নৌপথে ফিরছেন লাখো মানুষ, এখানেও বিড়ম্বনা
ছবি: রাইজিংবিডি
দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো থেকে ঈদের ছুটি শেষে আজও ঢাকায় ফিরেছে লাখো মানুষ। তবে ঈদে বাড়ি যাওয়া বা ফিরে আসার সময় বিড়ম্বনা আর হয়রানি যেন ছাড়ছেই না যাত্রীদের।
শনিবার (৭ মে) রাজধানীর সদরঘাটে সরেজমিন যাত্রী ও লঞ্চের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে বিড়ম্বনা ও সার্বিক যাত্রী হয়রানির চিত্র দেখা গেছে।
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখা গেছে বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও ভোলা নৌপথে। ফেরার পথে এবার বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে কেবিন সঙ্কটের পর নতুন সমস্যায় পড়েছেন ডেকের যাত্রীরা। ঈদযাত্রায় ‘তোষক ও বিছানার চাদর পার্টি’দের কাছে জিম্মি হয়েই লাখো যাত্রীকে অতিরিক্ত টাকা গুণে ফিরতে হয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চের স্টাফদের পেতে রাখা তোষক ও বিছানার চাদরের কারণে লঞ্চের ডেক ও কেবিনের খালি জায়গাজুড়ে সাধারণ যাত্রীরা তাদের বিছানার চাদর বিছাতে পারেননি। পরিবার-পরিজন নিয়ে বাধ্য হয়ে স্টাফদের কাছ থেকে লঞ্চের টিকিটের ভাড়ার চেয়ে দুই-তিনগুণ বেশি টাকা দিয়ে বসার জায়গা বুঝে নিতে হয়েছে।
যদিও লঞ্চের লোকজন ও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, যাত্রীদের চাহিদার কারণেই তোষক বা চাদর বিছিয়ে দিয়েছেন তারা।
শুক্রবার (৬ মে) সন্ধ্যায় রওয়ানা করে শনিবার সকালে বরিশাল-ঢাকা রুটে সরাসরি ১১টি লঞ্চ যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ফিরেছে। যাত্রীদের নেমে যাওয়ার পরও প্রায় সবগুলো লঞ্চেই ডেকের বিভিন্ন স্থানে লেপ, তোষক ও বিছানার চাদর বিছিয়ে রাখার দৃশ্য নজরে পড়েছে। এসব লেপ, তোষক আর বিছানার চাদর বিছিয়েই যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেছেন লঞ্চের স্টাফরা।
সুরভী-৯ লঞ্চের এক স্টাফ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সব তলাতেই তোষকের ব্যবস্থা রয়েছে। একতলা-দোতলার ডেকে অনেকগুলো তোষক, চাদর ও লেপ বিছানো। এ ছাড়া দোতলার একটি কক্ষ পুরোপুরি তোষক বিছানো ছিল। সেখানে কমপক্ষে ২০ জন লোক ঢাকায় ফিরেছে।
তিনি জানান, নিচ তলার মূল ডেকে তোষক, বিছানার চাদর বা লেপের ভাড়া নিয়েছেন জনপ্রতি দুইশ থেকে চারশ টাকা। দোতলায় ভাড়া ৫শ’ করে। আর নামাজের স্থানে ফেরা একেকজন যাত্রীর কাছ থেকে আটশ থেকে এক হাজার টাকা করে নিয়েছেন তারা। তবে এই ভাড়া শুধু তোষক, বিছানার চাদর বা লেপের জন্য। লঞ্চের নিয়মিত ভাড়া যাত্রীকে আলাদাভাবে দিতে হয়েছে বলেও জানান তিনি।
কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের স্টাফ মিজান জানান, তোষক, চাদর বা লেপের ভাড়া নির্ধারিত নেই। যার কাছে যা নেওয়া যায়। দুইশ থেকে চারশ পর্যন্ত। এটাতো সারা বছর করতে পারি না। ঈদের কয়েকদিন করি, বাড়তি কিছু আয়ের জন্য। যাত্রীদের সঙ্গে দরদাম করে যে কয় টাকায় রফা করতে পারি, তাতেই তাদেরকে জায়গা দিয়ে দিই।
সুন্দরবন-১১ লঞ্চের এক স্টাফ শামীম হোসেন বলেন, যে বেতন পাই, সেটায় আসলে স্টাফদের পোষায় না। এজন্য এসব করতে হয়। লঞ্চ কর্তৃপক্ষও সব জানেন। আমরা দুইটা পয়সা পেয়ে যাতে খুশি থাকি, সে কারণে তারা কিছু বলেন না। তারাও চান না এসব ব্যবসা বন্ধ হোক।
তিনি বলেন, জানি এটা অন্যায়। কিন্তু কী করবো? সত্য কথা হলো; লঞ্চের লেপ, তোষক ও বিছানার চাদর, স্টাফ কেবিন- এসব বিক্রি বন্ধ হলে মালিককে স্টাফদের বেতন বাড়াতে হবে। কিন্তু তা কোনো লঞ্চ মালিকই বাড়াবেন না। দুই-একটি লঞ্চ ছাড়া প্রায় সকল লঞ্চেই এই ব্যবসা সারা বছর চলে। আমি আপনার সঙ্গে কথা বলছি দেখলে হয়তো আমার চাকরি যাবে বলে শামীম দ্রুত চলে যায়।
বরিশাল থেকে ঢাকাগামী যাত্রী মতিন রহমান বলেন, বিকালে ঘাটে এসে তিনটি লঞ্চ ঘুরেছি। কোনো লঞ্চেই সাথে আনা চাদর বিছাতে পারিনি। যেখানে যাই, দেখি স্টাফরা তোষক নয়তো লেপ বা চাদর বিছিয়ে রেখেছে। বাধ্য হয়ে তিনশ টাকায় জায়গা নিয়েছি। ডেকের যাত্রীরা লঞ্চ স্টাফদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি।
তানিয়া নামে আরেক যাত্রী বলেন, যতক্ষণ স্টাফদের লেপ, তোষক, বিছানার চাদরের জায়গা বিক্রি শেষ না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত ওরা যাত্রীদের কোনো স্থানে দাঁড়াতেও দেয় না। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সরতে বলেন। লঞ্চ মালিকরা যতই বলুক এসব ব্যবসা তারা করেন না, কিন্তু প্রকাশ্যেই দেখা যাচ্ছে ডেকে ডেকে লেপ-তোষক ভাড়া দেওয়া হচ্ছে।
আফজাল নামে এক যাত্রী বলেন, পরিবারসহ ফিরছি, তাই অনেক চেষ্টা করেছি কেবিনে ফেরার; কিন্তু পাইনি। এজন্য সপরিবারে ডেকে করে এসেছি। লঞ্চের স্টাফদের পেতে রাখা তোষক আর বিছানার চাদর পাতা জায়গা ভাড়া নিয়েছি এক হাজার টাকা দিয়ে। এরপরও টিকিটের ভাড়া দিতে হয়েছে। আমরা যাত্রীরা লঞ্চ স্টাফ আর মালিকদের কাছে জিম্মি।
যদিও যাত্রীদের কমন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন লঞ্চের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।
সুন্দরবন-১১ লঞ্চের সুপারভাইজার আব্দুর রব বলেন, তোষক বা বিছানার চাদর ভাড়া দেওয়ার অনুমতি লঞ্চ কর্তৃপক্ষ দেয়নি। কিন্তু যাত্রীরা এসব ভাড়া নিতে চায় বলেই কোনো কোনো স্টাফ গোপনে লেপ-তোষক ভাড়া দেয়।
কীর্তনখোলা-২ লঞ্চের ম্যানেজার স্বপন বলেন, আগে অনেক স্টাফ লঞ্চে তোষক ভাড়া দিত। কিন্তু এখন সেটা দেয় না। কেউ এই কাজ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
ঢাকা/এনএইচ
আরো পড়ুন