ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

বাবা আমার রিয়েল হিরো

শাম্মী তুলতুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৩, ২০ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
বাবা আমার রিয়েল হিরো

বাবাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে কোনও ভাষাই খুঁজে পাইনা। তবুও এই শিহরিত শব্দটিকে একটিমাত্র মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় তা হলো নিজের লেখায়।

নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে সন্তানের উন্নত একটা জীবন দান করেন সৃষ্টিকর্তার পর তিনি হলেন বাবা। বাবা একটি শব্দ। এর সাথে জড়িয়ে থাকে হাজারো স্মৃতি। এই সুন্দর পৃথিবীতে মানুষের শ্রেষ্ঠ সম্পদ হলো মা-বাবা। বাবা তিনি সাধারণ কেউ নন। সুপারম্যান কিংবা ব্যাটম্যানের চেয়েও অসাধারণ কেউ। রোদ, বৃষ্টি থেকে বাঁচাতে মাথার ওপর যে কেউই ছাতা হতে পারে, কিন্তু বটবৃক্ষের মতো শীতল ছায়া যে কেউ দিতে পারে না। বটবৃক্ষ হয়ে মাথার ওপর থাকেন ‘বাবা’। বৃক্ষ যেমন ছায়া দেয় ফল দেয় কাঠ দেয়, দেয় বাঁচার জন্য অক্সিজেন। তেমনি বাবাও দেন ছায়া, অক্সিজেন। দেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার নিজস্ব একটি আত্মপরিচয়।

মাথার ওপর থেকে ছায়া সরে গেলেই টের পাওয়া যায়, কঠিন এই জীবনটা কেউ একজন অনেক সহজ করে দিয়েছিলেন। আমাদের জীবন অতো সহজ নয়, যতটা আমরা মনে করি।

আমি এমন একটি পরিবারে জন্মেছি যেখানে শুধু আভিজাত্যের ছোঁয়া পেয়েছি। পেয়েছি হাত বাড়ালেই সব। কিন্তু হাত বাড়ালেই যাদুর মতো যিনি হাতে এনে দিয়েছেন তার শুরুটা আমার মতো ছিল না। ছিল অনেক সংগ্রামের। বলছি সেই একজন বাবার গল্প। মানুষ ক্ষুদ্র জীবনে কত কিছুই না করেন। পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা জাহির না করে নিরবে  নিভৃতে  সমাজ সেবা পরিবার তথা দুর্বল মানুষের পাশে ছায়া হয়ে থাকেন তেমনি একজন সাদা মনের মানুষ আলহাজ আবু মোহাম্মদ খালেদ।

যিনি শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক একজন ব্যাবসায়ী। চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামে মরহুম আব্দুল কুদ্দুস মাস্টার ও রাবেয়া খাতুনের ঘর আলোকিত করে ১৯৫২ সালে জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণের ফলে  এই দম্পতি  মহাখুশী। আদরের সন্তানের নাম রাখলেন খালেদ। মা-বাবা ভাই-বোন নিয়ে তাদের পরিবার চলছিল ভালোই। তার বাবা কুদ্দুস মাস্টার ছিলেন শিক্ষক। হঠাৎ তিনি অবসর নেন। এসএসসি পাস করার পরই সেই চাকরিতে জয়েন করেন খালেদ। সংসারের হাল ধরেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে। অঢেল জমির মালিক হলেও কিন্তু সেই জমিতে তো আর পয়সা বেরুবে না। তার বাবা যখন জমি বিক্রি করতে চাইতেন ছেলে বাধ সাধতেন। বলতেন বিক্রি করলেই তো সব শেষ। আমি নিজেই কিছু করবো। কুদ্দুস মাস্টারের সর্বোচ্চ চেষ্টা ছিল আগে পারিবারিক সুশিক্ষা, ধর্মীয়, সামাজিক মূল্যবোধ আর নীতি- নৈতিকতার শিক্ষায় মানুষ করতে সন্তানদের। সেভাবে তৈরি করেছিলেন প্রথম সন্তানকে। বাবাকে কথা  দিয়েছেন নিজেই হাল ধরবেন কিন্তু কীভাবে? এই সংসার যে বিশাল বড়। এতটুকু একটা কিশোর কেমন করে কীভাবে এত বিশাল পরিবারে নির্ভরতার জায়গা হবেন তা ভেবেই চিন্তিত। এদিকে আবার বাবার আদেশ পড়াশোনা বাদ দেওয়া যাবে না। পড়াশোনাও চালিয়ে যেতে হবে।

স্কুলের চাকরিতে আর কত টাকা মাইনে? ঘরে আছে নিজেসহ সাত ভাই, সাত বোনের পরিবার। সদস্য সংখ্যা ১৪ জন।  শেষমেষ নিজ সিদ্ধান্ত মতে জীবিকার টানে চলে আসেন শিক্ষতা ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে। অনেক ঘোরাঘোরি শেষে চাকরি নেন একটি ফ্যান কোম্পানিতে। পাশাপাশি সরকারি সিটি কলেজে ভর্তি হন  নাইট শিফটে। রাতে ক্লাস, সকালে চাকরি—এভাবেই শুরু হয়  জীবনের নতুন ধাপ। ভাই-বোন সবার পড়ার খরচ সংসারের খরচ একাই বহন করতে শুরু করলেন। ভাই-বোনদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। পাশাপাশি লোন করে সাতটি বোনের একের পর এক বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব  চলছিল। অবাক ব্যাপার প্রত‌্যেক  ভাই-বোনকে সুশিক্ষায় গড়ে তুলেছিলেন। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ। দেশে শুরু হয়ে গেছে পাকিস্তানি তাণ্ডপ।

ঘরে বসে থাকা দায়। দেশপ্রেম তো আর মন থেকে যায় না। যে ছেলে মাটিতে গড়াগড়ি করে বড় হয়েছে সেই মাটি শত্রুর দখল করবে এটা আর কেউ মানলেও খালেদ মেনে নিতে পারেনি। এছাড়া তার বাবা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন দেশের জন্য জেল খেটেছেন। এমন বাবার সন্তান দেশ বাঁচানোতে পিছ পা হবেন ভাবতেই পারেন না। ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুক্তিযুদ্ধে। একটি মিশনে গুলিতে প্রায় প্রাণ যায় যায় কিন্তু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তিনি।  অবশেষে  দেশ স্বাধীন করে ক্যাম্প থেকে ফিরে এলেন নিজ বাড়ি। বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। বিয়ের পর প্রথম সন্তান মারা যায়। এরপর হয় আমার বড় বোন, তারপর আরও একটি বোন মারা যান। তারপরে জন্ম হয় আমার। বাবার বড় আদরের সন্তান ছিলাম আমি। একের পর এক সন্তান হারাতে  আমার বাবা খুব ভয় পেয়ে যান।

আমার মা খুব কড়া ছিলেন। ছেলে মেয়েদের কড়া শাসনে রাখতেন। ছোট বেলায় খুব দূরন্ত আর ডানপিঠে ছিলাম আমি। ছিলাম পড়ালেখায় বড় ফাঁকিবাজ। তাই এই দুষ্টু মেয়েকে বেশি দেখভাল করতে হয়েছে বাবাকেই। সকাল বেলা ঘুম থেকে ডেকে স্কুলের ড্রেস পড়িয়ে নাস্তা করিয়ে টিফিনও রেডি করে দিতেন বাবা। আমাকে স্কুলে দিয়ে তারপর তিনি অফিসে যেতেন।

একটা মজার ব্যাপার হলো একদিন এক ছেলে আমাকে স্কুলে ডিস্টার্ব করতো সেই কথা মা জানতে পেরে চিন্তায় অস্থির হয়ে পরেন। আমার পড়ালেখা প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থা। কিন্তু নাহ আমার বাবার সাপোর্টেই সেদিন এই যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম। আমার মায়ের ভাষ্য ছিল আমি যেমন বিয়ের পরে পড়েছি তুমিও পড়বা। সেদিন যদি বাবা পাশে না থাকতো আজ আমি দেশসেরা কলেজের একজন ছাত্রী হতে পারতাম না।

একদিন পুকুরে পরে গিয়েছিলাম সেই থেকে আমার বাবা আমাকে চোখের আড়াল হতে দিতেন না। টাইফয়েডে জ্বর। বাবা রাত দিন পাশে বসে মাথায় পানি ঢেলে, ওষুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে সব করতেন। নামাজ পরে দোয়া করতেন। আমি আড়চোখে তার লুকানোছলছল করা চোখের পানি দেখতাম। ওষুধে ভালো হতে দেরি হলে হুজুর এনে ঝাড় ফুঁক করাতেন যদি কোনও খারাপ বাতাস সন্তানকে ভর করে। মা সব সময় বলতেন মেয়েদের শরীর খারাপ হলে ছাদে উঠতে নেই। কিন্তু কে শোনে এসব। ছাদে উঠে যেতাম। সেই কথা আমার বাবাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। বাবা-মায়ের সেবায় সে যাত্রায় তিন মাস পর সুস্থ হয়ে উঠলাম।

একদিন হারিয়ে গিয়েছিলাম একটা বিয়ে বাড়িতে গাড়িতে সবাই আছে। কিন্তু আমি নেই। বাবার দুচোখে অস্থিরতা হন্য হয়ে মেয়েকে এদিক খোঁজে ওদিক। কিন্তু সেকি, মেয়েকে পাওয়া গেলো  বিয়ের বাড়িতে টিভির সামনে। যেখানে সব শিশুরা মিলে টিভি দেখছিল।

সেদিন বাবা বুকে জড়িয়ে কান্নাজুড়ে দিলো।এরপর বেড়াতে গেলে বাবার হাতের আঙ্গুল ছাড়তে বারণ।   

বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলে মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার। তিনি সৎ এবং নিতিবান মানুষ ছিলেন। ছেলে-মেয়ের কোথাও ভর্তির পেছনে কখনো সুপারিশ করেননি বলতেন যে হবে সে সৎভাবেই মানুষ হবে নতুবা নয়।

বাবা সবসময় একটি কথা বলেন, আমি তোমাদের জন্য একটি সম্পদ দিয়ে যাচ্ছি তা হলো লেখাপড়া। আমি থাকতে তোমরা লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হও, এটাই আমার চাওয়া। আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিয়ে আমি তোমাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করার চেষ্টা করব। যখন টাকার প্রয়োজন হত, বাবা নিজে থেকেই টাকা দিয়ে বলতো আরও লাগলে বলো। নিজে শত কষ্টের মধ্যে থেকে বুঝতে দিতেন না। বাবার কাছে যখন যা চেয়েছি, পেয়েছি। সংসারের সব দায়িত্ব পালন করার পর বাবার আরেকটি অভ্যাস সমাজসেবা।

আমরা ছয় ভাই বোন সবাই যার যার জায়গায় ভালো অবস্থানে লেখাপড়া করে যাচ্ছি। এখন আমার মা নেই। মারা গেছেন দুই বছর হলো। বাবা-মা দুজনের ভালোবাসা দিয়েই তিনি আমাদের ঘিরে রেখেছেন। বাবা আমাদের মাঝে মা কে দেখতে পান। তিনি রোজ কাঁদেন মায়ের জন্য। এমন দৃশ্য দেখে আমার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। স্ত্রীর জন্য কাঁদতে দেখা এমন মানুষ আমি কম দেখেছি।

বাবার সবচেয়ে ছোট ছেলে আবীর। পড়ে ক্লাস টেনে। মা মারা যাওয়ার পর বাবা শুধু তাকে বুকে জড়িয়ে রাখেন যেন মায়ের অভাব সে বুঝতে না পারে। মা যেভাবে প্রতি রাত তার সব সন্তানকে নামাজ পড়ে ফুঁ দিতেন তেমনি তিনিও করেন। তার খুব বাজে অভ্যাস যেটা তিনি কখনো কাউকে নিজের অসুখের কথা বললেন না। শরীর খারাপ লাগলেও কাউকে কিছু বলতে চান না।

সারাজীবন নিজের ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তানদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন  তিনি হলেন বাবা। বলা হয়না কখনো বাবাকে ভালোবাসি। কিন্তু এই লেখা  দিয়েই বলছি বাবা আপনাকে অনেক অনেক অনেক ভালোবাসি। যার শেষ নেই। পরিমাপ নেই। এই লেখা আপনাকে ভালোবাসি বলার সামান্য প্রমাণ, একটি দলিল।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক



ঢাকা/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়