বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনে সময় দেওয়া হয় ১৫ মিনিট
বাদল সাহা || রাইজিংবিডি.কম
টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ (ছবি : বাদল সাহা)
বাদল সাহা, টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে কিছু সেনাসদস্য। হত্যার পর ১৬ আগস্ট তার জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় মা-বাবার কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এদিন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়ায় লাশ আনা হয়।
কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আনা হয়। এ সময় শত শত মানুষ প্রিয় নেতার মুখ দেখার জন্য তার বাড়ির আশপাশে অবস্থান নেন। কিন্তু সেনাবাহিনী ও পুলিশ তাদের লাশ দেখতে দেয়নি। কফিনসহ বঙ্গবন্ধুকে কবর দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেনাসদস্যরা। এজন্য ডেকে আনা হয় মৌলবি আব্দুল হালিমকে। কিন্তু তিনি লাশ না দেখে জানাজা করতে রাজি হননি। তার আপত্তির পর লাশ দেখিয়ে সেনাসদস্যরা ১৫ মিনিটের মধ্যে গোসল করিয়ে জানাজার নামাজের পর দাফনের নির্দেশ দেয়। মৌলবি আব্দুল হালিম এখন প্রয়াত।
বঙ্গবন্ধুর কফিন খোলার জন্য ডাকা হয় কাঠমিস্ত্রি আইয়ুব আলী শেখ ও তার বাবা হালিম শেখকে। তার দুজনে মিলে খোলেন কফিন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী তৈয়বের দোকান থেকে ৫৭০ সাবান কিনে এনে লাশের গোসল করান তোতা মিয়া শেখ, রজো মোল্যা, শেখ আব্দুল হাই, ইদ্রিস কাজী ও বোহরান শেখ। এদের কেউ কেউ মারা গেছেন। গোসল শেষে তার বাড়ির পাশে রেডক্রিসেন্ট অফিস থেকে রিলিফের একটি সাদা কাপড় এনে তা দিয়ে পরানো হয় কাফন।
বঙ্গবন্ধুর নামাজে জানাজায় মাত্র ২৫ থেকে ৩০ জন অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। কড়া নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে তড়িঘড়ি করে এসব কাজ সম্পন্ন করা হয়। গ্রামবাসী জানাজায় অংশ নিতে চাইলেও তাদের অনুমতি দেয়নি সেনাবাহিনী। জানাজা শেষে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সাহারা খাতুনের কবরের পাশে মরদেহ কবর দেওয়া হয়। দাফন শেষে মোনাজাত পরিচালনা করেন মৌলবি আব্দুল হালিম।
কাঠমিস্ত্রি আইয়ুব আলী শেখ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর লাশ টুঙ্গিপাড়ায় আনা হলে কফিন খোলার দায়িত্ব পড়ে আমার ও আমার বাবার ওপর। কফিনটি খোলার পর আমি ও বাবা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধু যে হাত দিয়ে বাঙালি জাতিকে নিদের্শনা দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন সে হাতে ও বুকে গুলি করা হয়েছে।’
শেখ বোরহান উদ্দিন ও শেখ আব্দুল হাই বলেন, ‘আমরা রেডিওর মাধ্যমে শুনতে পেলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এ খবর শোনার পরপরই গোটা টুঙ্গিপাড়ায় থমথমে ভাব বিরাজ করতে লাগল। টুঙ্গিপাড়া থানার তৎকালীন ওসি আমাদের একসময় একটা কবর ও আরেক সময় দুইটা কবর খুঁড়তে বললেন। বেলা ১২টার দিকে একটি হেলিকপ্টার টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছায়। এ সময় এলাকার লোকজনকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে তড়িঘড়ি করে কবর দেওয়ার জন্য চাপ দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু আমরা তাকে গোসল ও জানাজা না পড়ে কবর দিতে অস্বীকৃতি জানাই। তখন আমাদের মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হয়। আমরা বঙ্গবন্ধুকে একটি ৫৭০ কাপড়কাচা সাবান দিয়ে গোসল করাই এবং একটি রিলিফের সাদা কাপড় দিয়ে কাফনের কাপড় পরাই। পরে তার নামাজে জানাজা হয়। এতে মাত্র ২৫-৩০ জন লোক অংশ নিতে পেরেছে। পরে এলাকার লোকজন কবরের পাশে এসে দোয়া ও মোনাজাত করেন। ফুল দিয়ে তার প্রতি জানান শ্রদ্ধা।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে চিরতরে বাংলাদেশ থেকে তাদের নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল একদল সৈন্য। কিন্তু তাদের সে ইচ্ছা পূরণ হয়নি। বঙ্গবন্ধু অমর হয়ে আছেন মানুষের কাছে। ভালোবাসা আর ভক্তি-শ্রদ্ধা নিয়ে মানুষ ছুটে আসেন টুঙ্গিপাড়ায় এই প্রিয় নেতার কাছে। এখনো শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সে রক্ষিত আছে তার লাশের কফিন, ব্যবহারের জিনিসপত্র। আর তা দেখতে আসেন শত শত মানুষ।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৪/বাদল সাহা/শাহনেওয়াজ/কমল কর্মকার/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম