ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ফুল ফুটবে, সে জীবন আর ফিরবে না

সাইফুল আহমেদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৩০, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফুল ফুটবে, সে জীবন আর ফিরবে না

সাইফুল আহমেদ

সাইফুল আহমেদ :

 

ঘটনা-১ : একটি সুসজ্জিত গোছানো সুন্দর বাগান। সেখানে নানা ফুল ফোটে, পাখি আসে, গান গায়। মৌমাছিরা গুনগুনিয়ে গায় আর এ ফুলের কথা ও ফুলের কানে কয়। প্রজাপতিরা তাদের রং-বেরংয়ের ডানা ঝাপটিয়ে ফুলের আশপাশে উড়ে বেড়ায়। সেই বাগানে দল বেঁধে আসত পাশের গ্রামের আট/দশজন শিশু। তারা বাগানে খেলত, ছোটাছুটি করত, মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে পূর্ণপ্রস্ফুটিত ফুল ছিঁড়ে নিয়ে যেত। তবে কখনোই গাছের কোনো ক্ষতি করত না।

 

সেই বাগানটি ছিল এক দৈত্যের। শিশুদের এমন না জানিয়ে দলবেঁধে বাগানে প্রবেশ তার সহ্য হতো না। সে মনে করত, শিশুরা বাগানের ক্ষতি করছে। বাগানে শিশুদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ তার কাছে বিষের মতো মনে হলো। তাই একদিন সে সেই বাগান থেকে শিশুদের তাড়িয়ে দিল। এমনকি তাদের বা-মায়ের কাছে গিয়ে হুমকি দিয়ে আসল, ফের শিশুরা বাগানে গেলে তাদের হত্যা করা হবে! ওই ঘটনার পর ভীত, সন্ত্রস্ত্র শিশুরা দৈত্যের বাগানে যাওয়া বন্ধ করে দিল।

 

কিছু দিন পেরিয়ে গেল। একদিন ওই দৈত্য বাগানে এসে দেখল, ফুলেরা সব ঝরে পড়েছে। বাগানে কোনো পাখি নেই। নেই মৌমাছি, প্রজাপতি কেউই। সে ভাবল, হয়ত কিছু দিন পরই ফের ফুল ফুটবে। তবে দিন যায়, মাস যায়, ফুল আর ফোটে না। পাখিরা তাদের সুরেলা কণ্ঠে গান গাইতে আসে না। বর্ণালী প্রজাপতি কিংবা মৌমাছিরও দেখা নেই। ফুল গাছও মরে যাচ্ছে। দৈত্যের সাজানো বাগান আবর্জনার স্তূপে পরিণত হওয়ার উপক্রম।

 

কী কারণে এমন হলো, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না দৈত্যটি। অবশেষে তার মনে হলো, বাগান থেকে শিশুদের তাড়িয়ে দেওয়ার কারণেই হয়ত ফুলেদের মন খারাপ হয়েছে। পাখি, প্রজাপতি, মৌমাছিরাও একই কারণে বাগানে আসছে না। দৈত্য তার ভুল বুঝতে পেরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সে বুঝতে পারল, ভালবাসা, মমতা কেবল কারো জন্য সীমাবদ্ধ রাখলে হয় না, তা ছড়িয়ে দিতে হয় সবার জন্য। আর সৃষ্টির সেরা জীব মানবশিশু ফুলের মতোই নিষ্পাপ। তাদের আঘাত করে ফুলের মন জয় করা সম্ভব নয়। তাই সে নিজে গিয়ে ওই শিশুদের বাগানে ফিরিয়ে আনল আর বলল, ‘এখন থেকে এই বাগান তোমাদের জন্য উন্মুক্ত। তোমরা যখন খুশি তখন এখানে আসবে, খেলাধুলা করবে।’ দৈত্যের এই ঘোষণায় শিশুরা আনন্দিত হয়ে আবার সেই বাগানে খেলা শুরু করল। আর শিশুদের পেয়ে বাগানে ফুলেরাও ফের ফুটে উঠল, পাখি এসে গাইতে লাগল, প্রজাপতি-মৌমাছিরাও গুনগুনিয়ে বাগানে ঘুরতে আসল।

 

দৈত্য বুঝল, শিশু, ফুল, পাখি, প্রজাপতি-মৌমাছি এই নিয়েই তো স্বর্গরাজ্য। শিশুকে, মানুষকে বাদ দিয়ে কোনো ফুলই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়।

 

ঘটনা-২ : গ্রাম থেকে শহরের দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। গ্রামের কোথাও ফুলের দোকান নেই। রাত পোহালেই ২১শে ফেব্রুয়ারি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলার শিবগঞ্জ মালিগাও এলাকার ভগদগাজি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী আঁখিসহ চার বান্ধবী শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফুলের দোকান না থাকায় পাশের বাড়ির একটি বাগানে ফুল তুলতে যায় শহীদ মিনারে দেওয়ার জন্য।

 

ওই বাগানের মালিক নাসিরুল ইসলামের স্ত্রী দেখে ফেলেন ফুল তুলতে। খুব রাগারাগি করেন আঁখিসহ চার বান্ধবীর সঙ্গে। বকা খেয়ে তারা চলে যায় সেখান থেকে। কিছুক্ষণ পর বাগান মালিক নাসিরুল আঁখির বাসায় গিয়ে আরো গালিগালাজ শুরু করেন। গালাগাল শেষে তিনি চলে যাওয়ার পর অভিমানে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে শিশু আঁখি। সবাইকে ছেড়ে চলে যায় না ফেরার দেশে। আর কোনো দিন শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া হবে না তার।

 

আঁখি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শিবগঞ্জ মালিগাও এলাকার কাবুলের মেয়ে।  পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, বাগান মালিক নাসিরুল গালিগালাজ করে চলে যাওয়ার পর আঁখি গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। পরিবারের লোকজন আঁখির ঘরে ঢুকতে চাইলে সারা না পেয়ে দরজা ভেঙে তার ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। পরে স্থানীয় লোকজন ঠাকুরগাঁও সদর থানা পুলিশকে খবর দিলে আঁখির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে।

 

প্রথম ঘটনাটি একটি গল্পের। দ্বিতীয়টি বাস্তব। প্রথম ঘটনায় দৈত্যটি বিতাড়িত শিশুদের তার বাগানে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল। দ্বিতীয় ঘটনায় বাগান মালিক নাসিরুল ইসলাম কিংবা তার স্ত্রী আর কোনো দিনই শিশু আঁখিকে তাদের বাগানে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কারণ আঁখি রাগে, অভিমানে, লজ্জায় চলে গেছে না ফেরার দেশে।

 

আঁখির বাবা কাবুল আক্ষেপ করে বলেন, ‘মেয়েটি তো শুধু কয়েকটি ফুলই তুলেছিল। তার জন্য এত গালিগালাজ! সে কারণেই আঁখি আমাদের মাঝ থেকে চিরতরে চলে গেল।’

 

গল্পে বাগানের মালিক একটি দৈত্য। তবে তার মধ্যেও আমরা মানবিক গুণাবলি ‘মনুষ্যত্ব’ দেখতে পাই। যখন সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে শিশুদের জন্য কান্না করে, তাদেরকে শুধু বাগানেই নয়, স্থান দেয় নিজের হৃদয়েও। তবে দ্বিতীয় ঘটনায় আমরা এর ব্যতিক্রম দেখতে পাই। আঁখির মৃত্যুতে বাগানের মালিক নাসিরুল ইসলামের যেন কোনো অনুভূতিই নেই। মনে হয়, তার কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে ফুল, বাগান এগুলোর মূল্য বেশি। তাইতো নির্বোধের মতো বলতে পারেন, ‘একটি বাগান করতে অনেক খরচ লাগে। মেয়েগুলো আমাদেরকে না জানিয়ে ফুল তুলেছে। তাই বকাবকি করেছি মাত্র। এতটুকু কারণে আঁখি আত্মহত্যা করতে পারে না।’

 

নাসিরুল ইসলাম কি মানুষ নাকি দৈত্য? তিনি কি দৈত্যের চেয়েও অধম নন। দৈত্য কি সত্যিই নরকে বাস করে? আমাদের মাঝেই কি দৈত্য নেই? আধুনিক যান্ত্রিক জীবন আমাদের মনুষ্যত্ব কেড়ে নিচ্ছে। আমরা একেকজন দৈত্যে পরিণত হচ্ছি। তাইতো আমাদের হৃদয়ে ফুলের মতো নিষ্পাপ শিশুদের জন্য কোনো মায়া-মমতা নেই। অথচ বাগানের ফুলের জন্য আমরা কোনো শিশুকে এতটাই অপদস্ত, অপমান কিংবা মানসিক যন্ত্রণা দিতে ছাড়ি না, যা তাদেরকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত করে।

 

আমরা সবাই জানি, বয়ঃসন্ধিকালে শিশুরা কেমন আবেগপ্রবণ থাকে। এই সময়ে তারা খুবই ‘নাজুক’ প্রকৃতির হয়ে থাকে এবং তাই তাদের সঙ্গে বুঝেশুনে আচরণ করতে হয়। বাগান মালিক নাসিরুল ইসলাম একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি হওয়ায় এ ব্যাপারটি ভালোভাবেই জানতেন। তাই বলা যায়, বাগানের ফুল ছেঁড়ায় প্রতিশোধ নিতেই তিনি আঁখির বাড়িতে গিয়ে তাকে সুপরিকল্পিতভাবে গালমন্দ করেছেন এবং আঁখিকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছেন। এজন্য কি তার শাস্তি হওয়া উচিত নয়?

 

আঁখির বাবা কাবুল তো সত্যিই বলেছেন, কী এমন অপরাধ করেছিল আঁখি। কয়েকটি ফুলইতো তুলেছিল। তার জন্য এমনভাবে বকতে হবে, অপমান করতে হবে! দুদিন পরইতো ওই বাগানে ফের ফুল ফুটবে। কিন্তু যে আঁখি আজ বুঁজে গেল, সে তো কোনোদিনই আর চোখ মেলবে না। নাসিরুল ইসলাম কি পারবেন আঁখির জীবন ফিরিয়ে দিতে?

 

আঁখি কীসের জন্য ফুল তুলেছিল? সে কি নিজের খোপায় গোঁজার জন্য নাসিরুল ইসলামের বাগানের ফুল তুলেছিল, নাকি নিজের ঘর সাজানোর জন্য? না, সে নিজের জন্য ফুল ছিঁড়েনি। সে ফুল তুলতে গিয়েছিল আমাদের ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়ে গিয়েছেন, সেই সব মহান প্রবাদ পুরুষ ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর নিমিত্তে ফুল সংগ্রহের জন্য। নাসিরুল ইসলামের বিবেক-বোধশূন্য মানসিকতা আঁখির এই আবেদনটুকুও বুঝতে পারেনি। তাই তো ভাষা আন্দোলনের ৬৪ বছর পরও ডিজিটাল বাংলাদেশে এসে আঁখিকে ‘শহীদ’ হতে হলো।

 

পরিশেষে নাসিরুল ইসলাম ও তার স্ত্রীকে উদ্দেশ করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়ের মতো একটি কথাই বলব, ‘পুষ্প আপনার জন্য ফোটে না। পরের জন্য আপনার হৃদয়কে প্রস্ফুটিত করিও।’



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়