ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

রমজানে ব্যস্ত লক্ষ্মীপুরের মুড়ি পল্লী  

জাহাঙ্গীর লিটন, লক্ষ্মীপুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৪, ১৩ এপ্রিল ২০২২  
রমজানে ব্যস্ত লক্ষ্মীপুরের মুড়ি পল্লী  

গিগজ ধানের মোটা মুড়ি; লক্ষ্মীপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী দেশীয় প্রাচীন খাবার। আবার রমজানে দিনভর রোজা রেখে সন্ধ্যায় ইফতারিতে অন্যতম অনুষঙ্গ মুড়ি। আজকাল যদিও কারখানায় তৈরি হয় মুড়ি, তবে স্বাদে ও মানে সেরা হাতে ভাজা মুড়ি। এ মুড়ির কদর গ্রামেগঞ্জ ও শহরে। বাজারে তাই ব্যাপক চাহিদা থাকে। কিন্তু গত বছর করোনাকালীন সময় অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা চাহিদা কম ছিল। তবে এবার অনেকটাই ব্যস্ত সময় পার করছেন লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের মুড়ি পল্লী খ্যাত সমসেরাবাদ গ্রামের প্রায় ১৫টি পরিবার। 

এছাড়া লক্ষ্মীপুরের ৫টি উপজেলার মধ্যে কমলনগরের হিন্দু অধ্যুষিত করুণানগর এলাকা মুড়ি তৈরির অনন্যা স্থান হিসাবে সারা দেশে পরিচিত। অর্ধ শতাব্দীকালেরও অধিক সময় ধরে মুড়ি ভেজে জীবনধারণ করে আসছে উপজেলার হাজিরহাট ও পাটারিরহাট ইউনিয়নের দক্ষিণ গ্রামে প্রায় ৯০ পরিবার, উত্তর গ্রামে ২০ পরিবার এবং মাইজগ্রামে প্রায় ৪০ পরিবার। এসব এলাকাগুলো মুড়ির পল্লী নামেও পরিচিত।

সরেজমিনে দেখা যায়, গৃহবধূরা তাদের রান্নাঘরে একটি চুলায় চাল ভাজেন। অন্য চুলায় গরম করেন বালু। এরপর একটা পাত্রে গরম বালু ও চাল ঢেলে দেন। এরপর নাড়তে থাকেন। আর তখন চাল ফুটে মুড়ি হয়। পরে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা এ মুড়ি চালনির ওপর রেখে ঘোরাতে থাকেন। তখন বালু নিচে পড়ে যায়। আর মুড়ি থাকে চালনিতে। পরিষ্কার মুড়ি তারা বস্তায় ভরেন। এভাবে ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে মুড়ি ভাজা ও প্যাকেট করার কাজ। এরপর মুড়ির বস্তা সরবরাহের পালা। বস্তা পাঠিয়ে দেয়া হয় পাইকারদের কাছে।

জানা যায়, উপক‚লীয় জেলা লক্ষ্মীপুরের চরাঞ্চলে উৎপন্ন বিশেষ জাতের ‘গিগজ’ ধানের মুড়ি স্বাদ বৈশিষ্ট্যের জন্য দেশ বিদেশে বিখ্যাত। দেশীয় পদ্ধতিতে ভাজা এ মুড়ির রং খুব হালকা গোলাপী আভা, দেখতে সুন্দর, খেতে মচমচে এবং সুস্বাদু। সব চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এ মুড়ি তৈরিতে পরিমিত লবণ ছাড়া অন্যকোন কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় না।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক মুড়ি ব্যবসায়ী জানান, বেশির ভাগ মেশিনে ভাজা মুড়িতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক মেশানো হয়। হাতে ভাজা মুড়িতে খরচ একটু বেশি, তাই দামও একটু বেশি পড়ে। রোজা এলে চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মুড়ির গ্রামগুলোকে বাণিজ্যিক মুড়ি উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দাবি জানিয়ে আসছে মুড়িপল্লির শ্রমিকরা।

লক্ষ্মীপুর সমসেরাবাদ গ্রামের রিপেল চন্দ্র দাস জানান, তাদের বাড়ির জগু দাস, মিন্টু দাস সহ ৭/৮ পরিবার বাপ-দাদার আমল থেকে মুড়ি ভাজা কাজের সাথে জড়িত। বর্তমানে ধানের দাম বেশি হওয়ায় মণ প্রতি তাদের লাভ থাকে ৪-৫’শ টাকা। তাদের ভাজা মুড়ি ঢাকা-চট্রগ্রামসহ সারাদেশে রপ্তানি হয়। তবে সরকারি অনুদান না পাওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

কমলনগর উপজেলার পাটওয়ারীর হাট এলাকার বেচারাম দাস জানান, তাদের গ্রামে অন্তত ৯০টি পরিবার বাণিজ্যিকভাবে হাতে মুড়ি ভাজার কাজে যুক্ত। প্রতিটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ২ হাজার ৭০০ কেজি মুড়ি ভাজে। প্রতি কেজি মুড়ি পাইকারের কাছে বিক্রি হয় ১২০ টাকায়। এতে কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা লাভ হয়। বাজারে হাতে ভাজা এক কেজি মুড়ি বিক্রি হয় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়। তবে এ বছর করোনা থাকায় চাহিদা কিছুটা কম রয়েছে বলে জানান তিনি। 

লক্ষ্মীপুর শহরের মুড়ি বিক্রেতা রাজেন্দ্র বনিক, লক্ষণ বনিক, কৃষ্ণ বনিক বলেন, বিগত ১৫-৩০ বছর ধরে আমরা মিলে তৈরি ও হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রি করি। তবে ক্রেতারা সবচেয়ে বেশি চান হাতে ভাজা মুড়ি। ক্রেতাদের কথা চিন্তা করে সমসেরাবাদ বা কমলনগর উপজেলা থেকে হাতে ভাজা মুড়ি আনতে হয়।

লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্পনগরীর ডিএমডি ইসমাইল হোসেন বলেন, মুড়ি ভাজাও একটা শিল্প। এ শিল্পকে ধরে রাখার জন্য আমরা ক্ষুদ্র ঋণ দিচ্ছি। এ ছাড়া, যাদের মিল-কারাখানা রয়েছে তাদেরকে বরাদ্ধ দেওয়া হয়। বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় ৪টি মুড়ি কারখানা ছিল, এর মধ্যে অলাভজনক হওয়ায় ৩টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে তালিকাভুক্ত ১টি কারখানা সরকারি প্রণোদনা পেয়েছে। এ জেলায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় দক্ষ কারিগর তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

/মাহি/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়