ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (শেষ পর্ব)

মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৯, ২০ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ২০:২৮, ২০ এপ্রিল ২০২১
পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (শেষ পর্ব)

ছয়. অর্থ ও বানান বিষয়ক আলোচনা

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে ‘বাগর্থ’ শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদ আছে। এই পরিচ্ছেদের শুরুতে বাগর্থের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এভাবে — “শব্দ ও বাক্যের অর্থের আলোচনা হলো বাগর্থ।” শব্দ আর বাক্যের অর্থের আলোচনা যদি বাগর্থ হয় তাহলে বাগর্থতত্ত্ব কী ? বলা হয়েছে, “অভিধানে প্রতিটি শব্দের অর্থ থাকে। কিন্তু সেই অর্থের বাইরে নানা অর্থে শব্দ ব্যবহৃত হয়। বাগর্থতত্ত্বে এসব দিক বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হয়।” (পৃ. ৫১)। অর্থাৎ, ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলীর বিবেচনায়, ‘বাগর্থ’ আর ‘বাগর্থতত্ত্ব’ এই পরিভাষা দুটি সমার্থক। এবিষয়ে তাঁদের সাথে নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী একমত হতে পারেননি। জানিয়েছেন, “শব্দের বৈচিত্রময় অর্থকে বাগর্থ বলে।” (পৃ. ১০৬)। প্রাগুক্ত দুই ব্যাকরণের লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী অর্থ সম্পর্কিত আরও কোনো কোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেন। তাই শব্দের অভিধান-অতিরিক্ত অর্থ ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে ‘রূপক’ (পৃ. ৫৩) আর নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘লক্ষার্থ’ (পৃ. ১০৬) হিসেবে বর্ণিত হয়েছে।

বোর্ডের ষষ্ঠ, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে ‘বানান’ শিরোনামে একটি করে পরিচ্ছেদ আছে। ষষ্ঠ শ্রেণির পরিচ্ছেদটি তিন অংশে বিভক্ত — ভূমিকা, ‘বানানের ধারণা’ ও ‘বানানের নিয়ম’। ‘বানানের ধারণা’ অংশের শেষ বাক্যটি এরকম — “বাংলা একাডেমির বানানরীতি এখন সর্বত্র মানা হচ্ছে।” (পৃ. ৫৭)। এই বাক্য পড়ে এমটা মনে হতেই পারে যে, ‘বানানের নিয়ম’ অংশে একাডেমির বানানরীতি অথবা তার প্রধান নিয়মগুলির বিবরণ থাকবে। কিন্তু আসলে তা নেই। ঐ অংশে ব্যাকরণটির লেখক-সম্পাদকমণ্ডলী নিজেদের বিবেচনা মতো বানানের ছয়টি নিয়ম সংকলন করেছেন। নিয়মগুলির বিবরণ এরকম — 

১. বিদেশি শব্দের (ইংরেজি, আরবি-ফারসি ও অন্যান্য ভাষার শব্দ) বানানে সব সময় হ্রস্ব ই বা ই-কার (ি) হবে।... ২. বাংলা শব্দের বানানে সব সময় হ্রস্ব ই বা ই-কার (ি) হবে।... ৩. ভাষা ও জাতিবাচক শব্দের শেষে হ্রস্ব ই-কার হবে।... ৪. ইংরেজি শব্দে a-উচ্চারণ যেখানে অ্যা সেখানে এর জন্য অ্যা, s-এর উচ্চারণ যেখানে দন্তমূলীয় স্ সেখানে s-এর জন্য স, যেখানে শ-এর জন্য sh এবং  st-এর জন্য স্ট হবে।... ৫. সংস্কৃত বা তৎসম শব্দে ‘র’-এর পরে ‘ণ’ (মূর্ধন্য-ণ) হবে।... ৬. বাংলা শব্দে র-এর পর ন হবে। (পৃ. ৫৭-৫৮)।  

লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে, নিয়মের বিবরণে ‘বিদেশি শব্দে’র পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সংস্কৃত শব্দ বললে ‘তৎসম’ শব্দ বোঝায় তাও বলা হয়েছে, শুধু বলা হয়নি ‘বাংলা শব্দ’ (২ ও ৬ সংখ্যক নিয়মে উল্লিখিত) বলতে কী বোঝায়। তৎসম আর বিদেশি শব্দ ছাড়া আর সব শব্দই কি ‘বাংলা শব্দ’? স্পষ্ট করে বলা উচিত ছিল। উচিত ছিল বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত শব্দরাজির উৎসগত শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিয়ে তারপর বানানের নিয়ম লিপিবদ্ধ করা। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে বাংলা শব্দের উৎসগত শ্রেণিবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা আছে।(পৃ. ৫১)। ঐ আলোচনায় ‘বাংলা শব্দ’ নামে কোনো শব্দশ্রেণির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। ষষ্ঠ শ্রেণির বানান-পরিচ্ছেদের ‘বানানের নিয়ম’ অংশে যে ছয়টি নিয়ম সংকলিত হয়েছে সেগুলির প্রথম তিনটিতে বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতির ‘অতৎসম শব্দ’ শীর্ষক পরিচ্ছেদের প্রথম (২.১ সংখ্যক) নিয়মের একাংশের বক্তব্য স্থান পেয়েছে। তিন-তিনটি নিয়ম রচনা করেও একাডেমির একটি নিয়মের বক্তব্য পুরোপুরি তুলে ধরা গেল না! একাডেমির ঐ নিয়মে আছে— 

সকল অতৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কারচিহ্ন ি  ু ব্যবহৃত হবে।... পদাশ্রিত নির্দেশক টি-তে ই-কার হবে।... সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ ও যোজক পদরূপে কী শব্দটি ঈ-কার দিয়ে লেখা হবে।... যেসব প্রশ্নবাচক বাক্যের উত্তর হ্যাঁ বা না হবে, সেইসব বাক্যে ব্যবহৃত ‘কি’ হ্রস্ব ই-কার দিয়ে লেখা হবে। (বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম, পরিমার্জিত সংস্করণ, ২০১২, পৃ. ১৭-১৮)।

‘বানানের নিয়ম’ অংশের চতুর্থ নিয়মের বিবরণে গোলমাল আছে। নিয়মটিতে লেখক-সম্পাদকগণ সম্ভবত বলতে চেযেছেন— “ইংরেজি শব্দে a-এর উচ্চারণ যেখানে অ্যা সেখানে a-এর জন্য অ্যা, s-এর উচ্চারণ যেখানে দন্তমূলীয় স্ সেখানে s-এর জন্য স, sh-এর উচ্চারণ যেখানে তালব্য শ্ সেখানে sh-এর জন্য শ এবং st-এর জন্য স্ট হবে।” পঞ্চম নিয়মে “তৎসম শব্দে ‘র’-এর পরে ‘ণ’ (মূর্ধন্য-ণ)” এবং ষষ্ঠ নিয়মে “বাংলা শব্দে র-এর পর ন” ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। কিন্তু বিদেশি শব্দে র-এর পরে ‘ণ’ আর ‘ন’-এর মধ্যে কোনটি ব্যবহার করতে হবে তা বলা হয়নি।

সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের বানান-পরিচ্ছেদেও কিছু বিচ্যুতি-অসঙ্গতি আছে। পরিচ্ছেদ দুটি থেকে একটি করে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সপ্তম শ্রেণির ব্যাকরণের বানান-পরিচ্ছেদের শেষাংশ “ষত্ব-নিষেধ (বানানে দন্ত্য-স)” শীর্ষক। এর প্রথম নিয়মে বলা হয়েছে, “তদ্ভব বা খাঁটি বাংলা শব্দে মূর্ধন্য-ষ হয় না, দন্ত্য-স হয়। যেমন: মিনসে।” (পৃ. ৭২)। একথা ঠিক নয়। তদ্ভব শব্দে ষ - স দুটিই চলে। ওষুধ, চাষ, মানুষ, ষাট, ষোল, ষাঁড় ইত্যাদি তদ্ভব শব্দের ‘ষ’-যুক্ত বানান ব্যাপকভাবে গৃহীত ও প্রচলিত। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বই-পত্রেও শব্দগুলির বানানে ‘ষ’ ব্যবহার করা হয়। অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণের বানান-পরিচ্ছেদে যে নিয়মগুলি সংকলিত হয়েছে সেগুলির প্রথমটি এরকম— “যেসব তৎসম শব্দের বানানে হ্রস্ব ও দীর্ঘ উভয় স্বর (ই ঈ, উ ঊ) অভিধানসিদ্ধ, সে ক্ষেত্রে এবং অতৎসম (তদ্ভব, দেশি, বিদেশি, মিশ্র) শব্দের বানানে শুধু  হ্রস্বস্বর (ই ি , উ  ু ) হবে।” (পৃ. ৬৬)। এখানে লক্ষ্য করার বিষয় হলো, অতৎসম শব্দ বলতে তদ্ভব, দেশি, বিদেশি আর মিশ্র শব্দকে বোঝানো হয়েছে। বাদ গেছে অর্ধ-তৎসম শব্দের কথা।

সাত. সমস্যার কারণ ও সমাধানের উপায়

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ষষ্ঠ, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ‘বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ বইয়ের ‘প্রসঙ্গ কথা’ অংশটি অভিন্ন। এতে বলা হয়েছে, “পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে অতি অল্প সময়ে পুস্তকটি রচিত হয়েছে। ফলে কিছু ত্রুটি থেকে যেতে পারে।” এতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ ‘অতি অল্প সময়ে’ কেন করতে হলো সে-বিষয়ে সমালোচনায় প্রবৃত্ত না হয়েও আমরা বলতে পারি, বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে যে-ত্রুটি আছে তা পরিমাণে ‘কিছু’ নয়, প্রচুর। তাছাড়া, বোর্ডের ব্যাকরণগুলি পরীক্ষা করে আমাদের মনে হয়েছে, ত্রুটি কেবল রচনাতেই নয়, পরিকল্পনাতেও আছে। যথেষ্ট সময় নিয়ে, ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা করা হয়নি। কোন শ্রেণির ব্যাকরণে কোন বিষয় কতখানি আলোচিত হবে, কোন বিষয়টি আগে আর কোনটি পরে আলোচনা করতে হবে, অধ্যায়-পরিচ্ছেদ-অনুচ্ছেদের বিভাজন-বিন্যাস কীরকম হবে এবং অন্য ভাষার প্রথাগত ব্যাকরণের সূত্র-সিদ্ধান্ত নির্বিচারে গ্রহণ-ব্যবহার করা যাবে কিনা, এসব ব্যাপারে বোর্ডের ব্যাকরণগুলোর লেখক-সম্পাদকদের কাছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছিল বলে মনে হয় না। যদি তা থাকতো তাহলে শিক্ষার্থীরা ষষ্ঠ শ্রেণিতেই ব্যাকরণ কী সে-বিষয়ে ধারণা লাভ করত, ধ্বনি-শব্দ-বাক্যের বিভিন্ন সংজ্ঞা পেত না তারা, শব্দগঠনের আগে পদনির্মণের কৌশল শিখতে হতো না তাদের, বহু অপ্রয়োজনীয় সূত্র-দৃষ্টান্ত মুখস্ত করার কষ্ট থেকে, পরস্পরবিরোধী নানা বর্ণনা-বিবরণ পড়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেত তারা।

বোর্ডের প্রথম ব্যাকরণ অর্থাৎ ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণে প্রধান্য পেয়েছে ধ্বনি সম্পর্কিত আলোচনা। এই আলোচনা পরিমাণের দিক থেকে ভাষা, শব্দ, বাক্য ও অর্থ বিষয়ক আলোচনার সমষ্টির প্রায় সমান। বোর্ডের অন্য তিন ব্যাকরণে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে রূপতত্ত্ব — শব্দ আর পদ সম্পর্কিত আলোচনা। রূপতত্ত্ব, সপ্তম আর অষ্টম শ্রেণির ব্যাকরণে ধ্বনিতত্ত্ব ও বাক্যতত্ত্বের সমষ্টির চেয়েও বেশি অংশ জুড়ে আছে। নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণে তা আছে ধ্বনিতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব আর অর্থতত্ত্বের সমষ্টির প্রায় সমান অংশ জুড়ে। অথচ, ব্যাকরণগুলিতে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার কথা বাক্যতত্ত্বের। কারণ, বাক্যই ভাষার কেন্দ্রবস্তু — বাক্যের সাহায্যেই মানুষ ভাষিক যোগাযোগ সম্পন্ন করে থাকে। একথা অবশ্য স্বীকার করতেই হবে, কেবল পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণে নয়, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া, প্রথাগত ধারার সব বাংলা ব্যাকরণেই রূপতত্ত্বের প্র্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। শব্দ আর পদের আলোচনাই থাকে এধারার ব্যাকরণের বড় অংশটা জুড়ে। এর কারণ কী? হুমায়ুন আজাদের পর্যবেক্ষণ অনুসারে —

রূপতত্ত্বকে আমাদের ব্যাকরণ বইগুলোতে প্রধান স্থান দেয়া হয়, কেননা ও-বিষয়ে শতাব্দী পরম্পরায় কাজ হয়েছে, তাই ও-বিষয়টিকেই সহজ সম্বল করে নেন ব্যাকরণ রচয়িতারা। ... আমাদের ব্যাকরণবিদেরা ধরে নেন যে, বাক্য গঠন করতে আমরা সবাই জানি; এবং বাক্যের অর্থ বুঝি বেশ চমৎকারভাবে, শুধু যা পারি না, বুঝি না, তা হলো শব্দগঠন। তাই সমাসের উপর, সন্ধির উপর, প্রত্যয়ের উপর, বিভক্তির উপর, উপসর্গের উপর তাদের দৃষ্টি পড়ে — দৃষ্টি পড়ে না বাক্যের উপর, অর্থের উপর।” (‘ব্যাকরণবোধ এবং বাংলা ব্যাকরণ’, একুশের সংকলন/৭৭,  বাংলা একাডেমি, ঢাকা ১৯৭৭, পৃ. ৬৮-৬৯)।  

পবিত্র সরকার একে অর্থাৎ ব্যাকরণে রূপতত্ত্বের ওপর অধিক গুরুত্বারোপের ব্যাপারকে, ‘‘একধরনের অভ্যাস-আলস্যের মৌমাছিতন্ত্র’’ বলেছেন এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, “রামমোহন, হরপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর প্রমুখ কয়েকজন তা ভাঙবার চেষ্টা করেও ভাঙতে পারেননি।” (পবিত্র সরকারের পূর্বোক্ত প্রবন্ধ, পৃ. ৪৯)

রামমোহন, হরপ্রসাদ, রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর প্রমুখ সফল হতে পারেননি, খুব সম্ভবত, তাঁদের চেষ্টা সংঘবদ্ধ কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না বলে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাক্ষেত্রে এর যে মান্যতা আছে তা আর কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানের নেই। বোর্ড চাইলে, সচেষ্ট হলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় নয় এমন অনেক সংজ্ঞা-সূত্র-উদাহরণ-বিবরণ আছে বোর্ডের ব্যাকরণগুলির রূপতত্ত্ব অংশে। অন্য অংশগুলিতেও আছে বেশ কিছু।

বোর্ড এসব বাদ দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। তাছাড়া, একই বিষয়ের বিবরণ-বিশ্লেষণ একাধিক শ্রেণির ব্যাকরণের অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে বোর্ড। বর্তমানে ধ্বনি-শব্দ-বাক্যের সংজ্ঞা আর শ্রেণিকরণ, ণ-ত্ব ও ষ-ত্ব বিধি, উপসর্গ, প্রত্যয়, শব্দদ্বৈত, সন্ধি, লিঙ্গ, বচন, বিভক্তি, কারক, আকাঙ্ক্ষা-আসত্তি-যোগ্যতা, উদ্দেশ্য-বিধেয়তত্ত্ব, বিরামচিহ্ন, প্রতিশব্দ বা সমার্থক শব্দ, বিপরীতার্থক শব্দ, বাগধারা ইত্যাদি বিষয়ের মধ্যে কোনোটির আলোচনা দুই ব্যাকরণে, কোনোটির আলোচনা তিন ব্যাকরণে আর কোনোটির আলোচনা চার ব্যাকরণেই আছে। একের অধিক ব্যাকরণে এগুলি না থাকলেও চলে। প্রয়োজনে পুনরুল্লেখ থাকতে পারে, পুনরালোচনা অনাবশ্যক। প্রাগুক্ত বিষয়সমূহের পুনরালোচনার পরিবর্তে ব্যাকরণগুলিতে অধিক পরিমাণে বাক্য বিষয়ক পাঠ যুক্ত করার সিদ্ধান্ত যদি নেয় বোর্ড, তাহলে শিক্ষার্থীরা লাভবান হবে।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে বাক্য সম্পর্কিত আলোচনাকে প্রধান স্থান দেওয়া দরকার। দরকার শিক্ষার্থীদের বাক্যবোধ জাগানো চেষ্টাকে ব্যাকরণগুলির মূল উদ্দেশ্য হিসাবে গ্রহণ করা। “পশ্চিমে এ-চেষ্টা অন্তহীন। সেখানে শিক্ষার্থীদের মনে বাক্যবোধ সৃষ্টির নিরন্তর চেষ্টা চালানো হয়, ও শুদ্ধ বাক্য রচনার কৌশল শেখানো হয় নিত্য অভিনব উপায়ে।” (হুমায়ুন আজাদ, বাক্যতত্ত্ব, পৃ. ১৮)।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকেও অনুরূপ উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ, আকাঙ্ক্ষা-আসত্তি-যোগত্যার প্রথাগত বিবরণ দিয়ে, উদ্দেশ্য-বিধেয়ের প্রচলিত তত্ত্ব গলাধঃকরণ করিয়ে, সরল-জটিল-যৌগিক বাক্যের গতানুগতিক জ্ঞান দিয়ে, বাচ্য বা উক্তিপরিবর্তনের কিছু নিয়ম শিখিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথার্থ বাক্যবোধ জাগানো যাবে না। তাদের সামনে বাক্যের রহস্য উন্মোচন করতে হবে। বাংলা বাক্যে কোন পদ কোথায় বসে, কোন পদ কী কাজ করে, পদগুচ্ছ কত রকমের হতে পারে, পদগুচ্ছগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হয়, বাক্যের কোন অংশ (উদ্দেশ্য-বিধেয়) কত ধরনের হতে পারে, বাক্য কত ছোট বা কত বড় করা সম্ভব, কত বিচিত্র উপায়ে গঠিত হতে পারে সরল-জটিল-যৌগিক বাক্য, আদেশ-নিষেধ-অনুরোধ-প্রশ্নকরণের শৃঙ্খলা কী, আগের বাক্যের সঙ্গে পরের বাক্যের সম্পর্ক কী হবে, বাক্যের অর্থ কখন কী রকম হয় ইত্যাদি শিক্ষার্থীদের জানাতে হবে, বোঝাতে হবে। এই জানানো-বোঝানোর কাজ সংক্ষেপে, উল্লেখ-ইঙ্গিতের মাধ্যমে সারলে চলবে না। প্রতিটি বিষয় পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-উদাহরণসহ শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। তবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে যথার্থ বাক্যবোধ জন্মাবে, বাক্য থেকে অবাক্য-অপবাক্য পৃথক  করতে পারবে তারা।

পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ চারটি প্রণয়ন ও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছে ভাষাবিদ-ব্যাকরণবিশারদদের চারটি পৃথক দল। লক্ষ্ করলেই দেখা যাবে, দল চারটির ব্যাকরণ বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন নয়। ফলে একই বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য-বর্ণনা বোর্ডের ব্যাকরণগুলিতে স্থান পেয়েছে। এর কিছু দৃষ্টান্ত আমরা দিয়েছি। ভাষাবিদ-ব্যাকরণবিশারদদের একটি অভিন্ন দল ব্যাকরণগুলি প্রণয়ন-সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করলে এরকম সমস্যা হতো না অথবা হলেও পরিমাণে অনেক কম হতো। আমরা তাই মনে করি, বিশেষজ্ঞদের একটি অভিন্ন দলকে বোর্ডের ব্যাকরণগুলি নতুন করে প্রণয়ন ও সম্পাদনার দায়িত্ব দেওয়া দরকার। লেখক-প্রণেতাদের দল ভিন্ন হলেও হয়তো চলে। কিন্তু সম্পাদকমণ্ডলী অভিন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। অন্য ভাষার প্রথাগত ব্যাকরণের অচল-অপ্রয়োজনীয় সূত্রাদির মানদণ্ডে বাংলা ভাষার উপাদান বিশ্লেষণে আগ্রহী নন এমন বিশেষজ্ঞগণই যেন ব্যাকরণগুলির লেখক-সম্পাদক দলে স্থান পান, এটা নিশ্চিত করতে হবে বোর্ডকে।

স্কুলের শিক্ষার্থীদের যে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানো হয় তাকে ‘দুঃস্বপ্নে’র সঙ্গে উপমিত করেছেন ভাষাবিজ্ঞানী প্রবাল দাশগুপ্ত। জানিয়েছেন, এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ‘জেগে ওঠা।’ জেগে ওঠার অর্থ এক্ষেত্রে ‘লাফ মেরে তড়াক করে জেগে ওঠা’ নয় বরং ‘স্বপ্নের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে’ নেওয়া। অধ্যাপক দাশগুপ্তের বিবেচনায়, সেই রাস্তা খোঁজার কাজ করতে ‘ধৈর্য’ লাগবে, ‘পরিশ্রম’ লাগবে, সবচেয়ে বেশি লাগবে ‘সাহস’।(কথার ক্রিয়াকর্ম, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৯৮৭, পৃ. ৪৯)। এখন থেকে সতেরো-আঠারো বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ স্কুল-পাঠ্য বাংলা ব্যাকরণ নামক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটানোর পরিকল্পনা করেছিল। কাজও শুরু করেছিল। কিন্তু প্রাচীনপন্থীদের বাধার মুখে বাদ দিয়েছিল সে কাজ। সাহসে কুলায়নি। (বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন, তুষারকান্তি মহাপাত্র সম্পাদিত ভাষা ভাবনা, অবভাস, কলকাতা, ২০০৫)।

এ প্রসঙ্গ আসছে কেন? এর কারণ হলো, বোর্ডের ব্যাকরণগুলির কোনো কোনো পরিচ্ছেদ দেখে আমাদের মনে হয়েছে যে, ব্যাকরণ নামক দুঃস্বপ্নের কবল থেকে শিক্ষার্থীদের মুক্তি দিতে চায় বোর্ড। উদাহরণ হিসাবে ষষ্ঠ শ্রেণির ব্যাকরণের ধ্বনিতত্ত্ব পরিচ্ছেদের কথা বলা যায়।  এই পরিচ্ছেদে ধ্বনি সম্পর্কিত আলোচনায় প্রথাগত ব্যাকরণের অচলায়তন ভাঙার যে-চেষ্টা লক্ষ্ করা যায় তা কম সাহস ও সাধনার ব্যাপার নয়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ যেখানে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ আমাদের পাঠ্যপুস্ততক বোর্ড সেখানে কিছুটা হলেও সফল। এক্ষেত্রে পুরোপুরি সফল হতে চাইলে বোর্ডকে আরও প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

আট. কথাশেষ

বর্তমান রচনায় আমরা পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলির বিভিন্ন অংশের ওপর আলোকপাত করেছি। এসব অংশে বিদ্যমান সমস্যাসমূহ চিহ্নিত করে সেগুলি দূর করার উপায় নির্দেশের চেষ্টাও করেছি আমরা। এই কাজে সব ক্ষেত্রে সফল হয়েছি এরকম দাবি আমরা করি না। আমরা বরং আশা করি, আমাদের ব্যর্থতা দেখে ভাষাবিদ-ব্যাকরণবিশারদগণ বোর্ডের ব্যাকরণগুলি নিয়ে আরও ব্যাপক ও গভীর আলোচনায় আগ্রহী হবেন এবং তাঁদের আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে বোর্ডের ব্যাকরণগুলির সমস্ত সমস্যা চিহ্নিত হবে, সমাধানের আরও কার্যকর উপায় বেরিয়ে আসবে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণগুলি ত্রুটিমুক্ত হোক, শিক্ষার্থীদের ভাষাশিক্ষার অপরিহার্য উপকরণে পরিণত হোক, এই আমাদের প্রার্থনা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ
 

*পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ: একটি পর্যালোচনা (সূচনা পর্ব)
*পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (দ্বিতীয় পর্ব)
*পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ব্যাকরণ : একটি পর্যালোচনা (তৃতীয় পর্ব)

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়