ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

‘আমাদের এখন কষ্ট নাই, আমরা স্বাবলম্বী’

আবু কাওছার আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:১৩, ৩ এপ্রিল ২০২১   আপডেট: ১৫:১৮, ৩ এপ্রিল ২০২১
‘আমাদের এখন কষ্ট নাই, আমরা স্বাবলম্বী’

রেড ক্রিসেন্টের ঘর পেয়ে খুশি চরাঞ্চলবাসী

টাঙ্গাইল সদর উপজেলার হুগড়া ইউনিয়নের দুর্গম চরের মধ্য রয়েছে চকগোপাল, পিচুরিয়া, গন্ধর্বপুর ও বারবয়ড়া গ্রাম। গ্রামগুলোর এক দিকে যমুনা নদী অন্যদিকে ধলেশ্বরী। চরের দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের সারাবছর কষ্ট করতে হয়েছে এতদিন। উঁচু বাড়ি ও মজবুত ঘর না থাকায় ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা ও শীতে তাদের অন্যের বাড়িতে থাকতে হয়েছে। 

গ্রামে উঁচু রাস্তা না থাকায় বৃষ্টির দিনে কাঁদা ও শুকনো মৌসুমে বালু মাটি পাড়িয়ে তাদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে হতো। সব মিলিয়ে তাদের কষ্টের সীমা ছিল না। সীমাহীন দুর্ভোগই ছিল তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী। বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি টাঙ্গাইল ইউনিটের সহযোগিতায় তাদের কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘব হচ্ছে। চরাঞ্চলের দরিদ্র ও হতদরিদ্ররা পেয়েছে ঘর, স্বাস্ব্যসম্মত টয়লেট, বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল ও চলাচলের জন্য উঁচু রাস্তা, কালবার্ট ও নগদ টাকা।

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি টাঙ্গাইল ইউনিট সূত্র জানায়, সদর উপজেলা হুগড়া ইউনিয়নের দুর্গম চর চকগোপাল, পিচুরিয়া, গন্ধর্বপুর ও বারবয়ড়া গ্রামে ২০১৯ সালে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ৩২৬টি পরিবারের মধ্যে বন্যা পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে তারা। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (আইএফআরসি) সার্বিক সহযোগিতায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। 

চার গ্রামে নিরাপদ বসত বাড়ির সুবিধা পেয়েছে ১৭৩টি পরিবার, জীবকায়নের সুবিধা পেয়েছে ২৯২টি পরিবার, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন পেয়েছে ২৮৩টি পরিবার। নিরাপদ বসত বাড়ির জন্য প্রতি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে ২৭ পিস ডেউটিন, ৪০ হাজার টাকা, বসতি ভিটার ক্ষয়রোধ করার জন্য ৩০টি বালুর বস্তা, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনের জন্য ১৮ হাজার টাকা ও একটি টিউবওয়েলও দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও জীবিকায়নের জন্য তাকে দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। এ ছাড়াও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের আওতায় মাটির রাস্তা উঁচু করা, ১৪২০ ফুট রাস্তার মেরামতের কাজ ও দুটি কালভার্ট নির্মাণ করা হচ্ছে।

মুরগি পালন করছে চরাঞ্চলের এক নারী

উপকারভোগী আমিনা বেগম বলেন, ‘আগে সারাবছর কষ্ট করতে হয়েছে। বন্যায় সন্তানদের অন্যের বাড়িতে রেখে নিজেরা কলাগাছের ভেলায় থাকছি। নদীর পানি খেয়েছি। ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে অন্যের বাড়িতে গিয়ে উঠেছি। তারা ঘরের দরজা খুলতে খুলতে বৃষ্টিতে ভিজে গেছি। আগে যে অভাব অনটন ছিল, একবার খেয়ে দিন পার করছি। রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় এখন নিশ্চিন্তে বসবাস করছি। আগের চেয়ে ভালো চলছে আমার।’

তিনি আরও বলেন, ‘জীবিকায়নের জন্য আমাকে দেওয়া হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে আমি মুরগির খামার করেছি। এর আগেও একবার মুরগি তুলে বিক্রি করেছি। মুরগির খামার দেওয়ার পর এখন আর কারো কাছে হাত পাততে হয় না। আল্লাহর রহমতে রেডক্রিসেন্টে সহায়তায় এখন স্বাবলম্বী।’

আমিনা বেগমের স্বামী ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আগে আয় রোজগার কম ছিল। বাড়ি-ঘর করতে পারি নাই। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে দিন পার করতে হয়েছে। রেডক্রিসেন্টের সহযোগিতা পাওয়ায় ঝড়-তুফানেও এখন ভালো থাকছি। আমাদের আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে।’

চক গোপাল গ্রামের অপর উপকারভোগী সাবিনা বেগম বলেন, ‘আমার ঘর ভাঙ্গা ছিল। তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে কষ্টে দিন পার করেছি। রেড ক্রিসেন্ট থেকে আমাকে ঘর দিয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের টাকা দিয়ে আমি গরু ও হাস-মুরগি কিনেছি। গরু ও হাস মুরগি থেকে বছর শেষে আমার অনেক টাকা আসবে।’

একই গ্রামের জাহানারা বেগম বলেন, ‘২০ বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছে। তিন মেয়ে নিয়ে কৃষি কাজ করে কোনো রকম সংসার ধরে রেখেছিলাম। রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় আমি ছাগল-ভেড়া কিনেছি। এছাড়াও আমাকে ঘরের টিন ও ল্যাট্রিনের জন্য টাকা দিয়েছে। ছাগল-ভেড়ার টাকায় আমি স্বাবলম্বী হচ্ছি।’

পিচুরিয়া গ্রামের ফুলচান মিয়া বলেন, ‘আমার দোকানে আগে তেমন মালামাল ছিল না। অনেক ক্রেতা এসে ঘুরে যেত। রেড ক্রিসেন্টের সহযোগিতায় আমি দোকানে অনেক মালামাল তুলেছি। এখন আর কোনো ক্রেতা এসে ঘুরে যায় না। আমার অনেক বড় একটা উপকার হয়েছে।’

স্বাবলম্বী হতে ঘরে ছাগল পালন

একই গ্রামের প্রতিবন্দি জয়নম বেগম বলেন, ‘২৫ বছর যাবত আমি ঠিকমতো চলতে পারি না। প্রতিবন্ধী হয়ে ঘরে পড়েছিলাম। ১০ বছর আগে আমার স্বামী মারা যাওয়ায় আমার কষ্ট কয়েক গুণ বেড়ে যায়। ঘর না থাকায় ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে খুব কষ্টে চলতে হয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের আমি ঘর পেয়ে আমার অনেক উপকার হয়েছে।’

হুগড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন খান তোফা বলেন, ‘রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি আমার ইউনিয়নে চার গ্রামে অসহায় মানুষের মাঝে পর্যাপ্ত পরিমাণ সহযোগিতা দিয়েছে। চার গ্রামের মানুষের মাঝে ঘর, জীবিকায়নের জন্য টাকা, টিউবওয়েল, পায়খানা, উঁচু রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণ করে দিয়েছে। ফলে তাদের কষ্ট দূর হচ্ছে। আমার ইউনিয়নের অন্যান্য গ্রামেও এরকম অসহায় মানুষ রয়েছে। তাদেরও সহযোগিতা করা প্রয়োজন।’ 

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি টাঙ্গাইল ইউনিটের ইউনিট লেভেল অফিসার এ টি এম জিয়াউল আহসান বলেন, ‘২০১৯ সালের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বন্যায় যে সমস্ত এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই এলাকায় রেড ক্রিসেন্টের উদ্যোগে বিশুদ্ধ পানি, শুকনো খাবার ও অন্যান্য সহযোগিতা তাৎক্ষণিক পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর কোনো প্রকল্প আসলে টাঙ্গাইলের অন্য এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের সুবিধা দেওয়া হবে।’

এবার খাবার পানির অভাব ঘুচবে তাদের

বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি টাঙ্গাইল ইউনিটের সেক্রেটারী এম এ রৌফ বলেন, ‘যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর ভাঙনে যারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও যারা অসচ্ছল তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে এই প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে কোনো প্রকল্প আসলে এরকম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ও অসচ্ছল মানুষের অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সহযোগিতা করা হবে। চলমান প্রকল্পের আওতায় উপকারভোগীদের ঘর, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিন, টিউবওয়েলের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে অনেকেই মুরগির খামার, কেউ গরু, কেউ ছাগল, ভেড়া ও হাস মুরগি পালন করে সচ্ছল হচ্ছেন।’

টাঙ্গাইল/মাহি 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়