ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

সহযোগীদের বাঁচাতে মৃত্যুর আগে ছিনতাইকারীর বলা মিথ্যায় জেলে গেল পথচারী

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২০:১৬, ১৩ অক্টোবর ২০২৩   আপডেট: ২০:১৯, ১৩ অক্টোবর ২০২৩
সহযোগীদের বাঁচাতে মৃত্যুর আগে ছিনতাইকারীর বলা মিথ্যায় জেলে গেল পথচারী

নিরপরাধ পথচারী শাহাবুদ্দিন

অনেক সময় শুনে থাকি মানুষ মৃত্যুর আগে মিথ্যা বলে না। কিন্তু আব্দুর রব ওরফে আব্দুল্লাহ মারা যাওয়ার আগে নিজের অপকর্মের কথা ঢাকতে মিথ্যা বলে নিরপরাধ একটা ছেলেকে ফাঁসিয়ে গেছেন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট আব্দুর রব। দুই ভাই বিয়ে করে আলাদা সংসার গড়েছেন। মাকে নিয়ে থাকতেন রব। কখনো পান-সিগারেট আবার কখনো লেগুনার হেলপারের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। 

এরই মাঝে জড়িয়ে পড়েন সংঘবদ্ধ একটা অপরাধ চক্রের সঙ্গে। চক্রের সদস্য চার জন- রুবেল ওরফে মাউরা রুবেল, মাইনুদ্দির রনি ওরফে থাবা রনি, রিংকু ও সাইফুল ইসলাম ক্যান্ডি। তারা মোবাইল চুরি ও ছিনতাই করতো। নিজেদের মধ্যে ছিনতাইয়ের মোবাইল নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই প্রাণ হারান আব্দুর রব।

২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর, শেরেবাংলা নগর থানাধীন আসাদ গেইটের ফুটওভার ব্রিজের কাছে বন্ধুরা ছুরিকাঘাতে আব্দুর রব (১৮)-কে মারাত্মকভাবে জখম করে। ঘটনাস্থলের পাশেই ছিলেন শাহাবুদ্দিন নামে এক পথচারী। শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদপুর থেকে সিদ্দিকবাজারে আসছিলেন চাচার কাছ থেকে ফোন নিতে। তাকে সেখানে দেখে জাপটে ধরেন রব, রুবেলসহ অন্যরা। এতে তার কাপড়ের পেছনে রক্ত লেগে যায়। ঠিক তখনই সেখানে পুলিশ হাজির হয়। তখন রব, রুবেলসহ অন্যরা শাহাবুদ্দিনকে দেখিয়ে বলে, সে ছুরি মেরেছে। 

শাহাবুদ্দিন অবাক! পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। আর রবকে পাঠানো হয় হাসপাতালে। থানায় নিয়ে শাহাবুদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সে জানায়, ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানে না। শেরেবাংলা নগর থানা পুলিশ তখন ভিডিও কল দেয় রবকে। রব তখনো বলে, শাহাবুদ্দিন তাকে ছুরি মেরেছেন।

পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় রব। এ ঘটনায় ওই বছরের ২৪ ডিসেম্বর তার মা মোসা. নুর জাহান মামলা দায়ের করেন। আর আসামি করা হয় শাহাবুদ্দিনকে। তাকে গ্রেপ্তারও করে পুলিশ। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় রুবেল, রনি, রিংকু, সাইফুল ও ক্যান্ডিকে। পরে পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, ছিনতাইয়ের কাহিনী লুকাতে শাহাবুদ্দিনকে তারা ফাঁসানোর চেষ্টা করে।

মামলাটি তদন্ত করে ২০২২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি চার জনকে অভিযুক্ত করে এবং শাহাবুদ্দিনকে অব্যাহতির আবেদন করে প্রতিবেদন দাখিল করেন শেরেবাংলা নগর থানার সাব-ইন্সপেক্টর মতিউর রহমান।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা মতিউর রহমান বলেন, আব্দুর রবের মা মামলার বাদী নুর জাহান একজন বিধবা ও কর্মজীবী মহিলা। রব জীবিত থাকা অবস্থায় লেগুনায় হেলপারের কাজ করতো। রুবেল, রনি, রিংকু ও সাইফুল ঘটনার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চুরি-ছিনতাই করতো। তারা রবের পূর্বপরিচিত।

২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রুবেল ও রব সাভারের বাসা থেকে মোবাইল ছিনতাই করতে ঢাকা উদ্যানের ৫ নং রোডে আসে। সেখানে আসার পর রনি, রিংকু ও সাইফুল এসে যুক্ত হয়। পরে তারা সবাই মিলে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, টাউন হল, সলিমুল্লাহ রোড ও আল্লাহ করিম থেকে চারটি মোবাইল ছিনতাই করে। মোবাইলগুলো রিংকুকে রাখার জন্য দেয়। চারটি মোবাইল থেকে রব নিজে ব্যবহারের জন্য একটি চায়। কিন্তু রনি ও রুবেল তাকে মোবাইল দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। পরে তারা সবাই মিলে রবকে মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে আসাদ গেইট নিয়ে আসে। এদিন সন্ধ্যা ৬টার দিকে রনি ও রুবেল ফুটওভার ব্রিজের পূর্ব পাশে রবকে নিয়ে যায়। সাইফুল ও রিংকু ব্রিজের পশ্চিম পাশে পাহারা দেয়। পরে রনি তার হাতে থাকা চাকু দিয়ে রবের পেটের নিচে আঘাত করে এবং রুবেল বাম পায়ের রানে আঘাত করলে রব মারাত্মকভাবে জখম হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। এরপর তারা সেখান থেকে পালিয়ে যায়। রবকে চিকিৎসার জন্য প্রথমে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৪ ডিসেম্বর ভোর ৫টায় সে মারা যায়।

এদিকে, মামলার তদন্তকালীন প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা করে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সন্দেহভাজন আসামি শাহাবুদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনার সাথে জড়িত থাকার কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। শাহাবুদ্দিন একজন পথচারী। সে ঘটনার সময় পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তখন আব্দুর রব ও রুবেল বাঁচাও বলে চিৎকার দিলে শাহাবুদ্দিন পথচারী হিসেবে তাদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। তখন রব ও রুবেল ছিনতাইয়ের মূল ঘটনা আড়াল করতে শাহাবুদ্দিনকে আসামি হিসেবে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। রুবেল, রনি, রিংকু ও ক্যান্ডিরা মূলত ছিনতাইকারী। ছিনতাই করা তাদের পেশা। তারা খুনের ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। মূলত ছিনতাই করা মোবাইলের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই এ খুনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু পুলিশের দেওয়া প্রতিবেদনে নারাজি দাখিল করেন আব্দুর রবের মা। গত বছরের ২৯ আগস্ট আদালত ডিবি পুলিশকে মামলাটি অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন।

তেজগাঁও জোনাল টিমের সাব-ইন্সপেক্টর আবুল বাশার মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে চার জনকে অভিযুক্ত করে এবং শাহাবুদ্দিনকে অব্যাহতির আবেদন করে গত ১১ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দাখিল করেন। আগামী ১৯ অক্টোবর মামলাটির তারিখ ধার্য করা আছে। 

শাহাবুদ্দিনের মামা মো. রবিউল বলেন, সে একটা সহজ-সরল ছেলে। ছোটবেলায় টাইফয়েড জ্বর হয়। এরপর থেকে ওর মাথার দুই পাশের চুল কম। নাকে কথা বাজে। অনেকটা প্রতিবন্ধীর মত। আমি ওকে ফোন দিই আসার জন্য। আসার সময় ওই ঘটনা ঘটে। সে দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছিল। পরে পুলিশ এসে তাকে আটক করে নিয়ে যায়। হত্যার ঘটনা স্বীকার করতে অত্যাচার করে। শাহাবুদ্দিন বলে, মামা আমি কিছু করিনি। তাহলে কেন আমি স্বীকার করবো? 

‘কোনও কিছু না করেও ওকে দুই মাসের অধিক জেলে থাকতে হয়েছে। পরে জামিন হয়েছে। এখন প্রতিমাসে আদালতে হাজিরা দিতে টাকা খরচ হয়। ওদের পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ। এই কারণে অসুস্থ শরীর নিয়ে সে ঢাকায় আসে কাজ করতে। ওকে দেখলেই বোঝা যায় অসুস্থ। তারপরও কীভাবে ওর বিরুদ্ধে এমন মামলা দেয়, আমার বুঝে আসে না। যা ক্ষতি হওয়ার তা তো হয়েছে। এখন মামলা থেকে অব্যাহতি পেলে বেঁচে যেতাম।’

জানা গেছে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে বাড়ি শাহাবুদ্দিনের। দুই ভাই আর তিন বোন তারা। বড় ভাই বিয়ে করে আলাদা হয়ে শ্বশুর বাড়িতে থাকেন। বাবা বয়স্ক মানুষ। তেমন কোনও কাজ করতে পারে না। সংসারের দায়িত্ব অনেকটা শাহাবুদ্দিনের ওপর।

ওই দিনের ঘটনার বিষয়ে শাহাবুদ্দিন বলেন, মোহাম্মদপুর মা ও শিশু হাসপাতালের ক্যান্টিনে আমি কাজ করি। বড় ভাই আমার জন্য একটা মোবাইল পাঠায় চাচার কাছে। সিদ্দিকবাজারে যাচ্ছিলাম সেটা আনতে। আসাদ গেইট পাম্পের কাছে বাসের অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ করে ৩/৪ জন পেছন থেকে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমার শরীরে রক্ত লাগিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে। যাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, সে বলে আমি তাকে ছুরি মেরেছি। তখন বাকীরাও একই কথা বলেন। পুলিশ হ্যান্ডকাপ পরিয়ে থানায় নিয়ে যায়। আমাকে বলে ঘটনার বিষয়ে বলতে। আমি বলি, তাদের চিনি না। তখন পুলিশ বলে, তারা কেন তোর নাম বলছে। তখন আমি বলি, তাদের আমি চিনি না, কারও নামও জানি না। আমি কোনও অপরাধ করিনি। তখন পুলিশ আক্রান্ত ব্যক্তিকে ফোন দিলে সে বলে আমি জড়িত।

শাহাবুদ্দিন আরও বলেন, ওই লোক মারা যাওয়ার পর একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে পুলিশের কাছে স্বীকার করে আমাকে ফাঁসাতে চেয়েছিল। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর জেলে যাই। ২ মার্চ জেল থেকে বের হই। যদি অপরাধ করতাম তাহলে মনকে বোঝাতাম, অপরাধ করে জেল খেটেছি। বিনা অপরাধে আমি জেল খেটেছি। আমি কোনও অপরাধ করিনি। এখনো আমাকে আদালতে ঘুরতে হচ্ছে। গরিব মানুষ, টাকা-পয়সা নাই। এই হয়রানি থেকে আমি মুক্তি চাই।

শাহাবুদ্দিনের বিষয়ে রবের মা নুর জাহান বলেন, আমি জানতে পেরেছি ছেলেটা জড়িত না। সে একজন পথচারী। যেহেতু ও ঘটনার সাথে জড়িত না, সেহেতু ওকে মামলায় না জড়ানোই ভালো। ও জড়িত নয়, একথা জানার পর আমি তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাদের ঠিকানা পাইনি। এ সময় ছেলের খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চান নুর জাহান।

ঢাকা/ফয়সাল/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়