ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সামাজিক মাধ্যমের তেজ কতখানি?

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ৬ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১৬:৫৪, ৬ মার্চ ২০২১
সামাজিক মাধ্যমের তেজ কতখানি?

মূলধারার গণমাধ্যম ক্রমেই হেরে যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের কাছে। গণমাধ্যম নিজেই এখন সামাজিক মাধ্যমের আশ্রয় নিচ্ছে মানুষের কাছে পৌঁছাবার জন্য। বিশ্বের বিজ্ঞাপন বাজারটিও ক্রমে চলে যাচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।

এমন বাস্তবতায় সামাজিক মাধ্যমকেই এখন আসল মাধ্যম ভাবতে শুরু করেছে মানুষ। বাংলাদেশের মতো দেশে ফেইসবুকের নিউজ ফিডে যে তথ্য থাকে, তা পাওয়া যায় না পত্রিকায়, টেলিভিশনে বা অনলাইন পোর্টালে- মানুষ এমনটাই বলে। এর অর্থ হলো মানুষের তথ্য চাহিদার যোগান দিতে পারছে না স্বাভাবিক সংবাদ মাধ্যম। যে অভিযোগ ক’দিন আগেও ছিল যে, সামাজিক মাধ্যম ক্রমশ আমাদের অসামাজিক করে তুলছে- সে অভিযোগ আর নেই। বরং এখানেই স্বাভাবিকের চেয়ে যোগাযোগ বেশি হচ্ছে। ফেইসবুক সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় আমাদের দেশে এবং পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাঙালিরা সংযুক্ত এখানে; আছে টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ।

প্রথম দিকে সামাজিক মাধ্যমকে বাস্তব জীবনের অঙ্গ হিসেবে ধরা হতো না। অবকাশ বা অবসর বা বিনোদন বা দূরের বন্ধুকে খুঁজে পেতে বাস্তবের বাইরের একটা জগতে উঁকি দেওয়া হিসেবেই দেখা হতো। সামাজিক মাধ্যমে আমাদের বিচরণ ছিল সময় কাটানোর উপায়। ক্রমে সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে এসেছে, সামাজিক মাধ্যম আর জীবনের বাস্তবতা যেন একাকার হয়ে গেছে। জীবনের বাস্তব পরিসরেও আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক সামাজিক মাধ্যম, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় অপরিহার্য।

কিন্তু এই যে, বাস্তবতা বলছি, সত্যি কি এর কোনো প্রভাব পড়ছে সামগ্রিকভাবে? পশ্চিমা দুনিয়ার এক লেখায় দেখলাম বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে কনটেন্টের গড় স্থায়ীত্বকাল খুব কম। ফেইসবুক  মাত্র ৫ ঘণ্টা এবং প্রথম আড়াই ঘণ্টায় ৭৫ শতাংশ ভিউ থাকে, এরপর তা ফিকে হতে থাকে। ইন্সটাগ্রামে কোনো কনটেন্টের স্থায়ীত্বকাল ৪৮ ঘণ্টা, টুইটারে মাত্র ১৮ মিনিট, স্ন্যাপচ্যাট ২৪ ঘণ্টা এবং পিন্টারেস্ট এক বছর বা তার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ফেইসবুক ছাড়া অন্যগুলোর ব্যবহার খুব সীমিত। তাহলে এখানে কোনো কিছু লেখা হলে বা চিত্রায়িত হলে, তাকে এত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে কাউকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা বা চাপ প্রয়োগ করা কেন? এর যৌক্তিকতা অনুসন্ধান প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

সামগ্রিক বিচারে একথা বলা যায় যে, সামাজিক মাধ্যমে বিপ্লব করা যায় না। সামাজিক মাধ্যমের হইচই শাসন কার্যে যারা থাকেন তাদের জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করে না। কেউ কেউ বলছেন, সামাজিক মাধ্যম বরং সরকারের উপকার করে। রাজপথে কিছু না করে, অন্য কোনো ধংসাত্মক পথে না-গিয়ে মানুষ এখানে কিছু লিখে বা বলে ক্ষোভ প্রশমিত করে, যা সরকারের জন্য বড় জটিলতা সৃষ্টি করে না। কারণ যেখানে কনটেন্টের স্থায়ীত্বকাল এত কম, ক্রমেই নতুন নতুন বিষয় এসে দ্রুততার সঙ্গে পুরোনো ইস্যুকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, সে তো সরকারের জন্য উপকারই বটে। একের পর এক কনটেন্ট এসে হারিয়ে যায়। সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ প্রশমিত করতে না-পারলে সেগুলোর স্থায়ীত্ব আরও বেশি হতো বলেই মনে করেন তারা।

গত এক যুগে পৃথিবীতে বড় কোনো গণ-অভ্যুত্থানের নজির নেই। মিয়ানমারে ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ সব সামাজিক মাধ্যম বন্ধ। রাজপথের আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছে প্রতিদিন এবং প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার পরও। যে আরব বসন্তকে সামাজিক মাধ্যমের কারণে বড় করে দেখা হয় সেটিও সফল হয়নি চূড়ান্ত বিচারে।

বাংলাদেশে আইসিটি বা এই ধরনের আইনের ধারণা নিয়ে এসেছিল গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ২০০৬ সালে করা আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে অনেক প্রতিবাদ হয়েছে এবং আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, এটি বাতিল করা হবে। কিন্তু ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আরও বিবর্তনমূলক হয়েছে বলেই সংবাদ মাধ্যম, মানবাধিকার কর্মীসহ সকলের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে। বিএনপি যেহেতু ক্ষমতায় নেই, তাই তারা এই আইন বাতিলের দাবিকে সমর্থন করছে। কিন্তু একটা বাস্তবতা মানতেই হবে যে, বিএনপি-জামায়াতের মাথা থেকেই এই আইনের চিন্তা এসেছিল। এবং বিএনপি কখনও ক্ষমতায় এলে এ ধরনের আইন আর করা হবে না- এমন আশ্বাস তারা দিতেও পারবে না।

বাস্তবতা হলো, সরকার এবং প্রশাসনকে এই ডিজিটাল বাস্তবতাকে অন্য এক আঙ্গিকে দেখতে হবে। শৌখিনতার মোড়কে পেশ করা সামাজিক মাধ্যমের মোহাবেশ এমনই অপার যে, মানুষ কেবলই আবিষ্ট হয়ে পড়ছে, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হচ্ছে, অস্থির হচ্ছে কিন্তু কোনো স্থায়ী মতামত তৈরি করতে পারছে না, সরকারের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে না।

একটা কথা মানতেই হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমের অন্যতম একটা মুখ আছে, তা হলো উগ্রতার মুখ। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী এখানে উগ্রতার চর্চা করে, সমাজ-বিরোধীরা নারী, সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে। তাদের দিকটা লক্ষ্য রেখে সরকারের কর্ম কৌশল ঠিক করতেই হবে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতেই হবে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের আরেকটি মুখকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আর তা হলো গণতান্ত্রিক মুখ। মানুষ যদি কথা বলে হাল্কা হয়, দেখা যাক না কতদূর বলে?

মানুষকেও ভাবতে হবে বিষয়টি নিয়ে। সামাজিক মাধ্যম আমাদের অগ্রগতির অন্যতম সূচক। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োগটা জানা দরকার এবং বুঝে ব্যবহার করাটাই প্রত্যাশিত। এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের পরিসর পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝে নেওয়া খুব দরকার। সম্পর্কের সমীকরণটা মগজের মধ্যে গেঁথে নেওয়া প্রয়োজন। কিসে সাড়া দেব, কিসে হইচই করব বা করব না, সেটুকু অন্তত না বুঝতে পারলে আমরাই আমাদের ক্ষতি করব।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি ও সারাবাংলা

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়