ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ড্রাগন চাষী বাপ্পি এখন বেকার যুবকদের অনুপ্রেরণা

রফিক সরকার, কালীগঞ্জ (গাজীপুর) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১১, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২   আপডেট: ১২:১৬, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২২
ড্রাগন চাষী বাপ্পি এখন বেকার যুবকদের অনুপ্রেরণা

নিজ বাগানে মির্জা বায়েজিদ আলম বাপ্পি

মির্জা বায়েজিদ আলম বাপ্পি (৩০)। গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা বাজার এলাকার আলহাজ মো. মমতাজ উদ্দিনের ছেলে। ২০১৬ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রেজুয়েশন শেষ করে বেকারত্ব ঘোচাতে কৃষিকেই পেশা হিসেবে নেন এই যুবক। বর্তমানে তার বাড়ির ছাদ ও সাড়ে ৩ বিঘা মাঠে প্রায় ১০ হাজারের মত ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে। যা থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন তিনি।  

২০১৬ সালে বিভিন্ন জাতের ফল ও সবজি দিয়ে ছাদ বাগান শুরু করেন বাপ্পি। ২০১৮ সালে ৪৩ শতাংশ জমিতে প্রথমবারের মতো ১০টি ড্রাগন ফলের চারা রোপণ করেন। এখন তার বাড়ির ৪ হাজার ৫০০ স্কয়ার ফিট ছাদে ও সাড়ে ৩ বিঘা মাঠে প্রায় ১০ হাজারের মত ড্রাগন ফলের গাছ রয়েছে। ছাদে তেলের খালি বেড়েলের মাঝখানে কেটে তাতে ১ হাজার ড্রাগন ফলের গাছ লাগিয়েছেন এই যুবক।

বাপ্পির রোপণ করা ড্রাগন গাছে ফুল ধরেছে

২০১৩ সালে প্রথমবার ভারতে বড়াতে যান বাপ্পি। সেখানেই তিনি ড্রাগন ফলের স্বাদ গ্রহণ করেন। ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সিঙ্গাপুর বেড়াতে গিয়ে ড্রাগন ফলের স্বাদ গ্রহণ করেন আবারো। আর এতেই তিনি ড্রাগন ফল চাষে অনুপ্রেরণা পান।

সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরে খুলনা, বাগেরহাট চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, নাটোর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ শেরপুর, জামালপুর ও কুমিল্লার ড্রাগন বাগান ঘুরে দেখেন বাপ্পি। সে সময় তিনি চাষীদের সঙ্গে কথা বলে ড্রাগন চাষের অভিজ্ঞাতা সঞ্চার করেন। পরে ২০১৮ সালে শুরু করেন ড্রাগন চাষ। গত বছর ছাদ বাগানে ড্রাগনের চারা ও ফল থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা আয় করেছেন বাপ্পি। তবে এ বছর ৩ লাখ টাকা আয় হবে বলে আশা করছেন তিনি।

দেশের বাহিরে চায়না, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডে ও মেক্সিকো এবং তুরস্ক থেকেও ড্রাগনের চারা সংগ্রহ করেছেন বাপ্পি। আর একাজে তাকে তার বাবা মমতাজ উদ্দিন, মা বিউটি মমতাজ, স্ত্রী সামিয়া, বোন মুনিয়াসহ পরিবারের সবাই সহযোগিতা করেছেন।

হলুদ রঙের ড্রাগন ফল

বাপ্পির কাছ থেকে ড্রাগন ফলের চারা নিয়ে বাগান করেছেন জেলার শ্রীপুর উপজেলার ডা. নাঈম খান, মো. মমিন ঢালী, আল হক দেওয়ান, রাজীব খান ও কাপাসিয়া উপজেলার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সরকার আব্দুল মজিদ। এছাড়াও তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকার কমপক্ষে দেড় থেকে ২ হাজার ছোট বড় শখের বাগানিকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ড্রাগন ফলের চারা সরবাহ করেছেন। তারা সবাই বাড়ির ছাদে, মাঠে ও বাড়ির আঙ্গিনায় ড্রাগন বাগান করেছেন।

বাপ্পির ছাদ বাগানে শুধু ড্রাগন ফল গাছই নয় সঙ্গে রয়েছে চেরি, আম, থাই ছফেদা, দেশি ছফেদা, লেমনগ্রাস, এলাচ, কমলা, মালটা, প্রিকলিপেয়ার, মালবেরি, আতাফল, ব্লেকবেরি, আলুবোখরা, এলোভেরারসহ বিভিন্ন ধরনের গাছ। আর এসব গাছ নিজেই পরিচর্যা করেন বাপ্পি। তিনি অর্গানিকভাবে জৈব সার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ড্রাগন ফলের চাষ করছেন। 

বাপ্পির বাগানে উৎপাদিত ড্রাগন ফল

বাপ্পির দাবি, তার ছাদ বাগানের ড্রাগন ফল বাজারে বিক্রি হওয়া ড্রাগন ফলের চেয়ে অনেক পরিপক্ক ও বহুগুণে সুস্বাদু। তার প্রতিটি ফলের ওজন ৩০০ গ্রাম হয়। এছাড়া ১০০০ গ্রাম ও সর্বনিম্ন ২০০ গ্রাম ওজনের ড্রাগন ফলও হয়েছে তার ছাদ বাগানে। মে মাস থেকে ডিসেম্বর মাস ড্রাগন ফল কাটার উপযুক্ত সময়। তবে কেউ উদ্যোক্তা হতে হলে তার স্বপ্ন পূরণের পথে প্রত্যেকটি দিন প্রত্যাশার বলে মনে করেন তিনি।

বাপ্পি বলেন, ‘আমরা বাড়ির ছাদ কাপড় শুকানো ও অবকাশ যাপনের জন্য ব্যবহার করি। কিন্তু আমি একটু ভিন্নভাবে চেষ্টা করেছি ছাদটাকে ব্যবহার করে কৃষির আওতায় আনতে। ছাদ থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের অবকাঠামো উন্নয়ন করে কৃষি ফসল উৎপাদন করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে নিজেকে সাবলম্বী করে তুলতে। আমার সংগ্রহে ২৩টি ভিন্ন জাতের ড্রাগন ফলের প্রজাতি রয়েছে। তবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদের জন্য আমি চারটি জাত উপযোগী মনে করে বাগান সম্প্রসারণ করেছি। আর সেগুলো হলো- ভিয়েতনাম হাইব্রিড জাতের লাল,  বারি-৩, বারি -১ ও  হাইব্রিড জাতের পিংক।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আমার এই সফলতার গল্পটি ফেসবুকে  মির্জা বায়েজিদ বাপ্পি তাজ নামে ব্যক্তিগত আইডি, বাপ্পি তাজ অ্যাগ্রো (Bappy Taz Agro) নামের একটি পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল এবং আধুনিক ড্রাগন ফলের চাষ সম্প্রসারণ ও নার্সারি নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে নিয়মিত শেয়ার করছি। এই গ্রুপগুলোতে অনেক মেম্বার, সদস্য, বন্ধু সাব্সক্রাইবার রয়েছে। তারা পেইজ, ইউটিউব, গ্রুপ এমনকি আমার ব্যক্তিগত আইডিতে আমার কাছে ছাদে ড্রাগন চাষের পরামর্শ চান। বড় বড় চাষিরাও আমার সফলতায় অবাক হয়েছেন। তারাও জানতে চেয়েছেন ছাদ ড্রাগন বাগান সম্পর্কে।’

বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত বাপ্পি

বাপ্পি বলেন, ‘আমার ড্রাগন বাগানের গাছগুলো সব স্বপরাগায়ন জাতের। তাই হাতে পরাগায়ন করতে হয় না। তাছাড়া বাগানে প্রচুর মৌমাছি রয়েছে। ক্রসপরাগায়নের কাজটা মৌমাছিই করে।’

শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের বারতোপা গ্রামের বেকার যুবক মো. মমিন ঢালী বলেন, ‘আমি ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স মাস্টার্স শেষ করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করি। এরপর বেকারত্ব কাটাতে কৃষির উপর জোর দেই। নানা ধরেনর সবজি বাগান দিয়ে শুরু করলেও বাপ্পি ভাইয়ের ছাদ ও মাঠে ড্রাগন চাষ দেখে ১০০ চারা নিয়ে আমি অন্য সজবির সঙ্গে ড্রাগন চাষও শুরু করি।’   

জেলার কাপাসিয়া উপজেলার বারিষাব ইউনিয়নের গিয়াসপুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা সরকার আব্দুল মজিদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন গাজীপুর জেলা কোর্টে কাজ করেছি। এখন অবসর সময় কাটাচ্ছি। তাই বাপ্পির কাছ থেকে এক হাজার ড্রাগন চারা এনে চাষ শুরু করেছি। কয়েক মাস হয় শুরু করেছি। আগামী বছর ফলন পাবো বলে আশা করছি।’ 

শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এসএম মহিদুল বলেন, ‘মাটি কম-বেশি হওয়ায় কিংবা বড় ড্রামে গাছ লাগানোতে ড্রাগন চাষে সফলতা আসে না। সফলতা আসে ড্রাগন গাছ সঠিকভাবে পরিচর্যার কারণে। বাপ্পি সঠিকভাবে গাছ পরিচর্যার কারণেই ছাদ ও মাঠে ড্রাগন ফল চাষে সফলতা পেয়েছেন।’

গাজীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি গাজীপুরে নতুন যোগদান করেছি। তবে শ্রীপুর উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের মাধ্যমে জানতে পেরেছি ওই উপজেলার মাওনা বাজার এলাকায় বাপ্পি নামে এক যুবক কৃষিকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। এই যুবককে দেখে অন্য বেকার যুবকরাও কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে অনুপ্রেরণা পাচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘ড্রাগন গাছে ফুল ফোটার সময় পানি কম দিতে হবে। বেশি পানি হলে ফুল ঝরে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ডাল গুলো ঝুলানোর ব্যবস্থা যত বেশি করা যাবে ততই ফুল হবে এবং ও ফল ভালো হবে। বাংলাদেশে ড্রাগন চাষ বেশ আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তবে ছাদে ড্রাগনের চাষ আমাদের দেশের কৃষিতে অন্যমাত্র যোগ করেছে। এতে করে অল্প জায়গায় সঠিক নিয়ম ও পরিচর্যার মাধ্যমে যে কারো জন্য ড্রাগন চাষ করা সহজ হয়েছে। দেশে বর্তমানে ড্রাগন চাষ একটি সম্ভাবনাময় কৃষিপণ্য। প্রয়োজনে এই ফল চাষে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরণের সহযোগীতা করা হবে।’ 

মাসুদ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়