ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া শিশুদের অন্য দেশে নেওয়া মাতৃত্বকে অসম্মান’

নিজস্ব প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:০২, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩  
‘আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া শিশুদের অন্য দেশে নেওয়া মাতৃত্বকে অসম্মান’

জাপানে জন্ম নেওয়া দুই শিশু নাকানো জেসমিন মালিকা (১১) ও নাকানো লায়লা লিনাকে (৯) আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই অভ্যাসগত বাসস্থান থেকে হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসা মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন রূপকে অসম্মান করার নামান্তর।

রোববার (২৯ জানুয়ারি) বিকেলে ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান শিশু দুটির বাবা ইমরান শরীফের করা মামলা খারিজ করে তাদের মায়ের জিম্মায় রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লিখিত মন্তব্য করেন আদালত।

রায়ে আদালত বলেছেন, বাদী ইমরান শরীফ তার নালিশের কারণ আদালতের এখতিয়ারে উদ্ভূত হয়েছে তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাদী-বিবাদী ও এই নাবালিকাদের সর্বশেষ বসবাসের স্থান জাপান। সেহেতু, পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৬ (১) অনুযায়ী এ মোকদ্দমা অত্র আকারে ও প্রকারে চলতে পারে না।

জাপানি আদালতে দুই পক্ষের মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা থাকার কথা উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, টোকিও পারিবারিক আদালতে মামলা হওয়ার কথা এবং সেই মামলায় প্রথম থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টি বাদী স্বীকার করেছেন। অর্থাৎ একটি মোকদ্দমায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা অবস্থায় মোকদ্দমার বিষয়বস্তুকে সরিয়ে এনে এ দেশে এসে বাদী পুনরায় একটি মামলা দায়ের করলেন, যা কোনো সাধারণ যৌক্তিক চিন্তায় গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। নাবালিকাদের মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এটা নিঃসন্দেহে মারাত্মক ও অনুসরণ অযোগ্য কার্যকলাপ মর্মে প্রতীয়মান হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ বিকাশে কল্যাণকর হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

রায়ে সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, যেখানে ২৫ (২) ধারায় বলা হয়েছে, ‘মাতৃত্ব এবং শৈশব অবস্থায় প্রতিটি নারী এবং শিশুর বিশেষ যত্ন এবং সাহায্য লাভের অধিকার আছে। বিবাহবন্ধন-বহির্ভূত কিংবা বিবাহবন্ধনজাত সকল শিশু অভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা ভোগ করবে।’ সেখানে বিবাদী মাতা জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকো সন্তানের প্রাথমিক শুশ্রুষাকারী হওয়া সত্বেও তাকে কিছুই না জানিয়ে ও সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে তার কাছ থেকে সন্তানদের এভাবে কোনো আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়াই তাদের অভ্যাসগত বাসস্থান হতে হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসা বাদীর এই বিষয়টি মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সার্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার নামান্তর। এটি এ কারণেই আলোচনাযোগ্য। কেননা, নাবালিকারা কন্যা সন্তান আর এই সামগ্রিক বিষয়টি তাদের স্বীয় আত্মবিশ্বাস নিয়ে বিকাশের পথে মোটেই মঙ্গলজনক নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।

অত্র মোকদ্দমায় যুক্তিতর্ক শ্রবণান্তে, সমগ্র নথি পর্যালোচনা করে এবং অত্র নাবালিকাদের সাথে খাসকামড়ায় একান্তে আলোচনা সাপেক্ষে বাদী-পিতার নিকট হেফাজতে নাবালিকাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল নিশ্চিত হবে কি না, এসব আলোচনাপূর্বক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়েছে, উল্লেখ করে আদালত বলেন, জাপানে থাকাকালীন নাবালিকারা উভয়েই পড়াশুনায় খুবই মেধাবী ছিল এবং তাদের ফলাফলও খুব ভালো ছিল। বাদী তাদের এ দেশে আনার পর তার আরজি অনুযায়ী নবোদয় প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন এবং একই সাথে আমেরিকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। আবার জেরায় বলেছেন যে, নবোদয় নয়, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন। অর্থাৎ, বাদী-বিবাদী আরজি দাখিলের সময় তারা কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলেন না। এভাবে প্রথম থেকে অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে আসা পর্যন্ত জাপানে পড়াশোনা করা দুটো মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাদী তার একান্ত চিন্তাভাবনা অনুযায়ী তাদের নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাপ্রক্রিয়া হতে মুহূর্তেই বিচ্ছিন্ন করার এই সিদ্ধান্ত, নাবালিকাদের কল্যাণের জন্য মোটেই সমীচীন নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।

আদালত আরও উল্লেখ করেন, অত্র মোকদ্দমার রায়ের পর্যায়ে সামগ্রিক আলোচনায় পিতা কিংবা মাতার স্বার্থের ওপরে প্রাধান্য পেয়েছে, কার হেফাজত অত্র নাবালিকাদের জন্য সবদিক হতে মঙ্গলজনক ও নিরাপদ, সেই বিষয়টি। এক্ষেত্রে পিতা হিসেবে নাবালিকাদের দেখা- সাক্ষাতের পূর্ণ হকদার হলেও মায়ের কাছেই অত্র দুই নাবালিকার হেফাজত ও তাদের শারীরিক, মানসিক, পারিপার্শ্বিক তথা সার্বিকভাবে মঙ্গলজনক মর্মে প্রতীয়মান হয়।

সার্বিক বিবেচনায়, বাদীর হেফাজতে নাবালিকা কন্যাগণের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল নিশ্চিত হবে মর্মে পিতার এই দাবি বাদীপক্ষ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছেন বিধায় আলোচ্য বিষয়টি বাদীর প্রতিকূলে নিষ্পত্তি করা হলো।

মামুন/রফিক

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়