ঢাকা     সোমবার   ০৬ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৩ ১৪৩১

উসাইন ‘দ্য লাইটনিং’বোল্ট

রাব্বি খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ২১ আগস্ট ২০২১   আপডেট: ১৪:৪১, ২১ আগস্ট ২০২১
উসাইন ‘দ্য লাইটনিং’বোল্ট

উসাইন বোল্ট

দৌড় যেন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। যার প্রতি ধাপে হতাশা, সাফল্য, অর্জন, বিসর্জন। সময়ের কাঁটা ধরে লক্ষ্যে ছুটে চলা। হিসাবের মঞ্চেকেও পরাজিত করে জয়ী।

সেই দৌড়েই একজীবনের বেশিটা সময় যিনি পার করেছেন, পেছনে ফেলেছেন ব্যর্থতা, ছুঁয়েছেন সাফল্যের স্বপ্নচূড়া। একজন মানুষ যে কিনা মাত্র ১০ সেকেন্ডের'ও কম সময় দৌড়ে পারফরম্যান্স করেছেন। অথচ বিশ্বব্যাপী রয়েছে তার জন্য চরম উন্মাদনা। এথলেটিক্স জগতের সমস্ত আলো কেড়ে নিয়ে, যে নিজেকে এমন এক অবিশ্বাস্য উচ্চতায় আরোহণ করেছে, যেখানে অন্য কোনো অ্যাথলেট স্বপ্নেও পৌঁছানোর সাহস পায় না। যিনি বিশ্বরেকর্ড গড়াকে রীতিমতো বানিয়েছিলেন ছেলেখেলা।

মাঠের বাইরে নিষ্কলুষ থেকেও যিনি তুলেছিলেন গতির ঝড়, যিনি জিতেছেন এবং কেবলই জিতেছেন, হয়েছেন এথলেটিক্স এর মহাকাশে চির যৌবনময় এক নক্ষত্র। তিনি ট্রাক এন্ড ফিল্ডের একচ্ছত্র অধিপতি ‘উসাইন সেন্ট লিও ‘দ্য লাইটনিং’ বোল্ট’।

জ্যামাইকার ছোট্ট শহর ট্রিলনি পারিশে ১৯৮৬ সালের ২১ আগস্ট জন্ম গ্রহণ করেছিলেন বোল্ট। বাবা ওয়েলেসলি, মা জেনিফার বোল্ট। ভাই সাদেকি ও বোন শেরিনকে নিয়ে বেড়ে ওঠে ছেলেটি। কে ভেবেছিল মুদি দোকানি এ ছেলেটাই একদিন আ্যথলেটিকসের রাজা হবেন। যে হাতে বিক্রি করতেন চাল-ডাল, সে হাত দিয়েই একদিন অটোগ্রাফ দিবেন অসংখ্য ভক্তকুলকে। সেই চাল ডাল বিক্রি করা ছোট্ট ছেলেটিই আজকের কিংবদন্তী উসাইন বোল্ট। পৃথিবীর সর্বকালের দ্রুততম মানব। যিনি তিনি ১০০ মিটার দৌড় ৯.৫৮ সেকেন্ডে এবং ২০০ মিটার দৌড় ১৯.১৯ সেকেন্ডে শেষ করেছেন। ২০১০ সালে ভেঙেছেন নিজের করা বিশ্বরেকর্ড। ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে জয় করেছেন ৯টি সোনা ৷

জ্যামাইকার ছোট্ট শহর সেরুট কনটেন্টের মাঠে-ঘাটে ছুটে চলা সেই ছেলেটিকে আজ বিশ্ব চেনে উসাইন বোল্ট নামে। ক্যারীবিয় দ্বীপপুঞ্জের আলো বাতাস গায়ে মেখে বেড়ে ওঠা। আনন্দ-ফুর্তি আর খেলাধুলাই ছিল যার ধ্যান-জ্ঞান। বন্ধুদের নিয়ে কখনো ক্রিকেট কিংবা কখনো ফুটবলে মাতিয়ে রাখতেন ছোট্ট এই শহরের ওলি গলি। ছোটবেলায় প্রাইমারি শিক্ষা গ্রহণের জন্য ভর্তি হয়েছিলেন জ্যামাইকার ওয়েলডেসিয়া প্রাইমারি স্কুলে। সেই স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমেই স্প্রিন্ট ট্র‌্যাকে প্রথম পা পড়ে বোল্টের এবং সেখানে শুরুতেই বাজিমাত করেছিলেন তিনি। ১২ বছর বয়সেই ভেঙে দেন ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্কুলের দ্রুত গতির রেকর্ড।

কিন্তু তখনো স্প্রিন্ট নয় বরং তার মস্তিষ্ক জুড়ে শুধুই ক্রিকেট আর ফুটবল। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছে ছিল ক্রিকেটার হওয়া। বলা চলে ক্রিকেটই তার প্রথম ভালোবাসা। জ্ঞান হওয়ার পর নাকি এই ক্রিকেটকেই তিনি প্রথম ভালোবেসে ছিলেন।

স্কুলজীবনে এই ক্রিকেটই ছিল তার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। একসময় ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে খেলারও স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই সঙ্গে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ফুটবল খেলাতেও ছিলেন বেশ পারদর্শী।

প্রাইমারির গণ্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে এসে জীবনের বাক বদল নেয় বোল্টের। ক্রিকেট খেলার সময় তার দ্রুত দৌড়ানো দেখে ট্র্যাক এন্ড ফিল্ডে মনোযোগ দিতে বলেন তার স্কুল দলের ক্রিকেট কোচ। গুরুর কথা মেনে পথ বদলান বোল্ট। হাইস্কুলের বাৎসরিক চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে ২০০ মিটারে রৌপ্য। সেই বছরেই জ্যামাইকার হয়ে অংশ নেন ক্যারীবিয়ান আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায়। সেই সঙ্গে ২০০ ও ৪০০ মিটারে জিতেন সিলভার। ২০০১ সালে প্রথমবার বিশ্ব মঞ্চে পা রাখেন বোল্ট। তবে হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত যুব চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাইপর্বে ২০০ মিটার স্প্রিন্টের সেই ট্র্যাকে অবশ্য পরাজয় বরণ করতে হয় তাকে। আর সেই পরাজয়ই তাকে গড়ে তুলে আরও শক্তিশালী হিসেবে। এর পরের গল্পটা শুধুই বোল্টের।

২০০২ সালে জ্যামাইকার ঘরের ট্র্যাকে নামেন বোল্ট। কে জানতো ওয়ার্ল্ড জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপে সেদিনই জন্ম নেবেন বিশ্বসেরা স্প্রিন্টার। তবে ২০০৩ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ইনজুরির সাথে বেশ লড়াই করতে তাঁকে। জীবনের উত্থানের গল্পের শুরু ২০০৭ সাল থেকে। ২০০৭ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটার ও ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে রুপা জিতেছিলেন, তবে তখনো তার হয়ে উঠা হয়নি ‘দ্য লাইটনিং’বোল্ট ।

বোল্ট ঝড় আসবে সবাই জানতো। তবে মঞ্চটা যে ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকেই হবে তবে সেটা আঁচ করতে পারেননি কেউ। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সবাইকে তাক লাগিয়ে স্বর্ণ জিতে নেন বোল্ট। অলিম্পিকতো বটেই সেই সাথে ৯.৬৯ সেকেন্ড নিয়ে গড়েন বিশ্বরেকর্ড। ১০০ মিটারের পর ২০০ মিটারেও জিতে নেন স্বর্ণ। সময় নেন মাত্র ১৯.৩০ সেকেন্ড। এরপর ৪ গুনিতক ১০০ মিটারের রিলেতে ৩৭ দশমিক ২৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে স্বর্ণ জিতে নেন বোল্ট। বেইজিংয়ের পর ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকেও ১০০ ও ২০০ মিটারের স্প্রিন্টে স্বর্ণ জিতেন তিনি। বেইজিং ও লন্ডন অলিম্পিকের পর রিওতেও ১০০ ও ২০০ মিটারের স্প্রিন্ট এবং ৪ গুনিতক ১০০ মিটারের রিলেতে স্বর্ণ জিতে সর্বকালের অন্যতম সেরা অ্যাথলেট হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন বোল্ট। এরপরই ঘোষণা দিলেন নিজের অমরত্বের। বোল্ট বলেন, ‘আমিই বিশ্বসেরা, আমিই সর্বকালের সেরা।’

তাছাড়াও উসেইন বোল্ট সর্বমোট পাঁচবার বর্ষসেরা অ্যাথলেট (পুরুষ) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। এর মধ্যে টানা তিনবার তিনি বর্ষসেরা পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০০৮, ২০০৯, ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ এই পাঁচ বছর তিনি বর্ষসেরার পুরস্কার জয় করেন। অ্যাথলেটিকে বোল্টের অবিস্মরণীয় সাফল্যের প্রেক্ষাপটে ২০০৯ ও ২০১০ সালে তিনি লরিয়াস বছরের সেরা বিশ্ব খেলোয়াড় পুরস্কার লাভ করেন।

২০১৬ সালে অনুষ্ঠেয় রিও ডি জেনিরো অলিম্পিকের পর ট্র্যাক থেকে বিদায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন উসেইন বোল্ট। ২০১৬ সালে অবসর নিচ্ছেন না বরং অংশ নেবেন ২০১৭ সালের লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও। এরপর তিনি তার বুটজোড়া তুলে রাখবেন।

অবসর প্রশ্নে অবশ্য নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার কারণটাও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, ‘রিও’র পরই অবসর নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ভক্তরা চেয়েছিল, আমি যেন অন্তত আরও একটা বছর খেলে যাই।’

মানুষের প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির মিল খুব কম সময়ই হয়ে থাকে। তবে কিংবদন্তিদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ আলাদা। ২০১৭ সালে লন্ডন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জ্যামাইকার এই গতি দানবের শেষটা মনের মতো হয়নি। বিদায়টা রাঙাতে পারেননি গতি দানব উসাইন বোল্ট। হিটে ভালো টাইমিং হয়নি। সেমিফাইনালের সুবিধা করতে পারেননি। হতাশার ধারাবাহিকতা ফাইনালে কাটিয়ে উঠতে পারলেন না বোল্ট। ক্যারিয়ারে গত নয় বছরে এই প্রথম কোনো দৌড়ে তৃতীয় হয়ে শেষ করলেন এই জীবন্ত কিংবদন্তি। নিজের শেষ ব্যক্তিগত দৌড়ে সোনা জিততে ব্যর্থ হয়ে বোল্ট যেন প্রমাণ করেছিলেন, তিনিও মানুষ! গতির ঝড় তুলে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে সোনার পদক জিতেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিন গ্যাটলিন।

লন্ডন স্টেডিয়ামে ৯.৯২ সেকেন্ডে সবার আগে দৌড় শেষ করেন গ্যাটলিন। ৯.৯৪ সেকেন্ডে রূপা জিতেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রিস্টিয়ান কোলম্যান। আর ৯.৯৫ সেকেন্ডে তৃতীয় হন বোল্ট।

২০০৫ সালে হেলসিঙ্কির আসরের এক যুগ পর বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে সেরা হলেন গ্যাটলিন। ১০০ মিটারে শেষটা বোল্টের সুখকর হলো না বটে। তবে সমর্থকদের হৃদয়ে তিনি চিরকাল অমর হয়েই থাকবেন ১০০ মিটারে ৯.৫৮ সেকেন্ড রেকর্ডের মালিক।

সেই সাথে ৪ গুণিতক ১০০ মিটার স্প্রিন্টে দুর্ভাগ্যের শিকার বোল্ট। ইনজুরিতে পড়ে সতীর্থের কাঁধে চড়ে ছাড়তে হয়েছে ট্র্যাক। কে জানতো এটাই হবে তার ক্যারিয়ারের শেষ ট্র্যাক। ক্যারিয়ারে সর্বমোট ২৯টি পদক যুক্ত হয় তার প্রাপ্তির খাতায়। এর মাঝে সব মিলিয়ে ২৩টি স্বর্ণ, ৫টি রৌপ্য এবং ১টি ব্রোঞ্জ নিয়ে শেষ করেন তার এ প্রাপ্তির খাতা।

বোল্ট কি কেবলই ট্র‍্যাকের রাজা!? বোল্ট তো জীবনযুদ্ধের রাজা!! যিনি দেখিয়েছেন জীবনের সকল সমস্যা, বাঁধা বিপত্তি পাশ কাটিয়ে কিভাবে আকাশ ছোঁয়া যায়। বোল্ট যা চেয়েছেন, তাই করে দেখিয়েছেন, আপন মহিমায়। শেষ বেলায় নিজের অন্যতম স্বপ্ন ফুটবলার হওয়ার সাধ'ও মিটিয়েছেন, প্রফেশনাল ফুটবল খেলেছেন। একজন বোল্ট তো অনুপ্রেরণা, অনুকরণীয় আদর্শ। বোল্ট আছেন, হৃদয়ে, ইতিহাসে, আকাশচুম্বী সফলতায়, বোল্টের সেই ট্রেডমার্ক সেলিব্রেশন নিয়ে কোটি মানুষের ভালোবাসায়।

সেই সঙ্গে আজ ২১ শে আগস্ট ৩৫ বছরে পা রাখলেন কিংবদন্তী এই দৌড়বিদ। শুভ জন্মদিন পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুততম মানব, শুভ জন্মদিন উসাইন ‘দ্য লাইটনিং’বোল্ট।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ