ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ধান চাষ এবং কৃষকের আর্তনাদ

প্রদীপ অধিকারী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫২, ১০ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ধান চাষ এবং কৃষকের আর্তনাদ

প্রদীপ অধিকারী: আমি বাংলাদেশের একজন কৃষক, ধান চাষ আমার বংশানুক্রমিক পেশা। স্বাধীনতা পূর্বকালে প্রকৃতির খেয়াল খুশিকে অবনত মস্তকে মেনে নিয়েই আউশ-আমন-বোরো ধানের চাষ করেছি, ক্ষেত্রবিশেষে পাট চাষ করেছি। কখনো পুড়েছি রৌদ্র খরায়, আবার কখনো ভেসেছি বন্যায়। নিষ্ঠুর অভাবের তাড়নায় এক মুঠো ভাতের জন্য মরেছি, মরতে দেখেছি। এটাই ছিল সাত কোটি অনাহারক্লিষ্ট বাঙালির নিয়তি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কৃষক বাঁচাও, দেশ বাঁচাও’ স্লোগান আমাদের কানে, কৃষি-মুক্তির প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিধ্বনিত হলো। ড. নরম্যান বোরলগ-এর গ্রিন রিভুলেশনের আদলে, বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন দেশে সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি ঘোষণা করলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখা ট্যাংকের মত ঘরঘর শব্দে গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে এলো গভীর নলকূপ খননের ভারি যন্ত্রপাতি। অপরিচিত যান্ত্রিক শব্দের সাথে প্রত্যাশার ঝংকারে মুখরিত হলো গ্রাম। বসলো গভীর নলকূপ, সরকারের অবারিত সহযোগিতায় শুরু হলো ব্যাপক ভিত্তিক ইরি-৮ ধানের চাষ। আমার ১ একর ১৭ শতাংশ জমিতে যেখানে ১১ থেকে ১৪ মণ আউশ/আমন ধান হতো, সেই জমিতে ইরি-৮ ধান কেটে, মাড়াই করে, মেপে দেখলাম ৭৬ মণ। সে এক অবিস্মরণীয় আনন্দ। ধান চাষে, প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আনন্দ, ক্ষুধা মুক্তির আনন্দ, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আনন্দ। যে আনন্দ ছাড়া ব্যর্থ ভৌগোলিক মুক্তি। যার প্রমাণ ’৪৭-এ, আমাদের ব্যর্থ স্বাধীনতা পরবর্তী অতি পরিচিত  স্লোগান ‘লাখ ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়’। সম্ভবত আমাদের সেই আনন্দই ছিল জাতির পিতার ‘ক্ষুধা মুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার প্রথম সোপান। আজ আমরা সেই স্বপ্নের শিখরে। অথচ গত এক দশকের অমনোযোগ, অবহেলা, অনাদরে আমরা ধানচাষীরা আজ মৃত্যুশয্যায়। দীর্ঘ দিনের নিষ্ফল শ্রমে, তিল তিল করে খসে পড়েছে আমাদের আত্মশক্তি। পেশী শক্তির ধ্বংসাবশেষ নিয়ে, ধান চাষের সেই আনন্দের বধ্যভূমির উপর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়ে যখন ব্রি-২৮ ধানের গায়ে হাত বুলাই, কাস্তে হাতে এক এক করে ধানের গুছি কাটি, আমার শ্রদ্ধাবোধ, স্মৃতিপটে তোমার ছবিটাই তুলে ধরে, হে বন্ধু, হে পিতা, তোমার বড় প্রয়োজন অনুভব করি।

আমার সহকর্মী কালিহাতীর মালেক ভাই তার পাকা ধানে আগুন দিয়েছেন। ৫০০ টাকা মণের ধান কাটার জন্যে, ৮০০ টাকা রোজ শ্রমিক, থাকা-খাওয়ার খরচ, তার সাথে প্রতিদিন ২০ টাকা বিড়ি খরচ, কী করে দেবে? কোথা থেকে দেবে? কত দিন দেবে? দেশলাই হাতে আমিও ধানক্ষেতের চারপাশে ঘুরেছি। কী হবে এই ধান দিয়ে? কেন দেব না এতে আগুন? মনে হয়েছে জলন্ত দেশলাইয়ের কাঠিটা ছুড়ে মেরে নিজেও ঝাপিয়ে পড়ি, সবকিছু শেষ হয়ে যাক। মনে হয়েছে ধানগুলো যেন শেয়াল শকুনের মতো কামড়ে খুবলে খাচ্ছে আমার কঙ্কালসার দেহ, আমার নিঃশেষিত অস্তিত্ব। আমি এই জমি চাষ করেছি, ধান বুনেছি, সেচ-সার-বিষ দিয়েছি, সবল সজিব পাতার আঁচড়ে বিক্ষত হয়ে নিড়িয়েছি, এখন শুধু কাটার জন্য যে খরচ হয় তাও ধান বিক্রি করে পাব না। যতদূর মনে পড়ে গত প্রায় এক দশক যাবৎ ধানের দাম ক্রমহ্রাসমান। কাটার মৌসুমে ৮০০ টাকা থেকে হ্রাস পেয়ে ৫০০ টাকায় এবং অন্য সময়ে ১২০০ থেকে ৮০০ টাকায় নেমে এসেছে। অপর দিকে বাড়ছে জমি চাষ খরচ, সেচ খরচ, শ্রমিকের মজুরি, সার-কীটনাশকের দাম। প্রতি মণ ধানের উৎপাদন খরচ বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকায়। নানা প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হয়ে একাধিক সমিতি থেকে ঋণ নিয়েছি, ধান কেটে শোধ দেবো বলে। এখন ধান কাটতে গেলেই আমাকে আরো ঋণ করতে হবে। কী করবো আমি এখন? বছরের পর বছর নিঃসম্বল হতে হতে এবার চূড়ান্তভাবেই ভেবেছিলাম ধান চাষ করবো না। কিন্তু পারিনি, এ জমির সাথে আমার পূর্বপুরুষের হাজার বছরের সম্পর্ক। আমি বেঁচে থাকতে এই জমি পতিত থাকবে! দুর্বা ঘাস গজাবে! গরু চড়বে! খেলার মাঠ হবে- তা হতে পারে না।

যেখানে অধিকাংশ পণ্যের উৎপাদক, উৎপাদন খরচের প্রায় দুই থেকে দশগুণ লভ্যাংশে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেন, সেখানে আমার ধানের উৎপাদন খরচ আর বিক্রয় মূল্য সমান। আমার স্থিতি শূন্য। আমি কী খাব? কী দিয়ে দেব ঘরের ছানি? কোথা থেকে যোগাব ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ? কী দিয়ে কিনবো পরিবারের গামছা-লুঙ্গি-শাড়ি-ওষুধ? যেখানে প্রতিটি পরিবারের প্রতিদিনের ন্যূনতম খরচ ৫০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা। আসলে আমাদের কর্তাদের কর্মব্যস্ততার মাঝে, স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ধান চাষীদের জীবন-জীবিকা-অস্তিত্ব। ফলে গত এক দশক যাবৎ অনির্বাণ এ ক্ষতি আজও তাদের কাছে কিছুটা ক্ষতি- সামান্য ক্ষতি।

কবিগুরু, শব্দটা তোমার থেকেই শিখেছি- ‘সামান্য ক্ষতি’ তোমার কবিতার শিরোনাম- ছোটবেলায় পড়েছিলাম। রাজমহিষী করুণা, শীতের সকালে স্নান সেরে, দরিদ্র প্রজাদের কুটিরে আগুন লাগিয়ে শীত নিবারণ করল। এতে সামান্য ক্ষতি হলো। তোমার কবিতাটার একটা লাইন যতটুকু মনে পড়ে: ‘উত্তর বায়ু হইল প্রবল কুটির হইতে কুটিরে অনল উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল’। ঠিক যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে  মালেক ভাইয়ের পাকা ধানের আগুন দেশব্যাপী প্রজ্বলিত, এবং এই ধানানলের তপ্ততা, দুই লক্ষ ছেচল্লিল হাজার বর্গকিলোমিটারের প্রায় দুই কোটি ধান চাষীর বুকে গলিত লাভা রূপে স্তরিভূত। এ লাভা আগ্নেয়গিরি সৃষ্টির সম্ভাবনাহীন, পুঞ্জিভূত রূপ নিয়ে শক্তি সঞ্চয়ন-বিস্ফোরণের অভিজ্ঞতাহীন। আমাদের নেই কোন ব্যাপ্ত সংগঠন, নেই কোন সংগ্রাম, নেই কোন আন্দোলন। আমরা রাস্তা অবরোধ করতে পারি না, গাড়ি ভাংচুর করতে পারি না, আগুন দিতে পারি না, প্রকাশ্য রাজপথে কারো মুখে কালি লেপটে দিতে পারি না। আমাদের আছে শুধু সৃষ্টির কান্না, নেই কোন ধ্বংসের ক্ষমতা। তাইতো আমাদের ধানে আমরা আগুন দিলাম, না রাস্তায় ফেলে দিলাম, তাতে কারো কিচ্ছু যায় আসে না। তাই এ অনলে ঝড়লো না কোন বিন্দু বারি, পড়লো না কারো কৃপা দৃষ্টি। আমাদের আর্তনাদে প্রতিধ্বনিত হল না কোথাও কোন প্রত্যাশার বাণী।

আমাদের কৃষি বিধাতা বলেন, ‘ধানের উৎপাদন প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ১৩ লক্ষ টন,  গুদামে ঠাঁই নাই। বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ, বিদেশে রফতানির সিদ্ধান্তও ভেবে চিন্তে নিতে হবে’। পরোক্ষভাবে দেশের ভবিষ্যৎ দুর্যোগের দায়ও ধান চাষীদের ঘাড়ে। এই দায় কাঁধে নিয়েই তো আমাদের পথ চলা, কিন্তু আর পারছি না। তাইতো দেশলাইয়ের জ্বলন্ত শলাকা হাতে, বসেছি পাকা ধান ক্ষেতের পাশে। কিন্তু বার বার জ্বলন্ত কাঠি ছুড়ে মারতে গিয়েও হাত আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছে। না! শেষ পর্যন্ত আমি পারি নাই, আমি পারি না। কোন মা তার সন্তানকে গলা টিপে মারতে পারে না। কোন সাংস্কৃতিক কর্মী মঞ্চে আগুন দিতে পারে না। কোন রাজনৈতিক কর্মী গাড়িতে আগুন দিতে পারে না। যারা পারে তারা শুধু আগুন সন্ত্রাসী নয় উন্মত্ত পিশাচ। তা ছাড়া ক্ষেতে তো  শুধুই ধান নয়, এর সাথে রয়েছে খড়। ভাত যেমন ১৬ কোটি মানুষের প্রধান খাদ্য, তেমনি খড় সাড়ে পাঁচ কোটি গো-সম্পদের প্রধান খাদ্য। আমারও রয়েছে কমলি, ধবলি, কৃষ্ণকলি, মহেশ। কমলিটা প্রতিদিন ৩-৪ কেজি দুধ দেয়। এই দুধটুকু বিক্রির পয়সাই এখন আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। বাচ্চা প্রসবের আগে কমলিটা ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমি পশু হাসপাতালে গিয়ে হাজারো চেষ্টা করেও কমলির জন্য একজন ডাক্তার নিয়ে আসতে পারলাম না, কমলি মরা বাচ্চা প্রসব করলো। আমি ভেবেছিলাম ও আমাকে ক্ষমা করবে না, দুধ দেবে না, কিন্তু আমি পরাজিত, পশু কমলি আমার দুরবস্থা বুঝতে পেরেছে, ও উদার মনে দুধ দেয়। কৃষানি যখন ওর পায়ের কাছে বসে বানগুলো টেনে টেনে দুধ বের করে, আমি তখন ওর মাথার কাছে দাঁড়াই, ও জিহ্বা দিয়ে আমার গায়ের ঘাম চেটে চেটে আমাকে আদর করে। জানি না ও আমাকে কী ভাবে? ধবলি, কৃষ্ণকলি ওরই মেয়ে। ওরা বড় হয়েছে, ধবলির পেটে বাচ্চা। মহেশ ওর ছেলে, একেবারে তাগড়া জোয়ান। ওদের নিয়েই আমার সংসার। আমি ওদের চাড়িতে এক গুছি খড় না দিয়ে উঠানে খেতে বসলে ওরা বিদ্রোহী গলায় ডাকতে থাকে। ওদের ডাক আমার চোখে এসে লাগে। আমার চোখ গলা ভারি হয়ে আসে, আমি খাবার গিলতে পারি না। আমি ওদের খাবারে আগুন ধরিয়ে দেব? না, আমি এটা করতে পারি না।  তাহলে কী করবো? ৮০০ টাকা রোজ কামলা নিয়ে ধান কাটবো? অসম্ভব, ধান বিক্রি করে কামলার দাম হবে না।  টাকা দেবো কোথা থেকে? শেষ সিদ্ধান্ত, নিজেই কাটবো সব ধান। শুরু করলাম সপরিবার অহর্নিশি ধান কাটা। বৌ আর ছোট ছেলেটা সঙ্গে নিয়েই শুরু করলাম। বড়টা এলো না। ও কলেজে পড়ে। বিচিত্র  অবয়বের বন্ধুদের নিয়ে আমগাছের ডালে বসে আড্ডা জমিয়েছে। প্রায় সবার এক হাতে পাকা আম, অন্য হাত মাথা সব মোবাইলের বোতামে। বাইরের কিছু দেখার সময় ওদের নেই। ওরা কলেজে পড়ে, ওদের বদ্ধমূল মানসিকতা, ওদের আর কোন শ্রমদায়ক কাজ করতে হবে না। স্কুল-কলেজগুলো যেন শ্রম-বর্জন চর্চা কেন্দ্র, সনদপত্রগুলো যেন শ্রম-মুক্তির প্রত্যয়ন পত্র। আজকাল ওদের দিকে তাকালেই, নৈতিকতা বর্জিত, বেকার, বেয়াদবের প্রতিমূর্তি মনে ভয়ের সৃষ্টি করে। ওদের কিছু বলার সাহস পেলাম না। গ্রামে সহযোগিতা পাবার মত কোন কৃষি শ্রমিক নেই। আগে যারা স্কুলে যেত না, বা ঝরে পড়তো বা ফেল করতো তাদের মধ্যে অনেকেই কৃষি কাজ, ঘর তৈরি, নৌকা তৈরি, আসবাবপত্র তৈরি ইত্যাদি কাজ করতো। এখন প্রায় সবাই স্কুলে যায়, কেউ ফেল করে না, ফলে সকল প্রকার শ্রমিকের অভাব। তার মধ্যে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি শ্রম নির্মম শ্রম এবং ধান কাটার শ্রম নিষ্ঠুর শ্রম। উত্তর বঙ্গের এক সময়কার মঙ্গা পীড়িত এলাকার জনগোষ্ঠীই এ শ্রমের মূল যোগানদাতা। এ শ্রম নির্দয়। এক দিকে মাথার উপর ৪৫০ ক্যাল/বর্গ সেমি সৌর বিকিরণ, ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা অপর দিকে দৈনিক গড়ে ৫০ মিমি বৃষ্টি। অপুষ্টিতে ভোগা কুঁচকানো চামড়া কখনোই শুকনো থাকবে না, হয় লবণাক্ত ঘামে ভেজা থাকবে না হয় বৃষ্টিতে ভিজবে।

হে আমাদের অন্ন খাদকেরা, তোমরা যখন চৈত-বোশেখের নিদাঘ মধ্যাহ্নে ঘরের ভেতরে ৩০০ থেকে ৪০০ আরপিএম-এর ফ্যানের নীচে বসে অসহ্য-অস্বস্তিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ খোঁজ, আমরা তখন খোলা আকাশের নিচে,  প্রখর সূর্য তাপ, দুশ্চিন্তায়  ঝাপসা হয়ে আসা চোখ, নুয়ে পড়া মাথা, আড়ষ্ট হয়ে আসা পিঠ, ধান কাটি, আটি বাঁধি, বোঝা বাঁধি। ৬০ থেকে ১০০ কেজি ওজনের বোঝা মাথায় নিয়ে পিচ্ছিল আল পথে হাটি। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে হাড়গুড়, প্রতিরোধী হয়ে উঠে পেশি, রক্ত-মাংশে শুরু হয় ঘুর্ণিঝড়, বুকের ভেতরে চমকায় কষ্টের বিজলী, সারা গায় বয়ে যায় ঘামের প্লাবন। চলতে থাকে যুদ্ধ, পৃথিবীর দুর্ণিবার আকর্ষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, লৌহতপ্ত সৌরকিরণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ধাবমান বাষ্পিত বায়ুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ, প্রকৃতির তাবৎ নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমরা শংসপ্তক, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও যুদ্ধ করি, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যুদ্ধ করি। আমরা নীল চাষীদের বংশধর, আমরা জানি আমাদের শ্রমের ফল চলে যাবে লুটেরাদের দখলে। তারপরও আমরা দৌড়ে পথ চলি, ১৬ কোটি মানুষের মুখের অন্ন যোগানোর দায়িত্ব নিয়ে পথ চলি, কালের ধাবমান গতিতে পথ চলি। আমাদের এ শ্রমের নেই কোন কাব্য রূপ, নেই কোন নাট্য রূপ, নেই কোন শিল্পীর বর্ণনা। কারণ আমরা অশিক্ষিত, মূর্খ, চাষা।  আমাদের চেহারা বিবর্ণ, চামড়া খরায় ফাটা মাঠের মত  চৌচির তাতে লবণাক্ত ঘামের দুর্গন্ধ। মাথায় উন্মাদ সদৃশ উস্কোখুস্কো চুল, উদাম গতর, কোথাও নেই কোন শিল্পের আঁচড়। আমরা শিল্প-সংস্কৃতিহীন, আত্মীয়-বন্ধুহীন।

প্রতিকুলতা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিবন্ধকতা, প্রতিনিধিত্বহীনতা, প্রতিপক্ষ এই পঞ্চশিকল দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত। নিত্যবিরাজমান প্রকৃতি-পরিবেশ-পরিস্থিতির ত্রৈধপ্রতিকুলতা। ক্রেতা-মধ্যস্বত্বভোগীদের সাথে অসম প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নানা ছলচাতুরি-কুটকৌশলে লুটে নিচ্ছে আমাদের শ্রমের ফল, এমন কি আমাদের ভুক্তারাও এদের দ্বারা শৃঙ্খলিত। তাদের সহযোগিতায় রয়েছে, রাজনীতি আশ্রিত বর্ণচোরা-প্রবঞ্চক-ধান্দাবাজ-অপ্রতিরোদ্ধ প্রতিবন্ধক অপশক্তি যার প্রতিধ্বনি আমাদের কৃষি বিধাতার নিখাদ বক্তব্যে “রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা যাচ্ছে না”। আমরা রাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠি, অথচ কোন রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে গণমাধ্যম পর্যন্ত কোথাও আমাদের কোন প্রকৃত প্রতিনিধি নেই। পরিতাপের বিষয় প্রায় সকল রাজনৈতিক দলের কৃষক শাখা রয়েছে যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগী অকৃষকদের দখলে। কোথাও আমাদের কথা বলার কোন সুযোগ, নেই ক্ষেত্র নেই, নেই দুর্দশা উপস্থাপনের কোন মাধ্যম। অধিকাংশই অকৃষিজীবী ব্যক্তি ও সংগঠন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে কৃষিজীবীদের প্রতিপক্ষ। দৈনন্দিন বাজার দর থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্ধারণের সকল মানদণ্ডই কৃষিপণ্য। ধারণাটা এমন যেন অকৃষিজ ব্যয় জীবনযাত্রার উপর কোন প্রভাব ফেলে না। তদুপরি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই ব্যয় নির্ধারণের প্রধান নিয়ামক চাল যা প্রকৃতপক্ষে একটি শিল্প পণ্য, অসাবধানতাবশত চালকে কৃষি পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়, ফলে ভোক্তাদের মনে ধান চাষীদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয়। চালের দাম বৃদ্ধি পেলে ধান চাষীরা হয়ে পড়ে ভোক্তাদের প্রতিপক্ষ, আড়ালে থেকে যায় মধ্যস্বত্বভোগী প্রকৃত কুচক্রীরা।

সর্বোপরী কৃষি পণ্যের দাম নিয়েই সকলের যত মাথা ব্যথা। ১০ টাকার কম গাড়ি ভাড়া নাই, তাতে কারো দুঃখ নাই। ১০ টাকার ভাড়া ৩০ টাকা চাই, কারো কোন দুঃখ নাই। কোটি কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ ফেরৎ আসে নাই, তাতে কারো কোন কথা নাই। ৫০০০ থেকে ১০,০০০ টাকার কম স্কুল কলেজে ভর্তি- সেসন ফি নাই, তাতে কারো দুঃখ নাই। ৫০০ টাকার কম ডাক্তারের ফি নাই, তাতে কারো দুঃখ নাই। বেতন ৪০ হাজার থেকে প্রথম লম্ফে ৮০ হাজার টাকা ভাই, আনন্দের সীমা নাই। ৮০ হাজার থেকে দ্বিতীয় লম্ফে দেড় লক্ষ টাকা ভাই, মহানন্দের সীমা নাই। নিরানন্দ শুধু, হাজারো কথা শুধু চাল, ডাল, পিয়াজ, কাঁচা মরিচের দাম নিয়ে। আপনাদের এক মাসের দেড় লক্ষ টাকা বেতন, মানে আমাদের ৩০০ মণ ধান, ৩/৪টি ধান চাষী পরিবারের সারা বছরের উপার্জন। অথচ আমরা একই ভৌগোলিক সীমানার, একই গ্রহের প্রাণী। শ্রদ্ধেয় সৈয়দ মুজতবা আলীর পাদটীকা গল্পের, পণ্ডিত মশাইয়ের পরিবার, লাট সাহেবের তিন ঠ্যাঙওয়ালা কুকুরের এক ঠ্যাঙের সমান ছিল, আমরা আপনাদের কয় ঠ্যাঙের সমান তার হিসাব মিলাতে পারি না। তাইতো আমরা মাঝে মধ্যে হয়ে পড়ি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য, ভুলে যাই এই দেশের জন্য আমরাও যুদ্ধ করেছিলাম, বাংকারের মাটির সাথে বুকের পাঁজর ঠেকিয়েছিলাম। ডিঙ্গাতে চাই এই ভৌগোলিক সীমানা, পাড়ি দিতে চেষ্টা করি মহাসমূদ্র। কখনো পাড়ি দিতে চেষ্টা করি গহীন জঙ্গল গিরিপথ, কখনো খুঁজে নেই আকাশ পথ। গ্রামীন উন্নয়নের যতটুকু দৃশ্যমান, তা বিভ্রান্ত কৃষকদের মৃত্যুশপথ বৈদেশিক উপার্জনের ফল, ক্ষেত্রবিশেষে প্রাযুক্তিক উন্নতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কোন ব্যাখ্যাতেই কৃষিভিত্তিক মূলধারার উন্নয়ন নয়। অথচ উন্নয়নের হুংকারে আমরা কম্পমান। গ্রাম হবে শহর, চারিদিকে উন্নয়নের জোয়ার, খুলিয়া স্মৃতির দক্ষিণ দুয়ার, উন্নয়নের মহাবিস্ফোরণের নিচে মহা-অন্ধকার, কৃষ্ণগহ্বর, তাতে আমরা দুই কোটি ধান চাষী পরিবার।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়