টার্গেট কেন আগস্ট?
সাজ্জাদ হোসেন চিশতি || রাইজিংবিডি.কম
আগস্ট মাস নাম শুনলেই বুকটা কেঁপে ওঠে। হারানোর সুর বেজে ওঠে মনে। কারণ এই আগস্টে বাংলার আকাশ-বাতাস, প্রকৃতির অশ্রুসিক্ত হওয়ার দিন। আগস্ট মাসে আমরা হারিয়েছি জাতির পিতাকে। দেশ হারিয়েছে তার শ্রেষ্ঠতম সন্তানকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতি হিসেবে আমরা এতটাই অকৃতজ্ঞ, যে নেতার নেতৃত্বে আমরা পরাধীনতার শিকল ভেঙে স্বাধীন হলাম, সেই নেতাকেই হত্যা করলো কিছু কুলাঙ্গার সন্তান। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। বঙ্গবন্ধুর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে এই দেশকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
এখানেই শেষ নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর যখন বাবার অপূরণীয় স্বপ্ন পূরণে হাল ধরেন শেখ হাসিনা তখন তাকেও শেষ করার পরিকল্পনা করে পঁচাত্তরের সেই ঘাতকরা। ২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট শুধু শেখ হাসিনা নয়, চেষ্টা করা হয়েছিল তিনিসহ আওয়ামী লীগের সব শীর্ষ নেতাকে শেষ করে দেওয়ার। উদ্দেশ্য সেই একই, দেশকে পঙ্গু করে ফেলা। দেশকে ধ্বংসস্তূপের পথে ঠেলে দেওয়া। এ দিনও অনেকের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এ দিনও শেখ হাসিনাকে বাঁচিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা।
এখনকার বিপ্লবি ফেসবুক জনতার কজন জানেন, সেই সময়টায় রাস্তায় রাস্তায় প্রকাশ্যে মিছিল হতো, “আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।” কে জানে, সেদিন ঘাতকদের খায়েশ পূরণ হলে, আজ হয়ত বাংলা সত্যিই আফগান হয়ে উঠত!
রাষ্ট্রীয় শীর্ষ ব্যক্তিদের জন্য যেমন কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে, সেদিন শেখ হাসিনাকে শেষ করতে কয়েক স্তরের হত্যা ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল, যেন কোনো ভাবেই বাঁচতে না পারেন। ভয়ানক আর্জেস গ্রেনেড, একটিই যথেষ্ট ধ্বংসযজ্ঞের জন্য। সেই আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছে একটির পর একটি। সেখান থেকেও বেঁচে গেলে গুলি, ব্রাশফায়ার। সবকিছুই চেষ্টা করা হয়েছিল সেদিন।
মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা ট্রাকের পাটাতনে কোনো গ্রেনেড ফাটেনি। একটি ফাটলেও সব শেষ হয়ে যেত। মাহবুবরা জীবন দিয়ে, হানিফ-মায়ারা মানববর্ম বানিয়ে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন সেদিন। তারা নেত্রীকে ঘিরে থাকার সময়ও ৪-৫টি গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। এমনকি তাকে আড়াল করে ট্রাক থেকে নামানোর সময়ও একটি গ্রেনেড ছোঁড়া হয়েছিল ট্রাকে। সেটি ট্রাকের ডালায় পড়ে গড়িয়ে নিচে চলে যায়। যদি সেটি পাটাতনে বিস্ফোরিত হতো, তাহলেই সব শেষ হয়ে যেত।
তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিচালিত পৈশাচিক এ হামলায় সেদিন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী বেগম আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মীসহ অনেক সাধারণ মানুষ।
কে করেছিল এমন হিংস্র আয়োজন? আজ এ কথা সবাই জানে। রাষ্ট্রের সব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনার জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিতে।
এমন একটি ঘৃণিত কাণ্ডের পর খালেদা জিয়া সংসদে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে সভায় গিয়েছিলেন। কতটা নিষ্ঠুর রসিকতা! পরবর্তী সংসদ অধিবেশনে নিজের রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কথা বলতে চেয়েছিলেন অনেকবার। স্পিকার জমিরুদ্দিন চৌধুরী তাকে ফ্লোর দেননি। আরও পরে জজ মিয়া নাটকের কথা তো সবারই জানা।
২১ অগাস্টের ধ্বংসলীলার মাত্র কয়েকমাস আগেই বীর মুক্তিযোদ্ধা, তুমুল জনপ্রিয় নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টারকে প্রকাশ্যে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। ২১ অগাস্টের রক্তের দাগ না শুকাতেই, মাত্র কয়েক মাস পরই শাহ এএমএস কিবরিয়ার মতো একজন গুণী মানুষ, সফল অর্থমন্ত্রী, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দারুণ পরিচিত ও নিপাট ভদ্রলোক হিসেবে সব মহলে গ্রহণযোগ্য একজন মানুষকে বোমা মেরে হত্যা করা হয়। বোমা নয়, আসলে ছিল সেই আর্জেস গ্রেনেডই!
সেই সময়টায় কেড়ে নেওয়া হয়েছে আরও অনেক অনেক নেতাকর্মীর প্রাণ। সবই ছিল এক সূত্রে গাঁথা। আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করা, চিরতরে মুছে দেওয়া, এই দেশকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা। ৭৫-এর কালো রাত, সেই সময় ও পরবর্তীতে জিয়ার ভূমিকা, ১৫ অগাস্ট খালেদা জিয়ার জনামদিন পালন করতে গিয়ে কেক কাটার উৎসব এ দেশের মানুষ মনে রাখবে।
সেদিন শরীরে ঢুকে যাওয়া গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের কারণেই আস্তে আস্তে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যান মেয়র হানিফ। সেদিনের স্প্লিন্টারের ক্ষত এখনও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন কত কত নেতা কর্মী। আর হৃদয়ের ক্ষত? তা তো কখনোই শুকানোর নয়। এ কারণে বিএনপিকে ছাড় দেওয়া কোনো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর পক্ষে আর সম্ভব নয়।
লুটেরারা যেখানে দেশকে শেষ করে দিয়েছিল সেখানে শেখ হাসিনা ক্ষমতার ভার গ্রহণের পর থেকে স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশকে তিনি চিনিয়েছেন পুরো বিশ্বে। আমরা আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি। যে মেগা প্রজেক্টগুলোর স্বপও দেখেনি বিএনপি জামায়াতরা, সেই মেগা প্রজেক্টগুলো আজ বাস্তবে রূপ দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
ঘাতকদের এগুলো সহ্য হচ্ছে না। আগস্ট মাস এলেই যেন তারা তাদের পুরোনো রূপ ফিরে পায়। তাইতো আগস্ট মাসেই ঘাতকরা পরিকল্পনা করে হত্যা আর আগুন সন্ত্রাসের। এই ঘাতকদের চিনে রাখতে হবে। তাদের সন্ত্রাস রুখে দিতে হবে। এই হোক শোকের আগস্টের শক্তি।