানতাম না লেখার কলাকৌশল। তারপর পেরিয়ে গেলো ১৪ বছর। ভুলে গিয়েছিলাম উপন্যাসটির কথা।
২০২০ সালের একুশে বইমেলায় বিদ্যাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয় আমার গল্পগ্রন্থ ‘হরিশংকরের বাড়ি’। বইটি সংগ্রহ করতে মেলায় এসেছিল ছোট ভাই অনীক বিশ্বাস ও জুবায়ের শিবলী রাব্বি। তারা দুজনে আলাদা আলাদাভাবে আমাকে মনে করিয়ে দিল ‘উত্তম পুরুষ’ উপন্যাসটির কথা।
‘ধুর ছাই’ কিছু হয়নি একথা বলে হেসে উড়িয়ে দিয়েছি; তবু ওদের অনুরোধ ছিল, ‘উত্তম পুরুষ’ বই আকারে বের করা যায় কিনা ভেবে দেখুন।
তাদের তখন আর কিছু বলিনি।
বইমেলা শেষ না হতেই করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে আটকা পড়ি। প্রায় ৭০ দিন গৃহবন্দী। অফিস বন্ধ। সুদীর্ঘ অবসরে অনেক লেখার কাজ যখন এগিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ মনে পড়ে ওদের সেই অনুরোধের কথা। প্রায় এক যুগ আগের পুরানো পত্রিকাগুলো নামিয়ে ঘাঁটতে থাকি। কিছুটা অনিচ্ছায় কিছুটা কৌতূহলের বশে খণ্ড খণ্ড লেখাগুলো ল্যাপটপে টাইপ করতে থাকি। তবে ধীরে।
প্রায় ২৫,০০০ শব্দ হয়ে গেলো। খেয়াল করলাম, পড়তেও খারাপ লাগছে না। এর মধ্যে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জল অনেক গড়িয়েছে; লেখার প্রতি অনেকটা বিশ্বাস ফিরে এসেছে। ইতিমধ্যে পেয়েছি অনেক অচেনা পাঠকের ভালোবাসা; তারা আমার লেখার প্রতি প্রীতি দেখিয়েছেন যা আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।
সেই আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে লেখাটায় আবার হাত দিই। সম্পাদনা করতে থাকি। সহধর্মিণীকে কিছু অংশ শোনাতেই সে তার মতামত ব্যক্ত করে, কিছু জায়গায় সংশোধন প্রয়োজন; আর তা করতে পারলে ভালো একটি উপন্যাস হতে পারে। তার কথায় আরও মনোযোগী হই; ছুরি-কাচি হাতে ব্যাপক কাটা-ছেঁড়া চালাই। অবিরাম চলতে থাকে সংযোজন-বিয়োজন। মনে হচ্ছিল, না খারাপ হবে না।
সব সময় মনে হয়, আমার কানে যা ভালো লাগবে না তা পাঠকের কাছে উপদ্রব মনে হতে পারে। এই ধারণা থেকে কোনো লেখাকে আলোর মুখ দেখাতে চরম মাত্রায় কুণ্ঠিত। নিজের মনঃপূত হলেই কেবল কোনো রচনা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিই। নচেৎ পড়ে থাকে বছরের পর বছর। কেউ তো আর মাথার দিব্যি দেয়নি যে প্রকাশ করতেই হবে।
সময়ের হাতে সব ছেড়ে দিয়ে বরাবরই নির্ভার থাকতে চেয়েছি। ছোট্ট জীবনে চাপ নিয়ে কী লাভ! আজ আছি, কাল পৃথিবীতে নাও থাকতে পারি। ক্ষণস্থায়ী মানবজীবনকে পড়ে পাওয়া ধন বলেই বিবেচনা করে এসেছি; ভেবেছি এর সর্বোকৃষ্ট ব্যবহার নিয়ে। তখনই লালন হানা দিয়েছে মনের ঘরে—এমন মানবজনম আর কী হবে/মন যা করো ত্বরাই করো এই ভবে। মনে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের কথা—পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়/পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়; কিংবা জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ/ ধন্য হলো ধন্য হলো মানবজীবন।
এক পর্যায়ে মনে হলো, ‘উত্তম পুরুষ’ নামটি চলে না; কারণ এই নামে আছে রশীদ করিমের বিখ্যাত উপন্যাস। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে নাম রাখলাম ‘ফুলের ভাষা যদি বুঝি’। এমন নামকরণের পেছনে যথেষ্ট যুক্তি আছে। উপন্যাসের কাহিনি বিধৃত হয়েছে স্মৃতিচারণমূলক আত্মজীবনী আকারে। চল্লিশ বছর বয়সে দেশান্তরী হয়ে ফেলে যাওয়া দিনের কথা স্মরণ করেছি। ডায়েরি লেখার মতো লিপিবদ্ধ করতে চেয়েছি পুরানো সেই দিনের কথা।
/সাইফ/