ঢাকা     মঙ্গলবার   ০৭ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

হলুদ উৎসবে থামলো বিশ্বকাপের ডামাডোল

ইয়াসিন হাসান, কলকাতা থেকে || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২৩:১৯, ২০ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ২৩:২০, ২০ নভেম্বর ২০২৩
হলুদ উৎসবে থামলো বিশ্বকাপের ডামাডোল

আসি আসি করে যে বিশ্বকাপ অপেক্ষায় রেখেছিল…৪৮ দিন নিজের জাদুতে আটকে রেখে, ক্রিকেট প্রেমে হাবুডুবু খাইয়ে তা বিদায়ও নিয়ে নিলো! গত ৫ অক্টোবর ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে যে ঢোলে বাড়ি পড়েছিল…রোববার সেখানে শানাইয়ে বেজেছে বিদায়ী সুর।

প্রায় ৯৫ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে যে মঞ্চ উৎসবের হাজারো রং ছিটিয়েছিল, সেটাই যেন রাতে ভাঙা বিয়েবাড়ি! কত স্মৃতি, কত ঘটনা, কত আলোচনা-সমালোচনা, নাটককে সাক্ষী করে বিদায় নিলো ভারত বিশ্বকাপ ২০২৩। স্বাগতিক ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার ফাইনাল দিয়ে পর্দা নেমেছে ‘ইট টেকস ওয়ানডে ডে’ স্লোগানে শুরু হওয়া ত্রয়োদশ বিশ্বকাপ।

শেষ দিনে বিজয়ের সেই দিনটি দেখে অস্ট্রেলিয়া। ভারতের নীল ঢেউ থামিয়ে বিশ্ব আবার দেখল হলুদ উৎসব। পাঁচ শিরোপা নিয়ে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকা অস্ট্রেলিয়া এবার নিজেদেরকে নিয়ে গেল আরও একধাপ উপরে। তাদের ষষ্ঠ শিরোপা আসলো ৮ বছর পর। ভারতের অপেক্ষা বাড়লো আরও ৪ বছরের।

২০১৩ সালের পর কোনো আইসিসি ইভেন্ট জিততে না পারা ভারত নিজেদের সামর্থ্যের পাশে এখন বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দিচ্ছে! কেন হচ্ছে না? উত্তরটা নেই কারও কাছেই। অথচ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রান, সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি সবই তো মেন ইন ব্লু শিবিরে। ৭৬৫ রান করে বিরাট কোহলি এক আসরে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড ভেঙেছেন। পেয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরার খেতাব। প্রথম চার ম্যাচ বসে থাকার পর পঞ্চম ম্যাচে মাঠে নামেন মোহাম্মদ শামি। এরপর ৭ ম্যাচে তার শিকার ২৪ উইকেট। সঙ্গে যদি দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের পুরস্কার দেওয়া হতো তাহলে জাদেজা কিংবা লোকেশ কেউ না কেউ সেটা পেয়ে যেত।

ব্যক্তিগত অর্জনে টইটুম্বুর ভারত শেষ ম্যাচেই পথ ভুলেছে। টানা দশ জয় নিয়ে ফাইনালে এসে শেষটা রাঙাতে পারেনি।  অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়া শুরুর দুই ম্যাচে বিব্রতকর হারকে সঙ্গী করে। এরপর সাত ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে। এরপর ফাইনালে। এরপর শিরোপায়। মিশন কমপ্লিট। তাদের এই মিশন সাকসেসফুল হওয়ার কারণেই আহমেদাবাদে হলুদ উৎসব হলো কিছুটা। কিন্তু সিডনি, মেলবোর্ন কিংবা অ্যাডিলেডে পাবে বা ঘরে বসে যেখানেই খেলা দেখেছেন সমর্থকরা সেখানেই হয়েছে বাধভাঙা উল্লাস।

বিশ্বকাপে যে দলের ওপর ক্রিকেট বিশ্বের নজর ছিল তারা সবচেয়ে বাজে পারফর্ম করে বিস্মিত করেছে। ২০১৯ বিশ্বকাপের চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড। নিউ জিল্যান্ডের কাছে প্রচন্ডভাবে বাজে শুরুর পর বাংলাদেশের বিপক্ষে জয় পেলেও তাদের বিশ্বকাপ শেষ হয় টেবিলে সাতে থেকে। যেখানে ৯ ম্যাচে তাদের জয় কেবল ৩টি। যেখানে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বিব্রতকর হারকেও সঙ্গী করতে হয় তাদের।

অন্যদিকে গতবার ফাইনালে হৃদয় ভাঙা নিউ জিল্যান্ডের বিশ্বকাপ সফর গেছে মিশ্র অভিজ্ঞতায়। শুরুর ৪ ম্যাচে দুর্দান্ত জয়ের পর পরের ৪ ম্যাচে টানা হার। সেমিফাইনাল খেলা যখন পেন্ডুলামে ঝুলছিল তখন শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো সেমিফাইনালের টিকিট পায় তারা।  কিন্তু এবার আর ফাইনালে ওঠা হয়নি তাদের। ভারতের জয়রথে থেমে যায় কেন উইলিয়ামসনের মিশন।

আরেক সেমিফাইনালিস্ট দক্ষিণ আফ্রিকা এবার চমকেই দিয়েছে। শুরুতে দুই জয়ের পর তৃতীয় ম্যাচে অঘটনের শিকার। নেদারল্যান্ডস গতবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর এবার পঞ্চাশ ওভারের ক্রিকেটে তাদের হারিয়ে দেয়। সেই হারের ক্ষত ভুলিয়ে দেয় ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে পাওয়া জয় দিয়ে। ৯ ম্যাচে ৭ জয়ে তারা টেবিলের দুইয়ে থেকে যায় সেমিতে। কিন্তু ইডেনে ফাইনালের টিকিট পাওয়ার লড়াইয়ে তারা পথ হারিয়ে ফেলে। থেমে যায় ৫৯৪ রান করা ডি ককের বিশ্বকাপ মিশন। অথচ তারা এবার বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ দলীয় ৪২৮ রান করেছিল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

বিশাল এই মঞ্চে যে দলগুলো হতাশ করেছে তারা হলো, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ। ৯ ম্যাচে ২ জয় পাওয়া বাংলাদেশের পারফরম্যান্স একেবারেই ছন্নছড়া। টেবিলে লাল সবুজ প্রতিনিধিদের অবস্থান আটে। তাতে নিশ্চিত হয়েছে ২০২৫ আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে অংশগ্রহণ। সমানসংখ্যাক জয় নিয়ে কিন্তু রান রেটে পিছিয়ে থাকায় শ্রীলঙ্কার অবস্থান নয়ে। হতশ্রী পারফরম্যান্সে তাদের ক্রিকেট বোর্ড ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সরকার বোর্ডের ওপর হস্তক্ষেপ করায় আইসিসি তরফ থেকে তাদের সদস্যপদ স্থগিত করা হয়েছে। ফলে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা বিশ্বকাপে খারাপ করে তলানিতেই নেই, মাঠের বাইরেও খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তান ৯ ম্যাচে ৪ জয় নিয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করে পাঁচে থেকে। আফ্রিদি, রউফ, বাবর, রিজওয়ানদের ওপর অনেক প্রত্যাশা থাকলেও তারা মেটাতে পারেননি। অন্যদিকে আফগানিস্তান ও নেদারল্যান্ডস বিশ্বকাপের মিশন নিয়ে সন্তুষ্টই থাকার কথা। আফগানিস্তান ৯ ম্যাচে ৪ জয় পেয়েছে। ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাকে হারানোর পর নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় পায় নবী, রশিদ খানরা। অস্ট্রেলিয়াকেও তারা প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু গ্লেন ম্যাক্সওয়েলের সর্বকালের সেরা ২০১ রানের ইনিংসে হৃদয় ভাঙে আফগানিস্তানের।

নেদারল্যান্ডস দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারানোর পর ইডেনে বাংলাদেশকে অবাক করে দেয় অসাধারণ বোলিংয়ে। ডাচদের সেদিনের উৎসবে বাংলাদেশ বিশ্বকাপে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি খায় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্যাট-বলে বাংলাদেশের হয়ে কেউ ভালো করতে পারেনি। তাতে প্রত্যাশিত ফলই গ্রহণ করতে হয় সাকিব অ্যান্ড কোংদের।

৪৮ ম্যাচের বিশ্বকাপ আয়োজনে মনে দাগ কেটেছে একাধিক পারফরম্যান্স। ম্যাক্সওয়েলের ২০১ রান নিশ্চিতভাবেই থাকবে সবার ওপরে। সঙ্গে বাংলাদেশের বিপক্ষে করা মিচেল মার্শ ও কুইন্টন ডি ককের ১৭৭ ও ১৭৪ সমানতালে এগিয়ে থাকবে। বোলিংয়ে মোহাম্মদ সামির ৭ উইকেট নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকাপের টপ পারফরম্যান্স। বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলতে এসে আলোড়ন ফেলেছেন নিউ জিল্যান্ডের রাচীন রবিন্দ্র।  ১০ ম্যাচে ৫৭৮ রান করে রয়েছেন বিরাট, রোহিত ও ডি ককের পর। বল হাতে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে এসে দ্যুতি ছড়িয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার জেরাল্ড কোয়েটজে। ৮ ম্যাচে ১৯.৮০ গড়ে ২০ উইকেট নিয়ে নিজের আগমনী বার্তা ভালোভাবেই দিয়েছেন।

বিশ্বকাপে মোট ছক্কা হয়েছে ৬৪৪টি। চার ২২৩৯টি। মোট সেঞ্চুরি হয়েছে ৪০টি। স্পিনাররা হাত ঘুরিয়ে উইকেট পেয়েছেন ২৩৯টি। পেসারদের পকেটে ৪৫১ উইকেট। বিশ্বকাপ শুরু আর শেষ হয়েছে এক গন্তব্যে। ইনজুরির কারণে শুরুর ট্রেনে চড়তে না পারা ত্রেভিস হেডে শেষটা রাঙিয়েছেন ১৩৭ রানের এক ইনিংস উপহার দিয়ে। অরভিন্দ ডি সিলভার পর প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে লক্ষ্য তাড়ায় সেঞ্চুরি করেন হেড। সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া জিতে নেয় ষষ্ঠ শিরোপা।

চ্যাম্পিয়ন দলের অধিনায়ক কামিন্স শিরোপা হাতে নিয়ে যাবার সময় বলেছেন, ‘শেষের জন্য সেরাটা জমিয়ে রেখেছিলাম।’ সত্যিই তারা শেষে যেভাবে মুগ্ধ করেছে তাতে ফুটে উঠেছে তাদের পেশাদারিত্ব, দৃঢ় মানসিকতা। মাঠে তা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন বলেই তারা বিশ্বকাপের সফলতম দল, হেক্সা মিশন সাকসেসফুল করে ক্রিকেট ইতিহাসের সফলতম দল। পরের বিশ্বকাপ। অপেক্ষা ৪ বছরের। গন্তব্য দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া ও জিম্বাবুয়ে। কাউন্ট ডাউন চাইলে এখন থেকে শুরু করা যেতে পারে।

ঢাকা/আমিনুল

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়