ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ প্রাণহানির নেপথ্যে

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১০, ৯ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১২:২৯, ৯ জানুয়ারি ২০২৩
এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডে ২৬ প্রাণহানির নেপথ্যে

ফাইল ছবি

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ বনানীর কামাল আতাতুর্ক অ্যাভিনিউয়ের পাশের ১৭ নম্বর সড়কে ফারুক রূপায়ন (এফআর) টাওয়ারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ঘটনাস্থলে ২৫ জন ও হাসপাতালে ১ জন নিহত হন। আহত হন ৭১ জন। ওই ঘটনায় বনানী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মিল্টন দত্ত বাদী হয়ে মামলা করেন।

মামলায় এফআর টাওয়ারের ১৯ তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত বর্ধিত অংশের মালিক বিএনপি নেতা তাসভিরুল ইসলাম, ভবনের জমির মালিক প্রকৌশলী এস এম এইচ আই ফারুক, রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান ওরফে মুকুলকে আসামি করা হয়।

ঘটনার প্রায় তিন বছর ৯ মাস পর গত ২০ ডিসেম্বর মামলা তদন্ত শেষে ৮ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেন ডিবি পুলিশের গুলশান জোনাল টিমের পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) সমীর চন্দ্র সূত্রধর। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন-এফআর টাওয়ার ভবনের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে থাকা এস এম এইচ আই ফারুক, তাজভিরুল ইসলাম, সেলিম উল্লাহ, এ এ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আমিনুর রহমান, মিসেস ওরদা ইকবাল, কাজী মাহমুদুন নবী ও রফিকুল।

তবে লিয়াকত আলী খান মুকুলের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা।

গত ২৭ ডিসেম্বর মামলার ধার্য তারিখ ছিলো। ওই দিন চার্জশিটটি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আরফাতুল রাকিবের আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তবে আদালত চার্জশিটটি গ্রহণ না করে মামলাটি পুলিশ বুরো অফ ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)  অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। আগামী ২ ফেব্রুয়ারি অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ধার্য করেন আদালত।

আদেশে আদালত বলেন, অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জন মানুষ মৃত্যুবরণসহ অসংখ্য মানুষ আঘাতপ্রাপ্ত হন। তদন্ত কর্মকর্তা এজাহারনামীয় গুরুত্বপূর্ণ আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতির আবেদন করেছেন। মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হওয়ায় পিবিআইয়ের  একজন দক্ষ অফিসার দ্বারা মামলাটি  অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন। পিবিআইয়ের অতিরিক্ত মহাপুলিশ পরিদর্শককে বিষয়টি অবহিত করতে বলেন আদালত।  

যে কারণে প্রাণহানি ঘটে:
চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্ত সমীর চন্দ্র সূত্রধর বলেন, এফআর টাওয়ারের অ্যাডহক কমিটির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এসএমএইচআই ফারুক ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি তাজভীরুল ইসলামের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কারণে দ্বন্দ্ব চলে আসছিল। এর জেরে তাদের মধ্যে একাধিক মামলা চলছে। নিজ নিজ কমিটি দিয়ে ওই বিল্ডিংয়ের কাজকর্ম পরিচালনা করার কারণে বিল্ডিংয়ের সামগ্রিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়। এক্ষেত্রে এ দুই আসামি নিজ নিজ বলয় তৈরি করে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন প্রকারের দ্বন্দ্ব থাকার কারণে এফআর টাওয়ারে কোনো ধরনের পরিচর্যা ছিল না। যার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন ফ্ল্যাট ওনারগণ ইচ্ছেমত তাদের ফ্ল্যাটের আশপাশে যে ফাঁকা জায়গা ছিল সেখানে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র রেখে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য বিল্ডিংয়ের ফায়ার এক্সিট বন্ধ করে ফেলে। তাছাড়া প্রশিক্ষিত সিকিউরিটি বা দক্ষ জনবল রাখার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও দ্বন্দ্ব থাকার কারণে সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। ফায়ার এক্সিট বন্ধ থাকায় জরুরি নির্গমন প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয় এবং রুমের সামনে ফাঁকা জায়গায় বিভিন্ন প্রকারের মালামাল থাকার কারণে বিল্ডিংয়ে বসবাসরত লোকজন দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে পারে নাই। যার ফলশ্রুতিতে ২৬ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এবং ৭১ জন আহত হন।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, বিল্ডিংয়ের নিয়মিত পরিচর্যা বা মিটিং না করার ফলে ওই ঘটনার জন্য ফারুক ও তাজভীরুল ইসলামসহ পরিচালনা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে দ্বন্দ্ব থাকায় পরিচালনা কমিটি বিল্ডিং নিরাপত্তার কোনো ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ায় এ অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার সাথে পরিচালনা কমিটির সবাই সরাসরি জড়িত মর্মে তদন্তে প্রকাশ পায়। এছাড়াও তাদের প্রকাশ্য এয়ার প্রটেকশন দ্বন্দ্বের কারণে ব্যবস্থাপনাজনিত ব্যত্যয় ঘটে। তাজভীরুল ইসলাম ২১, ২২ ও ২৩ তলা নিজে ক্রয় করে ব্যবহার করায় তিনি বিল্ডিংটি পরিচালনার জন্য ৮ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করেন। বিল্ডিংয়ের ফ্লোর মালিকেরা বিল্ডিং কোডের নিয়ম না মেনে তাদের ইচ্ছেমত ফ্লোর অফিস ভাড়া দেয়। অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র হুসপাইপসহ ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম মেয়াদ উত্তীর্ণ থাকার বিষয়টি বিল্ডিং পরিচালনা কমিটির দেখার দায়িত্ব থাকলেও কমিটির সঠিক তদারকির অভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ভবনটিকে প্যাসিভ এয়ার প্রটেকশন এবং অ্যাকটিভ এয়ার প্রটেকশন ব্যবস্থাপনা যেমন হোজরীল কার্যকরি না থাকা এবং ডিটেকশন সিস্টেম না থাকা মারাত্মক ত্রুটি যা অব্যবস্থাপনার শামিল। অগ্নি প্রতিরোধ ফলস ফিলিং এবং বিদ্যমান সিলিং এর ওপর বৈদ্যুতিক কেবল কনসিল/কনডুইট না থাকা, ডাক্ট লাইন স্টপার দ্বারা সিল নল না থাকা, ভবনে কোনো প্রকার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা না থাকা ও মডার্ণ কনটেন্ট: দাহ্যশীল পদার্থ দ্বারা ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন করার কারণে এক্সটেরিয়র ডেকোরেশন ব্যবহৃত ভবনের সম্মুখভাবে প্রথম তলা থেকে ২৩ তলা পর্যন্ত অগ্নি প্রতিরোধক ছিল না। দুইটি সিড়ির মধ্যে একটি সার্বক্ষণিক বন্ধ রাখা, ফায়ার ডিটেকশন ও এলার্ম সিস্টেম না থাকা, কর্পোরেট অফিসসমূহ অটো লক ডোর ব্যবহার না করা, নিয়মিত ফায়ার অ্যান্ড ইভাকুয়েশন ড্রিল না করা, ৮ম তলায় একটি রান্না ঘর তৈরি, রেস্টুরেন্ট ভাড়া দেওয়া, অফিসিয়াল কাজে ব্যবহৃত কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক সামগ্রী, কাগজপত্র ও ফাইলপত্র ইত্যাদির ব্যাপক ব্যবহার ও মজুত থাকা, ফায়ার কন্ট্রোলরুম, প্যানেল, পিএ সিস্টেম না থাকা, কার্যকরি ফায়ার সাপ্রোন সিস্টেম না থাকা, ইমার্জেন্সি সাইলেজ ও লাইটিং না থাকা, ব্যক্তিগত পর্যায়ে অগ্নি দুর্ঘটনা ও ইভাকুয়েশন সম্পর্কে কেউই সচেতন না থাকা,  ফায়ার ফাইটিং ও উদ্ধার টিম না থাকায় অতি মাত্রায় দাহ্য পদার্থ দ্বারা অধিক ইন্টেরিয়র করার ফলে আগুনের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পায় এবং গ্লাস প্যানেল ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়।

তদন্তে আরও জানা যায়, সেলিম উল্লাহ ৮ নম্বর ফ্লোরের মালিক। তিনি ফ্লোরটি কিনে অধিক ফ্লেমাবল দ্রব্য দিয়ে ডেকোরেশন করেন। তার ফ্লোর থেকে সিঁড়ি মুখোমুখি কোনো দরজা না থাকায় এবং এতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম দীর্ঘদিন এলোমেলোভাবে ব্যবহৃত হওয়ায় এবং সঠিক পরিচর্যা না থাকায় বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে এয়ার কন্ডিশনে আগুন ধরার ফলে দ্রুত পুরো ফ্লোরটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। লিফট, সিঁড়ি ও জরুরি বর্হিগমন সিঁড়ি একই পাশে এবং কাছাকাছি হওয়ায় অতি অল্পসময়ের মধ্যে সৃষ্ঠ ধোঁয়া দ্রুত  ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের তীব্রতার কারণে ৮ তলা থেকে উপরের লোকজন নিচে নেমে আসার সময়ে নিঃশ্বাস নিতে না পারায় দম বন্ধ হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। ২৬ জন নিরীহ জনতার প্রাণহানি ও ৭১ জন সাধারণ মানুষ আহত হয়।

এসএমএইচআই ফারুক ও তাজভীরুল ইসলামের ক্ষমতার অপব্যবহার, পরিচালনা কমিটি কর্তৃক সঠিকভাবে বিল্ডিং পরিচালনা না করা, কমন স্পেস ব্যবহারে কোনো সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা না থাকার কারণে আগুনের ভয়াবহতায় ২৬ জন প্রাণ হারায় ও ৭১ জন আহত হয়। 

তদন্তকালে জানা যায়, এফআর টাওয়ার তৈরি করার সময় রাজউক প্ল্যান অনুযায়ী সব বিধি-নিষেধ  মেনে সঠিকভাবে উক্ত বিল্ডিং নির্মাণ করে ডেভেলপার কোম্পারি অ্যাডহক কমিটি তৈরি করে বিল্ডিংটি হস্তান্তর করেন। বিল্ডিং বুঝে নেওয়ার ব্যবস্থাপনা কমিটিতে থাকা এস এম এইচ আই ফারুক, তাজভিরুল ইসলাম, সেলিম উল্লাহ, এ এ মনিরুজ্জামান, সৈয়দ আমিনুর রহমান, মিসেস ওরদা ইকবাল, কাজী মাহমুদুন নবী, রফিকুলদের বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতা ও সরাসরি দগ্ধ থাকার কারণে বিল্ডিংয়ের কোথায় কে কিভাবে ব্যবহার করছে সেদিকে লক্ষ্য রাখেনি। এছাড়াও ব্যবস্থাপনা কমিটি সঠিকভাবে বিল্ডিং নিরাপত্তার অনেক বিষয় ঘাটতি ছিলো। বহুতল বিশিষ্ট ভবনের এতগুলো লোকের যেখানে বসবাস সে বিল্ডিংয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির দলাদলির কারণে বিল্ডিং পরিচর্যা না থাকায় উক্ত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৬ জন নিহত ও ৭১ জন আহত হয়। এ অবস্থায় ৮ জনের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তদন্ত কর্মকর্তা তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। তবে রূপায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী খান মুকুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় মামলার দায় থেকে তাকে অব্যাহতির আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। 

/মামুন/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়