ঢাকা     রোববার   ০৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২১ ১৪৩১

বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও বই

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ১৮ মার্চ ২০২১   আপডেট: ১২:২৪, ২০ মার্চ ২০২১
বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও বই

জন্মশতবর্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল এ কারণেই বিশ্বব্যাপী বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরিত হচ্ছেন না যে- তিনি এমন একজন সাহসী, সফল ও দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা যিনি তাঁর জনগণকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন; দিয়েছেন অনন্য এক আত্মপরিচয়- বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে যার তুলনা বিরল। বরং এসব পরিচয় ছাপিয়ে ক্রমেই উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে বিরল মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন এমন এক মহামানবীয় চরিত্র- যার শিকড় তাঁর দেশ ও জনগণের আত্মার গভীরতম প্রদেশে; আর যার মাথা দেশকালের মানচিত্র ছাড়িয়ে মহাকালের আকাশ স্পর্শ করেছে।

তাঁর লেখা অসাধারণ তিনটি বই এক্ষেত্রে কেবল গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকের ভূমিকাই পালন করেনি, সেসঙ্গে যুক্ত করেছে অনন্য এক নতুন মাত্রাও। মূলত এ গ্রন্থগুলোর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর অন্তসত্তার সম্যক পরিচয় লাভের পাশাপাশি আমরা আবিষ্কার করেছি এমন এক বড় মাপের লেখকসত্তাকে- যা যেকোনো বিচারে গর্ব করার মতো। প্রসঙ্গত যে-বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হলো- বঙ্গবন্ধু চরিত্রের এই যে ব্যাপ্তি ও বহুমাত্রিকতা বাংলাদেশের কবি, লেখক, শিল্পী ও গবেষকরা সেই বিশালতা ধরার চেষ্টায় অবিরাম সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, চিত্রকর্ম; রচিত হচ্ছে অজস্র প্রবন্ধ ও অভিসন্দর্ভ। প্রকাশিত হচ্ছে শত শত বই ও পত্রপত্রিকা। জীবদ্দশায় যেমন, তেমনি তাঁর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের পর অনিবার্যভাবে সেটি আরও ব্যাপকতর হয়েছে। বিশ্বের আর কোনো রাজনৈতিক নেতাকে ঘিরে সৃজনশীলতার এমন মহাযজ্ঞ হয়েছে কি-না তা আমাদের জানা নেই।

এ প্রশ্নটি উত্থাপিত হওয়া স্বাভাবিক যে, কেন একজন রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে সৃষ্টিশীল মানুষের এত উচ্ছ্বাস, এত উদ্দীপনা? জাতিকে বা নিজের জনগণকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন এমন নেতার নজির তো বিশ্বে একেবারে কম নয়। (গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া) কই, তাদের নিয়ে তো সৃষ্টিশীল মানুষের মধ্যে এত আগ্রহ, এত গভীরতর আলোড়ন দেখা যায়নি ইতিপূর্বে। লক্ষণীয়, ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিন যখন বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ আখ্যায়িত করেছিল, তখনো কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। আর ভারতের বিশিষ্ট কবি ও বুদ্ধিজীবী অন্নদাশঙ্কর রায় ১৯৭১ সালেই রচনা করেছিলেন এই অমর পঙক্তিমালা: 

আরো পড়ুন:

‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা 
গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার 
শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা 
রক্তগঙ্গা বহমান 
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, 
জয় মুজিবুর রহমান।’

বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধুর মতোই উপর্যুক্ত দুই অভিধা ও সৃষ্টিকর্মও অমরতা পেয়েছে। অর্থাৎ এটি স্পষ্ট যে দেশ স্বাধীন করার আগেই তিনি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন। ব্যাপকভাবে নজর কেড়েছিলেন দেশিবিদেশি কবি-লেখক ও সাংবাদিকদের। সঙ্গত কারণেই কারবালার শোকাবহ ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ যে পঁচাত্তর ট্র্যাজেডি তা সংঘটিত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বদেশী বা বিদেশি লেখক-সাংবাদিকদের উচ্ছ্বসিত মন্তব্য, বক্তব্য বা রচনা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তাঁর জীবদ্দশায়ও কেন তাঁকে ঘিরে বিদেশি সাংবাদিক ও কবির এমন মন্তব্য ও রচনা?

এর উত্তরে সোজাসাপ্টা বলা যায়, ক্যারিশমেটিক লিডার বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তাই। তাঁর ব্যক্তিত্বে যে একটি সম্মোহনী ব্যাপার ছিল সেটি এমনকী ফিদেল ক্যাস্ট্রোও স্বীকার করেছেন অকপটে। তবে বঙ্গবন্ধুর অনন্যতা ব্যাখ্যা করার জন্যে বা বোঝার জন্যে কেবল এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। আরও কিছু একটা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বে বা চরিত্রে। সেটি বুঝতে হলে এই যে ক্যারিশমা বা সম্মোহনের কথা আমরা বলছি তার উৎসটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এ প্রসঙ্গে খুব দৃঢ়তার সঙ্গে যে কথাটি বলা যায় সেটি হলো, বঙ্গবন্ধু ছিলেন আপাদমস্তক একজন বাঙালি। আবহমান বাংলার রূপ-রস-ঘ্রাণ শুধু নয়, তিনি তাঁর চরিত্রে ধারণ করেছিলেন বাংলার সমগ্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে। বাংলার ‘দুঃখী মানুষ’কে যেমন তিনি তার সমগ্র সত্তা দিয়ে ভালোবেসেছিলেন, তেমনি আপন অস্তিত্বের অংশ করে নিয়েছিলেন দেশজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে। এখানে, সংক্ষিপ্ত পরিসরে, কেবল এটুকু বলাই যথেষ্ট যে কেবল বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি গ্রন্থে তাঁর বই ও সংগীতপ্রীতির এত এত দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে যে তা নিয়ে পৃথক একটি গ্রন্থ রচিত হতে পারে।


বঙ্গবন্ধুর মাত্র ৫৫ বছরের হ্রস্ব জীবনকালের (১৯২০-১৯৭৫) প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সময়ই কেটেছে কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠে। ফাঁসির আসামিদের জন্যে নির্ধারিত সেলেও রাখা হয়েছে তাঁকে দিনের পর দিন। মানসিক নিপীড়ন করা হয়েছে নানাভাবে। এই কঠিন সময়ে সর্বোচ্চ নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি যে দুটি কাজ করে গেছেন তার একটি হলো বই পড়া, অন্যটি লেখা। তাঁর অবশ্যকরণীয় নিত্যকর্মের তালিকার পুরোভাগে আরও ছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেশি-বিদেশি পত্রিকা ও ম্যাগাজিন পড়া। থাকা-খাওয়া- এমনকী চিকিৎসা নিয়েও তাঁর তেমন কোনো অভিযোগ ছিল না, কিন্তু কোনো কারণে নিয়মিত পত্রিকা পাঠে ব্যত্যয় ঘটলে তিনি অস্থির হয়ে উঠতেন। এটি জেল কর্তৃপক্ষ যেমন জানতেন, তেমনি জানতেন বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়স্বজন ও দলের নেতাকর্মীরা। তিনি লিখেছেন: ‘আমার আব্বা খবরের কাগজ রাখতেন। আনন্দবাজার, বসুমতী, আজাদ, মাসিক মোহাম্মদী ও সওগাত। ছোটকাল থেকে আমি সকল কাগজই পড়তাম।’ দীর্ঘ কারাজীবনে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ‘নিউজউইক’ ম্যাগাজিনসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিদেশি পত্রপত্রিকা। পত্রিকা প্রকাশনা ও বিপণনের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন নানাভাবে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকাটি এখনো তার অকাট্য প্রমাণ হয়ে টিকে আছে।

বই পড়ার প্রসঙ্গে পরে আসি। সবাই যে লেখক নন এবং লেখা যে মোটেও সহজসাধ্য কোনো কাজ নয় তা পৃথিবীর বহু বড় লেখকই অকপটে বলে গেছেন। রাজনীতিক বঙ্গবন্ধু যিনি জীবনে সচেতনভাবে কখনো লেখালেখির চর্চা করেননি কিংবা সেই অবকাশও তাঁর ছিল না- সেই মানুষটি কারা অভ্যন্তরে কতোটা নিষ্ঠার সঙ্গে দিনের পর দিন এই শ্রমসাধ্য কাজ করে গেছেন সামগ্রিকভাবে তার উজ্জ্বলতম দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’। এ সীমিত পরিসরে গ্রন্থগুলোর মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। তবে এটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বই ৩টি তাদের নিজ গুণেই দেশকালের সীমানা অতিক্রম করবে। ইতোমধ্যে তার আলামতও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর বইগুলো। সে তালিকায় যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও বহু ভাষার অনুবাদকর্ম। আর দেশের ভেতরে বই বিক্রির সমস্ত রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে বঙ্গবন্ধুর এ তিনটি বই। প্রসঙ্গত লক্ষণীয় যে, আজ থেকে ৮ বছর আগে বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক ও বিশিষ্ট গবেষক শামসুজ্জামান খান লিখেছেন:

দুখানি বই (অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা) বাংলাদেশের প্রকাশনা ও বই বিক্রির ইতিহাসে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। ইতোমধ্যে অসমাপ্ত আত্মজীবনীর লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে এবং কারাগারের রোজনামচা বইটিও এক বছরের কম সময়ের মধ্যে ৭০ হাজার কপি নিঃশেষিত হয়েছে। বাংলাদেশে আর কোনো রচনা এমন বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেনি। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এ এক নতুন ঘটনা।

বঙ্গবন্ধুর বইপ্রীতি এককথায় বিস্ময়কর। তিনি ছিলেন আগ্রাসী পাঠক। দেশিবিদেশি সব ধরনের বই-ই তিনি পড়তেন। কারার অভ্যন্তরে সব সময় পছন্দের বই যেমন পাওয়া যেত না, তেমনি কারা কর্তৃপক্ষ অনেক সময় উদ্দেশ্যমূলকভাবেও বই-সংকট তৈরি করে রাখতেন। বঙ্গবন্ধু এটি জানতেন বলে সব সময় কিছু বই অপরিহার্যভাবে সঙ্গে রাখতেন। আবার দরকারি বইটি চেয়েও পাঠাতেন রাজনৈতিক সহকর্মীদের কাছে। তাঁর জ্যেষ্ঠকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: 

১৯৪৯ সাল থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন, কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল, যা সবসময় আব্বার সঙ্গে থাকত।...তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলী, শরৎচন্দ্র রচনাবলী, নজরুলের রচনা, বার্নাড শ, রাসেল, শেলী ও কীটসসহ বেশ কয়েকখানা বই। এর মধ্যে কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়। তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পর পর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলিতে ছিল।...মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মার সঙ্গে আমরাও যেতাম। সব সময়ই বই কেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল।

১৯৫১ সালে কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু গোপনে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে লিখেছেন, ‘আমার জন্যে কিছুই পাঠাবেন না। আমার কোনো কিছুরই দরকার নাই। নতুন চীনের কিছু বই পত্রিকা যদি পাওয়া যায় তবে আমাকে পাঠাবেন।

ইতিহাসখ্যাত বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়িটিতে যে একটি সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল তা সুবিদিত। সেই পাঠাগারে বইনিমগ্ন বঙ্গবন্ধুর একাধিক ছবিও এখন আমাদের জাতীয় ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। শুধু বইই নয়- জসিমউদ্দিন, শহীদুল্লা কায়সার, সরদার ফজলুল করিম, মুনীর চৌধুরী, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, জহুর হোসেন চৌধুরী ও আবদুল গাফফার চৌধুরীসহ দেশের প্রথম সারির লেখক-সাংবাদিকদের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক ছিল তাঁর। নিয়মিত পড়তেন তাদের লেখা। চিনতেন উল্লেখযোগ্য সব লেখক-শিল্পীকে। সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর হৃদয়টা ছিল কবির। সেই কবিসত্তার পরিচয় ছড়িয়ে আছে তাঁর রচনাবলির প্রায় সর্বত্রই। একটি উদাহরণ লক্ষ করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: 

নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন...গান গাইছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। ...আমি আব্বাসউদ্দিন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। 


টুঙ্গিপাড়ার খোকা নামের দুরন্ত বালকটির বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হয়ে উঠার দীর্ঘ ও দুর্গম পথরেখার দিকে তাকালে কয়েকটি স্বর্ণখচিত মাইলফলক আমাদের পথরোধ করে দাঁড়ায়। তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো- বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, ছিষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং মহান মুক্তিযুদ্ধ। প্রথমে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলন, তারপর রবীন্দ্রসংগীত তথা সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই, সবশেষে স্বাধিকার হয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রতিটি পর্যায়ে সংস্কৃতিই হচ্ছে চালিকাশক্তি আর দেশবাসীর আশাভরসার প্রতীক হয়ে চালকের আসনে যিনি বসে আছেন তাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে বাংলা ভাষার অধিকার সুনিশ্চিত করার পাশাপাশি বাংলা একাডেমি থেকে শুরু করে শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত আমাদের প্রকাশনা ও শিল্পসংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও অমলিন হয়ে আছে তাঁর সংস্কৃতিমনস্ক দেশদরদি হৃদয়ের ছোঁয়া। পাশাপাশি এটাও লক্ষণীয় যে, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ১৯৭২ সালেই যে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়েছিল-  বঙ্গবন্ধুর সহৃদয় সমর্থন ছাড়া তা কখনোই সম্ভব হতো না। মাত্র দুবছরের ব্যবধানে ঢাকায় জাতীয় গ্রন্থমেলা (১৯৭৪) এবং চট্টগ্রামে জাতীয় গ্রন্থমেলা (১৯৭৫) নামে আরও দুটি বৃহদাকার বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সর্বোপরি, ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ঢাকায় সাতদিনব্যাপী যে গ্রন্থ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাও ধন্য হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সানন্দ পৃষ্ঠপোষকতায়।

প্রসঙ্গত জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের তৎকালীন কর্মকর্তা বিশিষ্ট লেখক ও সম্পাদক বদিউদ্দিন নাজির আরও জানিয়েছেন যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য হওয়া সত্ত্বেও সেই ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু ২৫ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছিলেন জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্যে। সেই সময়ের বিচারে এটি ছিল বড় ধরনের অর্থসহায়তা।১০

বঙ্গবন্ধু আমৃত্যু সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে গেছেন। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি বলেছেন, সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। আর এ জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। সেই সোনার মানুষ গড়ার সুদৃঢ় প্রত্যয়ে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র তাঁরই নির্দেশিত পথে দেশের প্রায় ৮শ বেসরকারি পাঠাগারকে নিয়মিত অর্থ ও বই সহায়তা প্রদান করছে। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে করোনাসৃষ্ট মহাদুর্যোগের মধ্যেও প্রায় ৪ কোটি টাকার বই ক্রয় করা হয়েছে দেশের তিন শতাধিক প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে। আরও দুই কোটি টাকা অনুদান হিসেবে সরাসরি প্রদান করা হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে উঠা তৃণমূল পর্যায়ের পাঠাগারগুলোকে। এটি একদিকে যেমন দেশীয় প্রকাশনা শিল্পের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের অবহেলিত পাঠাগারগুলোকেও ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিতে প্রণোদিত করছে।

বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ উপলক্ষে জাতীয় গ্রন্থাগার নীতির আলোকে যে যুগান্তকারী সংকল্পটি গ্রহণ করেছে তা হলো- ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার/গ্রামে গ্রামে পাঠাগার।’ করোনা যখন আমাদের পাঠাগারগুলোর দরোজা বন্ধ করে দিয়েছে, তখন গ্রামে গ্রামে পাঠাগার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে ঘরে বইও পৌঁছে দিতে চায়। জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পক্ষ থেকে আমরা বলেছি, এতকাল পাঠক পাঠাগারে এসেছে, এখন পাঠাগারই যাবে পাঠকের কাছে। এ অঙ্গীকারকে সামনে রেখে ‘পড়ি বঙ্গবন্ধুর বই/সোনার মানুষ হই’ শিরোনামে ইতোমধ্যে একটি ধারাবাহিক পাঠ কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের উদ্যোগে রাজধানী ঢাকার স্বনামধন্য ১০টি পাঠাগারের সহায়তায় গৃহীত এ পাঠ কার্যক্রমটি ইতোমধ্যে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। সাড়া জাগিয়েছে গৃহান্তরীণ কিশোর-তরুণদের মধ্যে। ২০২১ সালে আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে বই পড়ার এ কার্যক্রমটি সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ারও প্রস্তুতি চলছে। সেসঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে ‘সেলুন লাইব্রেরি’ চালু করার একটি পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।

দেশেবিদেশে বইমেলা/বইপ্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ এবং বইমেলা/বইপ্রদর্শনীর আয়োজনও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা, লন্ডন বইমেলা, নিউইয়র্ক বইমেলা ও কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি প্রতি বছর বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বেশকিছু বইমেলার আয়োজন করে থাকে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। উদ্দেশ্য হচ্ছে, বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ সৃষ্টি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং সর্বোপরি প্রকাশনা শিল্পের উন্নয়ন। গ্রন্থোন্নয়নেও রয়েছে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সেমিনারসহ নানাবিধ উদ্যোগ। যে-কথাটি না বললেই নয় তা হলো- বিশ্বজুড়েই ফেসবুক, ইউটিউব ও টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসমূহের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা, তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় বিকাশ ও সহজলভ্যতাসহ নানা কারণে বই থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে মানুষ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কারণ তথ্যপ্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান আসক্তির কারণে তারা শারীরিক ও মননশীলতার চর্চা থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের প্রকাশনা শিল্পেও। কোভিড-১৯ মহামারির দীর্ঘ আগ্রাসন সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে। এ অবস্থায় বিশেষ করে কিশোর, তরুণ ও যুবসমাজকে আবারও বইমুখি করাই হচ্ছে আজকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে।

তথ্যসূত্র:
১.    নিউজউইক, ৫ এপ্রিল ১৯৭১
২.   কাঁদো প্রিয় দেশ, অন্নদাশঙ্কর রায়, অন্বেষা  
৩.    অসমাপ্ত আত্মজীবনী (ঢাকা: ইউপিএল, জুন ২০১২); কারাগারের রোজনামচা (বাংলা একাডেমি: মার্চ ২০১৭);  আমার দেখা নয়াচীন (বাংলা একাডেমি: ফেব্রুয়ারি ২০২০)
৪.    শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, (প্রাগুক্ত) পৃ-১০ 
৫.    শামসুজ্জামান খান, ‘লেখক বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য’, (ঢাকা: কাকলী প্রকাশনী, ফেব্রুয়ারি ২০১৯), পৃ-১১
৬.    শেখ হাসিনা, “স্মৃতি বড় মধুর স্মৃতি বড় বেদনার”, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত ‘মানুষের বন্ধু বঙ্গবন্ধু’, (ঢাকা ২০১২), পৃ ৯৭-৯৮) 
৭.    উদ্ধৃত, ড. মোহাম্মদ হাননান, মানিক মিয়াকে লেখা বঙ্গবন্ধুর চারটি ঐতিহাসিক চিঠি, শাহ আলমগীর সম্পাদিত ‘নিরীক্ষা’; (পিআইবি, জুলাই-আগস্ট ২০১৫), পৃ-৪১-৪২  
৮.     শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী (প্রাগুক্ত), পৃ-১১১
৯.     অনুপম হায়াৎ, ‘বইয়ের বন্ধু বঙ্গবন্ধু’, (ঢাকা: তৃণলতা প্রকাশ, ২০১৮), পৃ-২৮
১০.    টেলিফোনে নিবন্ধকার কর্তৃক নেওয়া সাক্ষাৎকার, (ঢাকা: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)

 

মিনার মনসুর: কবি ও প্রাবন্ধিক। পরিচালক, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র

    
 

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়