ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

চালকের অবৈধ সুবিধার বলি নটরডেম শিক্ষার্থী নাইম

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২২   আপডেট: ১০:১০, ৬ ডিসেম্বর ২০২২
চালকের অবৈধ সুবিধার বলি নটরডেম শিক্ষার্থী নাইম

ছবি: সংগৃহীত

বাবার আশা ছিলো ছেলে পড়াশোনা শেষ করে ভালো চাকরি করবে। আর ছেলে চেয়েছিল, বিচারক হতে। এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করে ছেলে ভর্তি হয় নটরডেম কলেজে। সেভাবেই এগোচ্ছিল সবকিছু। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা সেই আশা শেষ করে দেয়।

বছরখানেক আগে সিটি কর্পোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ হারায় নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান। নাইমকে ধাক্কা দেওয়া গাড়িটি চালাচ্ছিলেন রাসেল। চালক ইরান মিয়া অবৈধ সুবিধা ভোগ করতে যান। আর তার এ অবৈধ সুবিধার বলি হয় নাইম। পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে এমনটাই উঠে এসেছে।

গত বছরের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্কয়ারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাকের ধাক্কায় নটরডেম কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান নিহত হয়। এ ঘটনায় তার বাবা পল্টন থানায় মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে পল্টন মডেল থানার এসআই (নি.) আনিছুর রহমান গত ৯ নভেম্বর তিন জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলেন-ঢাকা দক্ষিণ সিটির চালক ইরান মিয়া, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হারুন ও রাসেল খান। আজ মামলাটি চার্জশিট গ্রহণের জন্য ধার্য রয়েছেন।

মামলা সম্পর্কে তদন্ত কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ভিকটিম নাইম হাসান গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্কয়ার গোলচত্বরে রাস্তা পার হচ্ছিলেন। তখন দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একটি ময়লার গাড়ি ভিকটিমকে ধাক্কা দেয়। ভিকটিম গুরুতর আহত হয়। ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় গাড়িচালকসহ ৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছি।

তিনি বলেন, ওই গাড়ির প্রকৃত চালক ছিলেন ইরান। কিন্তু ইরান নিজে কাজে না গিয়ে হারুনের কাছে গাড়ির চাবি দিয়ে দেন। হারুন আবার গাড়ি দিয়ে দেয় রাসেলের কাছে। প্রকৃত ড্রাইভার না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ইরানের অবৈধ সুবিধা গ্রহণের কারণে সেদিন ভিকটিম সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়।

এদিকে, চার্জশিটে আনিছুর রহমান বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ময়লার গাড়িটির বরাদ্দপ্রাপ্ত চালক ইরান মিয়া সহকারী চাকরির বিধি লঙ্ঘন করে। কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে ইরান অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে ২০২১ সালের জুলাই থেকে বদলি ড্রাইভার হিসেবে হারুনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ট্রাকসহ চাবি দেয়। আর এ কারণে নটরডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাইম হাসানের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সহযোগিতা করেছে মর্মে স্বাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে ইরান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডেও নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতাকর্মী হয়ে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে রাসেল খানকে ময়লার ট্রাক চালানোর জন চাবি দেয়। আসামিরা একে অপরের পরস্পর যোগসাজসে রাসেল ময়লার ট্রাক বেপরোয়া ও দ্রুত গতিতে চালিয়ে নটরডেম কলেজের ছাত্র নাইমকে ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। এতে তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত জখম প্রাপ্ত করে মৃত্যু ঘটানোর অপরাধে একে অপরের সহায়তায় অপরাধ করেছে।

মামলা সম্পর্কে মেহেদী হাসানের বাবা শাহ আলম দেওয়ান বলেন, আমার দুইটা ছেলে। বড় ছেলেটা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিংয়ে এ পড়ছে। আর মেহেদী তো নটরডেম কলেজে পড়তো। ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়। এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাই। আমার আশা ছিল, ছেলেটাকে বড় হয়ে ভালো চাকরি করবে। কিন্তু ছেলে চাইতো বিচারক হতে। ও মারা যাওয়ার পর ডায়েরিতে দেখতে পাই, বিচারক হওয়ার ইচ্ছা ছিল ওর। কিন্তু কিছুই তো হতে পারলো না। অদক্ষ ড্রাইভার ছেলেটার প্রাণ কেড়ে নিলো।

মেহেদীকে হারিয়ে পরিবার এখনো কাঁদছে জানিয়ে শাহ আলম বলেন, ওর মা সব সময় ছেলেটার জন্য কান্নাকাটি করে। আর আমার সন্তান দুটো এলোমেলো ছিল না। যা বলতাম তাই শুনতো। যে ওকে একবার দেখেছে, সে আর ভুলতে পারেনি।

তিনি বলেন, সেনাবাহিনীতে চাকরি করতাম। অবসরের পর বইয়ের ব্যবসা শুরু করি। ছেলেরা যেন ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে এজন্য ঢাকায় রয়ে যায়। কিন্তু কি হলো। ভালো স্কুলে পড়িয়ে, ভালো রেজাল্ট করিয়ে ভালো কলেজে ভর্তি করলাম। কিন্তু যে আশা করেছিলাম তা আর পূরণ করতে পারলাম না।

মেহেদী কলেজে নিয়ে যেতেন বাবা শাহ আলম। ঘটনার সপ্তাহ খানেক আগে মেহেদী বাবাকে বলে, সে বড় হয়েছে। একাই যেতে পারে। তার আর কষ্ট করে যেতে হবে না। তিনি বলেন, আমার কষ্ট কমাতে গিয়ে ছেলেটার জীবনই চলে গেলো।

সে দিনের ঘটনার বিষয়ে শাহ আলম বলেন, ছেলেটা সকালে হালকা নাস্তা করে। ওর মা জুতাটা পরিয়ে দেয়। সে কলেজে যায়। এরপর ছেলের দুর্ঘটনার খবর পান। 

তিনি বলেন, যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখানে এতো স্পিডে গাড়ি চালানোর কথা না, যুক্তিই আসে না। অদক্ষ ড্রাইভারের কারণে আমার ছেলেটা মারা গেলো। আমি ওদের সাজা চাই। দ্রুত যেন মামলার বিচার হয় এবং আসামিদের সাজা হয়।

উল্লেখ্য, গত বছরের ২৪ নভেম্বর সকাল ১১টার দিকে গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের দক্ষিণ পাশে নটরডেম কলেজের মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে ধাক্কা দেয় দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাক (রেজি. নম্বর ঢাকা মেট্রো শ ১১-১২৪৪)। এ সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী রাসেল খান।

পরে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় লোকজন ও এলাকার টহল পুলিশ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে ট্রাক ও চালকের আসনে থাকা রাসেল খানকে গ্রেপ্তার করে। এরপর হারুনকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তবে ইরান মিয়া মামলার শুরু থেকে পলাতক রয়েছেন। রাসেল ও হারুন উচ্চ আদালত থেকে জামিনে আছেন।

/মামুন/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়