মুসলমানদের প্রথম কেবলা ও অসহায় ফিলিস্তিন
শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম
শাহ মতিন টিপু : মুসলমানদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস। পরে কেবলা হিসাবে কাবা গৃহ নির্ধারিত হলেও মুসলমানদের দৃষ্টিতে বায়তুল মুকাদ্দাসের পবিত্রতার মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে। মক্কা মুআয্যমাহ ও মদিনা মুনাওয়ারার পরে তৃতীয় পবিত্র স্থান। বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে সর্বশেষ ১৯৬৭ সালে ইসরাইল পবিত্র বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নেয়। পরে তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
হযরত রাসূলে করীম (সা.) মক্কার মসজিদুল হারাম, মদিনার মসজিদুন্নবী ও বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের উদ্দেশে সফরকে বিশেষভাবে সওয়াবের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা অন্য কোন মসজিদ সম্পর্কে করেননি। হিযরতের পর বায়তুল মুকাদ্দাসই ছিল ইসলামের প্রথম কিবলা। এ পবিত্র ঘর থেকেই খাতামুন্নাবীয়ীন হযরত মুহাম্মদ (সা.) মিরাজে গমন করেছিলেন।
হযরত ইবরাহীম (আ.) কাবাঘর নির্মাণের ৪০ বছর পর হযরত ইয়াকুব (আ.) জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন। অতঃপর হযরত সুলায়মান (আ.) এই পবিত্র মসজিদ পুনঃনির্মাণ করেন। বায়তুল মুকাদ্দাস নবীগণের স্মৃতিবিজড়িত। এখানে রয়েছে অসংখ্য নবী-রাসূলের রওজা। ওহী ও ইসলামের অবতরণ স্থল এ নগরী নবীগণের দ্বীন প্রচারের কেন্দ্রভূমি। তাই এ পবিত্র নগরীর প্রতি ভালবাসা প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ের গভীরে প্রোথিত।
আল কুদস কমিটি প্রকাশিত এ সম্পর্কিত বিভিন্ন নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ৬৩৮ ঈসায়ী সালে দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালে পুরো বায়তুল মুকাদ্দাস এলাকা মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১০৯৬ সালে খ্রিস্টান ক্রুসেডারগণ সমগ্র সিরিয়া ও ফিলিস্তিন দখল করে নেয়ার পর বায়তুল মুকাদ্দাস মসজিদের ব্যাপক পরিবর্তন করে একে গীর্জায় পরিণত করে। এরপর ১১৮৭ সালে মুসলিম বীর ও সিপাহসালার সুলতান সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী জেরুজালেম শহর পুনরায় মুসলমানদের অধিকারে নিয়ে আসেন।
এরপর থেকে শুরু হয় দখলের নতুন ষড়যন্ত্র। ইয়াহুদীরা তুরস্কের তৎকালীন শাসকের নিকট ফিলিস্তিনে জমি কেনার অনুমতি চায় এবং এর বিনিময়ে তারা তুরস্কের সকল বিদেশি ঋণ পরিশোধ করে দেবে বলে অঙ্গীকার করে। সুলতান তাদের এ ষড়যন্ত্রমূলক প্রস্তাব মানেননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইয়াহুদীরা গোপনে জমি কিনতে থাকে। ১৯১৭ সালে ইংরেজরা ফিলিস্তিনে প্রবেশ করে ও ১৯২০ সালে সেখানে পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে এবং স্যার হার্বাট স্যামুয়েল নামক একজন ইয়াহুদীকে সেখানে ব্রিটিশ কমিশনার নিযুক্ত করে। এইসময় জমি কেনায় বহিরাগত ইয়াহুদীদের জন্য ফিলিস্তিেিনর দুয়ার খুলে দেওয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহুদীবাদী উগ্র সংস্থাগুলোকে ফিলিস্তিনে বসবাস ও জমি কেনার জন্য কোটি কোটি ডলার প্রদান করে। ফলে অতি অল্প দিনের মধ্যে বহু সংখ্যক ইয়াহুদী ফিলিস্তিনে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে। ইয়াহুদীদের সংখ্যা বাড়তে থাকার কারণে আরব মুসলমানদের সঙ্গে দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার ফিলিস্তিনকে আরব ও ইয়াহুদীদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। যার ফলে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনে যায়নবাদী অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর ইয়াহুদীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং মুসলমানদের অত্যাচার করতে থাকে। তাদের অত্যাচারে জর্জরিত আরবরা জীবন বাঁচাতে দলে দলে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এ সত্ত্বেও তখনও বায়তুল মুকাদ্দাস মুসলমানদের দখলে ছিল। কিন্তু আরবদের দুর্বলতার মুখে ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তা হাত ছাড়া হয়। ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের আবাসভূমি ও আল-কুদস (বায়তুল মুকাদ্দাস) উদ্ধারের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের সংগ্রামে ইসরাইল দিশেহারা হয়ে ফিলিস্তিনের মধ্যে ভাঙন ধরানোর জন্য ফিলিস্তিনের একটি ক্ষুদ্র অংশে সীমিত স্বায়ত্ত শাসনের কথা বলে কিছু সংখ্যক নেতাকে বিভ্রান্ত করেছে। তথাকথিত শান্তি আলোচনার সুযোগে তারা একে একে ফিলিস্তিনের প্রকৃত সংগ্রামী নেতাদের হত্যা করে চলেছে এবং ফিলিস্তিনের নতুন নতুন এলাকা দখল করে ইয়াহুদী বসতি সম্প্রসারণ অব্যাহত রেখেছে। এমনকি ফিলিস্তিনে মানবিক ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে পর্যন্ত তারা বাধা দিচ্ছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজা অবরুদ্ধ করে রেখেছে আরব বিশ্বের ক্যান্সার খ্যাত এই যায়নবাদী ইসরাইল রাষ্ট্রটি। তখন থেকে গাজাবাসীকে ত্রাণের আশায় অপেক্ষা করতে হয়। ত্রাণের নামে গাজাবাসীর ওপর অমানবিক কার্যক্রম চলছে বছরের পর বছর ধরে। ৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনি জনগণকে নিজ জন্মভূমিতে পরাধীনভাবে বসবাস করতে হচ্ছে। গাজা অবরোধের কারণে সেখানে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধাসহ লাখ লাখ মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। মানুষ তীব্র খাদ্যাভাবে ভুগছে। শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মতো মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত তারা। লাখ লাখ নবী-রাসুলের স্মৃতিধন্য ফিলিস্তিনের আজ করুণ অবস্থা।
কুরআন মজিদে হযরত মূসা (আঃ)-এর যবানীতে ফিলিস্তিন ভূখন্ডকে ‘পবিত্র ভূমি’ বলে উল্লে করা হয়েছে। তিনি বনী ইসরাঈলকে পবিত্র ভূমিতে প্রবেশের আদেশ দেন, কিন্তু তারা সেখানে প্রবেশে অস্বীকৃতি জানায়। (সুরাহ আল-মায়েদাহ : ২১-২২)। সমগ্র ফিলিস্তিনই হচ্ছে সেই পবিত্র ভূমি, তবে বায়তুল মুকাদ্দাস বিশেষ পবিত্রতার অধিকারী। সূরা বনী ইসরাইলেও অধিকতর সুস্পষ্টভাবে এ ভূখণ্ডের পবিত্রতা বা বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইরানের ধর্মীয় নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেনী এ পবিত্র মসজিদ পুনরুদ্ধারের দাবিতে রমযানের শেষ শুক্রবার আল-কুদস দিবস ঘোষণা করেন। এই দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে ১৯৭৯ সাল থেকে পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক আল-কুদ্স দিবস। দিবসটি উপলক্ষে আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ-এর উদ্যোগে আজ বিকাল ৩.৩০ টায় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মিলনায়তনে ‘আল-কুদ্্সের মুক্তি, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও সাম্প্রতিক অন্তরায়সমূহ’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের রাষ্ট্রদূত ড. আব্বাস ভায়েজী দেহনাভী, ফিলিস্তিন দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব দি মিশন ইউসুফ এস.ওয়াই. রামাযান, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক ধর্মমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন আল-আজাদ ও নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এম. ওয়াহিদুজ্জামান সেমিনারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন বাংলাদেশ খিলাফত আন্দোলনের আমির-এ শরিয়ত হাফেয মাওলানা শাহ আতাউল্লাহ ইবনে হাফেজ্জী হুজুর, মজিদিয়া কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ড. মাওলানা এ. কে. এম. মাহবুবুর রহমান, ইমাম হোসাইন একাডেমীর চেয়ারম্যান মাওলানা সাইয়্যেদ আফতাব হোসেন নাকাভী, আজকের ভোলা সম্পাদক অধ্যক্ষ শওকাত হোসেন ও দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক জামালউদ্দিন বারী।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবদুল মুনিম খান। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন আল-কুদ্্স কমিটি বাংলাদেশ এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট এ. কে. এম. বদরুদ্দোজা। সভাপতিত্ব করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ও আল-কুদ্স কমিটি বাংলাদেশ-এর সভাপতি প্রফেসর ড. শাহ্ কাউছার মুস্তাফা আবুলউলায়ী।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুলাই ২০১৫/টিপু/শাহনেওয়াজ
রাইজিংবিডি.কম