ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

এখনও স্পষ্ট ধ্বংসের চিহ্ন 

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৩, ২০ মে ২০২১   আপডেট: ১২:৩৬, ২০ মে ২০২১
এখনও স্পষ্ট ধ্বংসের চিহ্ন 

আম্ফান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বহু চিংড়ি চাষি এখন নৌকার মাঝি

এক বছর পরেও সবখানে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ধ্বংস চিহ্ন দৃশ্যমান। কৃষি জমি কিংবা চিংড়ির খামার ফাঁকা। গ্রামগুলো ভেঙে টুকরো হয়ে গেছে। রাস্তা, পুকুর, বাড়ি চলে গেছে নদীর পেটে। বহু মানুষ এখনও ঘরে ফিরতে পারেন নি। অনেক পরিবার এখনও বেড়িবাঁধের উপরে বসবাস করছেন। ঘূর্ণিঝড় কবলিত এলাকাগুলোর অনেক স্থানে এবারও কৃষি আবাদ হবে না। লবণ পানিতে মরে গেছে গ্রামের গাছপালা। বড় ব্যবসায়ী, কৃষক অথবা চিংড়ি খামারের মালিকও এখন দিনমজুর। কেউ নৌকা চালিয়ে, কেউ ভ্যান চালিয়ে, কেউ গ্রামে গ্রামে মালামাল ফেরি করে সংসার চালাচ্ছেন। এনজিও কিংবা মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকে। ঋণের বোঝা বাড়ছে। এলাকায় কাজ না থাকায় অনেকে চলে গেছেন শহরে।

২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাত করে বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলে। এতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রভাব পড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের ওপর। এর মধ্যে তিন লাখ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ ভেঙে বহু স্থানে পানি প্রবেশ করে। সেই পানিতে অনেক এলাকা ডুবে ছিল প্রায় এক বছর। মাত্র দুই মাস আগে ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামত করা হলেও এখনও ঝুঁকি রয়ে গেছে অনেক স্থানে।

এই ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকেই অনেকে নতুন জীবন গড়ার চেষ্টা করছেন। এদেরই একজন খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি গ্রামের সঞ্জিত সরকার (৩২)। সঞ্জিত বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের আগে ভালোই ছিলাম। সংসারে ছিল না অনটন। স্থানীয় বাজারে একটি দোকান থেকে যা উপার্জন হতো, তা দিয়ে চলে যেত সংসার। ঘূর্ণিঝড়ের পরে প্রায় দশ মাস বেড়িবাঁধের উপরে বাস করেছি। এখন বাড়ি সংস্কারের চেষ্টা করছি। এক বছরে ঋণী হয়েছি প্রায় ৫০ হাজার টাকা।’ সঞ্জিত সরকারের এখন কোনো উপার্জন নেই বললেই চলে। তিনি ঋণের টাকা কীভাবে পরিশোধ করবেন জানেন না।

আম্ফানের এক বছর পরেও বহু মানুষ বেড়িবাঁধে বাস করছে। খুলনার কয়রা উপজেলার হাজতখালী গ্রামের বেড়িবাঁধের উপর থেকে তোলা ছবি

একই উপজেলার কাটমারচর গ্রামের মিজানুর রহমান (৪০) চিংড়ি চাষি। পাঁচ বিঘা জমিতে চিংড়ি চাষ করতেন। চিংড়ির খামারের উপর্জন থেকে ভালোই চলতো সংসার। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় আম্ফান তার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। এখন কিছুই নাই। এক বছরে দেনা হয়েছেন প্রায় এক লাখ টাকা। তবুও এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে জীবন। মিজানুর রহমানের মতোই এলাকার অনেক মানুষের গল্প প্রায় একই রকম।

জীবনের বোঝা বাড়িয়ে দেয় ঘূর্ণিঝড়

কার্তিক চন্দ্র মন্ডল (৩৮)। বেড়িবাঁধের উপরে পাতার বেড়া, খড়ের চালা, ছোট্ট একটি ঘরে পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বাস করেন। কিন্তু এক বছর আগেও তিনি বাস করতেন পাকা দালানে। কার্তিক চন্দ্র মন্ডলের কাছে এই বাড়িটি ছিল অনেক কষ্টের অর্জন। কিন্তু বাড়িটি ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

গল্পটা বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের হাজতখালী গ্রামের। সেদিন রাতে শক্তিশালী জোয়ারের চাপে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে। জোয়ারের পানি হাজতখালী গ্রামের তীর ভেঙে নিয়ে যায়। কার্তিক চন্দ্র মন্ডল এবং গ্রামের আরও অনেক পরিবারের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই রাতে বেড়িবাঁধে উঠে আসেন। বেড়িবাঁধের উপরে দাঁড়িয়ে তারা লোনা পানিতে তলিয়ে যেতে দেখেন তাদের ঘর-বাড়িগুলো। সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার কুড়িকাহুনিয়া, শ্রীপুর, সনাতনকাঠি, প্রতাপনগর, একই জেলার শ্যামনগর উপজেলার বন্যতলা, গাবুরায় একই ছবি চোখে পড়ে। এক বছর ধরে জীবন জীবিকার প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা চরম সংকট মোকাবিলা করছেন।

ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মুখ। এক সময় সাজানো বাড়ি ছিল। এখন বেড়িবাঁধের উপরে দিন কাটে আতঙ্কে

এ তো গেল শুধু আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খণ্ডচিত্র। প্রকৃত ছবি দেখতে হলে যেতে হবে খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলার কালাবগি গ্রামে। সেখানকার মানুষদের বাড়িগুলো পরিণত হয়েছে ঝুলন্ত বাড়িতে। তাদের গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে গেছে শিবসা নদী। তারা এখন নিঃস্ব। কার্তিক চন্দ্র মন্ডল এক বছর ধরে বেড়িবাঁধে বাস করছেন। কিন্তু কালাবগি ঝুলন্ত গ্রামের মানুষগুলো পানির সাথে বসবাস করছেন প্রায় ১২ বছর। তারা ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার শিকার।

বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে

শুধু আশাশুনি উপজেলা নয়, আম্ফানের আঘাতে বাংলাদেশের পশ্চিম উপকূলের পাঁচটি উপজেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, শ্যামনগর এবং খুলনা জেলার কয়রা, দাকোপ এবং পাইকগাছা। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সূত্র বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মধ্যে প্রায় তিন লক্ষাধিক মানুষ এখনও ঘরে ফিরতে পারেনি। ক্ষতিগ্রস্ত বহু পরিবার অন্যত্র চলে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত দশটি ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বহু পরিবার পাশের উপজেলায়, জেলা সদরে এবং বিভাগীয় সদরে চলে গেছেন। তারা পেশাও বদল করেছেন বাধ্য হয়েই। উল্লেখিত ৩ উপজেলার একটি বড় অংশের বেড়িবাঁধ আম্ফানে ভাসিয়ে নিয়েছে। ফলে ওইসব এলাকা দিনে দুইবার জোয়ারের পানিতে ডুবে যায়। কিছু মানুষ ডুবন্ত বাড়িতে পাটাতনের ওপরে বাস করেন। কিছু মানুষ সরকারি জমিতে, বেড়িবাঁধে, সড়কের উপরে এবং অন্যের জমিতে ঘর বানিয়ে বাস করছেন। অনেক পরিবার সাইক্লোন শেলটারে এবং স্কুল ভবনে আছেন প্রায় ছয় মাস।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সূত্রগুলো বলেছে, ক্ষতিগ্রস্ত দশটি ইউনিয়ন থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এদের বড় একটি অংশ কখনোই বাড়ি ফিরতে পারবে না। কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান বলেন, আইলার পর এই এলাকার দুই হাজারেরও বেশি মানুষ অন্যত্র চলে যায়। আম্ফানের পরেও অনেক মানুষ চলে গেছে। এদের একটি অংশ আর কখনোই ফিরে আসতে পারবে না এবং আসেও না।

সব হারিয়ে নিঃস্ব মানুষগুলোর এখন ভরসার কোনো জায়গা নেই। অনিশ্চিত জীবন কাটাচ্ছেন তারা

জেনেভা-ভিত্তিক ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার বা আইডিএমসি বাস্তুচ্যুতির বিষয়টি ‘ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট’ হিসাবে আখ্যায়িত করে। আইডিএমসি ২০২০ সালের হাফ ইয়ারলি প্রতিবেদনে বলেছে, এই ছয় মাসে বাংলাদেশে স্থানচ্যুত হয়েছে ২৫ লক্ষাধিক মানুষ। এর একটি বড় অংশ ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে স্থানচ্যুত। অথচ ২০১৯ সালে সারা বছরে বাংলাদেশে স্থানচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪০ লাখ।

আইডিএমসি’র ডিরেক্টর অ্যাকেজান্ড্রা বালিক বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশে দুর্যোগে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। বিভিন্ন বছরে এই সংখ্যায় পার্থক্য আছে। তবে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান এই সংখ্যাটা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। 
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়