ঢাকা     রোববার   ১৯ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৫ ১৪৩১

খুলনার ভাষাসংগ্রামীদের কথা

নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খুলনার ভাষাসংগ্রামীদের কথা

ভাষাসংগ্রামী এম. নূরুল ইসলাম দাদুভাই, গাজী শহীদুল্লাহ, বেগম মাজেদা আলী ও সমীর আহমেদ

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান, খুলনা : মাতৃভাষা ‘বাংলা’র স্বীকৃতির পেছনে খুলনার মানুষেরও রয়েছে গৌরবদীপ্ত ভূমিকা। রয়েছে সাহসী ও বীরত্বগাঁথা ইতিহাস। খুলনার মানুষও রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে সেদিন জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন উত্তাল আন্দোলনে। এমনকি নারীরাও ওই আন্দোলনে রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

 

খুলনার ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। তবে যাঁরা বেঁচে আছেন তারাও অবহেলিত। মেলেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তাই এক রকম নীরবে-নিভৃতে দিন কাটছে- এসব ভাষাসংগ্রামীদের।

 

খুলনার ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে খুলনায় ভাষার দাবিতে প্রথম মিছিল ও সমাবেশ হয়। শুরুতে এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন শহীদ আনোয়ার হোসেন, সন্তোষ দাসগুপ্ত, স্বদেশ বোস ও কবি ধনঞ্জয় দাস।

 

তবে খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডে তখন একে শামসুদ্দীন আহমেদ সুনুর ‘আজাদ গ্রন্থাগার’- এ ভাষাপ্রেমিদের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে খুলনার বিএল কলেজের ছাত্র আবু মুহম্মদ ফেরদৌস, এমএ গফুর, এম. নূরুল ইসলাম দাদুভাই, জাহিদুল হক, সমীর আহমেদ, এসএম জলিল, এমএ বারী ও তোফাজ্জেল হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। ‘আজাদ গ্রন্থাগার’-ই ছিল খুলনার ভাষা আন্দোলনের সুতিকাগার।

 

এখান থেকেই রাষ্ট্রীয় ভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে হাতে লেখা পোস্টার শহরে লাগানো হতো। এর মধ্যে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলির খবরে উত্তাল হয়ে ওঠে খুলনা। তখন এমএ গফুরকে আহ্বায়ক করে ভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করে শুরু হয় জোরালো আন্দোলন।

 

এসব আন্দোলনে এম. মনসুর আলী, শেখ রাজ্জাক আলী, তাহমিদ উদ্দিন, শেখ হাসান উদ্দিন, একে চাঁন মিয়া, কাজী মো. মাহবুবুর রহমান, এসএমএ মোতালেব, অ্যাডভোকেট এএইচ দেলদার আহমেদ, শৈলেন ঘোষ, অ্যাডভোকেট আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার, মোস্তা গাউসুল হক, আব্দুল হামিদ, আলী হাফেজ, নকিব উদ্দিন সরদার, গোলাম সায়ীদ মোক্তার, ড. মনাফ, গাজী শহীদুল্লাহ, লুৎফর রহমান জাহাঙ্গীর, মো. আবু হায়দার, শামসুর রহমান মানি, তোফাজ্জেল হোসেন, বেগম মাজেদা আলী, অ্যাডভোকেট মোমিন উদ্দীন আহমেদ, জিল্লুর রহমান, আফিল উদ্দিন, মতিউর রহমান, কাজী নূরুল ইসলাম, আলতাফ হোসেন, সরদার আব্দুস সাত্তার, খন্দকার এনামুর রহমান, জাহিদুল হক, নূরুল ইসলাম নান্নু, মো. সাইদুর রহমান সাইদ, এমএমএ মোত্তালিব, গোলাম সরোয়ার, আইনুল হক, আসাদুল হক, আব্দুল করিম, আলী আশরাফ, মোশার্রফ হোসেন, আলী রেজা, আবু হানিফ, জিল্লুর রহিম, আব্দুল ওহাব, সৈয়দ কামাল বখত, মালিক আতাহার, আনোয়ারা বেগম রানু, ফাতেমা খাতুন, রোকেয়া বেগম শিরিন, লুৎফুন্নাহার বেগম, সাজেদা হোসেন, নঈমা জোহা, মোমেনা বেগমসহ অনেকেই শ্রম, অর্থ ও আইনি সহায়তাসহ বিভিন্নভাবে মহান ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

 

এম. নূরুল ইসলাম দাদু ভাই : ভাষাসংগ্রামী এম. নূরুল ইসলাম ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে খুলনা মহানগরীর ২০, বাবু খান রোড এলাকায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম ডা. খাদেম আহমেদ এবং মা আসিয়া খাতুন। তিনি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পাস করার পর ছাত্রজীবনে নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের খুলনা শাখার সাধারণ সম্পাদক, ১৯৫২ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্ত ফ্রন্টে, ১৯৫৭ সালে ন্যাপের খুলনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬২ সালে খুলনার জাহানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, ১৯৬৮-৬৯’র ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দান, ১৯৭১’র মহান মুক্তিযদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন, ১৯৭২ সালে ন্যাপের খুলনা মহানগর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য, ১৯৭৮ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জাতীয়তাবাদী যুক্তফ্রন্টে যোগদান, ১৯৭৯ সালে খুলনা মহানগর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ২০০১ সালে খুলনা-৪ আসন (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

 

সর্বশেষ তিনি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি দলমত নির্বিশেষ সবার কাছে ‘দাদুভাই’ নামে পরিচিত।

 

গাজী শহীদুল্লাহ : ভাষা সৈনিক গাজী শহীদুল্লাহ ১৯৩৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানার গিলেতলা গ্রামে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে যোগদান করেন। তার বাবার নাম গাজী শামসুর রহমান। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং ইউনিয়ন মুসলিম লীগের সম্পাদক ছিলেন। তিনি দৌলতপুর বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিএল কলেজে খুলনা জেলার প্রথম সুদৃশ্য ও বৃহৎ শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন।

 

গাজী শহীদুল্লাহ ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিল এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানসহ বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭০ এ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে (খুলনার ডুমুরিয়া-ফুলতলা-তালা আসনে) ভাসানী ন্যাপের হয়ে সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেন। তিনি ১৯৭৩ সালে খুলনা পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ওই সময় তিনি খুলনার শহীদ হাদিস পার্কে শহীদ মিনার নির্মাণ করেন।

 

 

তিনি ২০০১ সালের শেষ ভাগে খুলনা জেলা বিএনপিতে যোগদান করেন। গাজী শহীদুল্লাহ বর্তমানে খুলনা জেলা ভাষা সৈনিক সংসদের সভাপতি ও একুশের চেতনা পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন। বর্তমানে তিনি ফুলতলার নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন।

 

বেগম মাজেদা আলী : খুলনার ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে বেগম মাজেদা আলী ছিলেন অন্যতম। তিনি ১৯৩৬ সালের ২৮ আগস্ট খুলনা মহানগরীর ফারাজীপাড়া এলাকায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম শেখ আব্দুল জব্বার এবং মা মোসাম্মৎ দৌলত উন নেসা। তিনি সাবেক স্পিকার অ্যাডভোকেট শেখ রাজ্জাক আলীর স্ত্রী।

 

তিনি ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনায় প্রথম নারীদের নিয়ে মিছিল বের করেন।  তিনি খুলনা মহিলা সমিতি, মহিলা সমবায় সমিতি, দুঃস্থ নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র, বনফুল মহিলা ও শিশু কল্যাণ সমিতি, গার্লস গাইড সমিতি, লেখিকা সংঘ, জাতীয় যক্ষ¥া নিরোধ সমিতি, জাতীয় সমাজ কল্যাণ পরিষদসহ নারী জাগরণের বিভিন্ন সংগঠণের সঙ্গে জড়িত।

 

সমীর আহমেদ : ভাষাসংগ্রামী সমীর আহমেদ পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা শহরের একটি মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের আগস্টে দেশভাগের পর ওই বছরের সেপ্টেম্বরে স্বপরিবারে খুলনায় আসার পর তার বাবা বশির আহমেদ এবং মা আমেনা খাতুন ইন্তেকাল করেন। তিনি ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির দিকে ঝুঁকে পড়েন। শিশু সাহিত্যের ওপর তার বেশ কিছু লেখা স্কুল ম্যাগাজিন, মাসিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তিনি মাসিক তকদীর পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ছিলেন। শিশু সাহিত্যের ওপর তার কয়েকটি বইও প্রকাশ হয়েছে। তিনি ১৯৫৩ সালে আওয়ামী মুসলীম লীগের খুলনা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। তিনি একাধারে একজন সফল কৃষিবিদ এবং গানের গীতিকারও ছিলেন।

 

খুলনার ভাষা আন্দোলনের সৈনিকদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। তবে যাঁরা বেঁচে আছেন তারাও অবহেলিত। মেলেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ভাষা আন্দোলনের মহান এই সৈনিক এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা কে কোথায় কেমন আছে- তার খোঁজ কেউ না রাখায় এই ভাষাসংগ্রামীরা দুঃখ প্রকাশ করেছেন।


 

 

রাইজিংবিডি/খুলনা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/নূরুজ্জামান/রিশিত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়