ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সেই সাহসী ছাত্রই বাঙালির ত্রাণকর্তা

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ১ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সেই সাহসী ছাত্রই বাঙালির ত্রাণকর্তা

কেএমএ হাসনাত : অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনিস্টিউট মিশন স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। পরিদর্শন শেষে  ছিপছিপে লম্বা এক ছাত্রের নেতৃত্বে একদল ছাত্র তার পথ অরোধ করে দাঁড়ায়। শেরে বাংলা কারণ জানতে চাইলে লম্বা ছাত্রটি তাদের জরাজীর্ণ স্কুল মেরামতের দাবি জানায়। শেরে বাংলা সেই ছাত্রের সাহসে বিমোহিত হয়ে সেদিন তাৎক্ষনিকভাবে স্কুল মেরামতের প্রতিশ্রুতি দেন।

সেদিনের সেই সাহসী ছাত্র আর কেউ নন তিনি বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।  পরবর্তীতে যিনি হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা।

তৎকালীন ফরিদপুর মহুকুমাধীন গোপালগঞ্জের মধুমতি আর ঘাগোর নদীর তীরে এবং হাওড়-বাঁওড়ের মিলনে গড়ে ওঠা প্রাকৃতিক পরিবেশে ছায়া ঘেরা টুঙ্গিপাড়া। তখনো অজঁপাড়া। তবে দু’একটি বনেদী পরিবার সেখানে বসবাস  করতো। টুঙ্গিপাড়ার একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। এই পরিবারের উত্তরসূরী শেখ হামিদ একটি টিনের ঘর তৈরি করে সেখানে পরিজন নিয়ে বসবাস শুরু করেন। শেখ হামিদের একমাত্র পুত্র শেখ লুৎ্ফর রহমান একজন সজ্জন ব্যক্তি। গোপালগঞ্জ শহরে সবেমাত্র সরকারি চাকরি নিয়েছেন।

কথিত আছে, শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষ ছিলেন শেখ আউয়াল। যিনি মোগল শাসনামলে বাগদাদ থেকে বাংলায় আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচার  করতে। সেই শেখ আউয়ালেরই বংশধর শেখ আব্দুল হামিদ। আর শেখ আব্দুল হামিদের পুত্র শেখ লুৎফর রহমান যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুৎফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নেয় একটি ফুটফুটে শিশু। পিতা-মাতা আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। এই খোকাই হলেন আমাদের প্রিয় নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুম শেখ মুজিবুর রহমান।  বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের সংসারে চার বোন এবং দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বড় বোন ফাতেমা, মেজ বোন আছিয়া, সেজ বোন হেলেনা ও ছোট বোন লাইলী বেগম। একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম ছিল শেখ আবু নাসের।

বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত টুঙ্গিপাড়ায়। টুঙ্গীপাড়া গ্রামেই শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে বড়  হয়েছেন। তিনি দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে।

গ্রাম বাংলার মাটি আর মানুষ তাঁকে ভীষনভাবে আকর্ষণ করতো। তিনি গ্রামের মানুষদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না সেই ছোটবেলা থেকে গভীরভাবে অনুধাবন করেন। শৈশব থেকে তৎকালীন সমাজ জীবনে তিনি জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু, মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহাওয়ায় তিনি দীক্ষা পান অসাম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি গরীব মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাঁকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে।

বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাঁকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে, সে যত বড়ই হোক, আত্মসমর্পন করেননি; মাথানত করেননি।

টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল একটি কাছারি ঘর। সেখানেই মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলভী সাহেবদের কাছে  মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে  লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর তিনি বাবার কর্মস্থল গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুরে পড়াশোনা করেন। ১৯৪২ সালে এসএসসি এবং ১৯৪৭ সালে কলকাতার অধীনস্থ ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

এ সময়ে শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবনের সংগ্রামী অধ্যায়। শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তাঁর গৃহশিক্ষক। তাঁর এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করেছেন।

একবার অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ পরদর্শনে আসেন। সাহসী কিশোর মুজিব সেবার স্কুল ঘর মেরামত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আদায় করেন। এর কিছুদিন পরে গোপালগঞ্জে সরকার সমর্থকদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে জীবনে প্রথম গ্রেফতার বরণ করেন। এরপরেও তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে কখনো আপোষ না করায় অনেকবার কারাবরণ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু ছোটদেরকে ভীষণ ভালোবাসতেন। কচিকাঁচার মেলা ও খেলাঘর ছিল তাঁর প্রিয় সংগঠন। কৈশোরে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কচিকাঁচার আসরে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের শেষ দিনটি তিনি কাটিয়েছেন এই সংগঠনের ভাই-বোনদের মাঝে। আর তাই ১৭ মার্চ তাঁর জন্মদিনটিকে এখন আমরা জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করি। শিশুদের কাছে দিনটি আনন্দ-খুশির।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় লাভের পর পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি লাভ করে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশে ফিরে এসে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও পুনর্বাসনের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি মাত্র সাড়ে তিন বছর বেঁচে ছিলেন। মানবতার শত্রু কতিপয় বিপথগামী ঘৃণ্য ঘাতকের দল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নামই নয়, একটি দেশের, একটি জাতির রূপকার। যাঁর নেতৃত্বে, যাঁর অসীম ত্যাগ ও সংগ্রামে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের তিনি ছিলেন প্রকৃত বন্ধু। অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা ছিল তাঁর বাংলার জনগণের জন্য। পরিবার পরিজনসহ নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন তিনি বাংলার মাটি ও মানুষের কত আপন ছিলেন। স্বাধীনতা লাভের পর টুঙ্গীপাড়াকে পৃথক থানা ঘোষণা করা হয়। গোপালগঞ্জের সবুজ শ্যামল টুঙ্গিপাড়াতেই এখন চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন আমাদের সেই খোকা, মুজিব ভাই, বঙ্গবন্ধু এবং জাতির পিতা।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ আগস্ট ২০১৯/হাসনাত/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ