ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পাহাড় উঠে গেছে মেঘের ভেতর

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৪৮, ১৫ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ২২:৫২, ১৫ জানুয়ারি ২০২২
পাহাড় উঠে গেছে মেঘের ভেতর

ঝিরির পরতে স্রোতের কলতান: তৃতীয় পর্ব

চন্দ্রের মুখে কয়েবার উচ্চারিত হলো নতুন এক বাক্য ‘টুপি পরাতে হবে’। আমি তার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারলাম না। পথে একটা জায়গা দ্রুত অতিক্রম করতে হবে, কারণ সেখান দিয়ে সেনা সদস্যরা প্রায়ই যাতায়াত করে। পর্বত শিখর দিয়ে এগিয়ে জায়গাটা একরূপ দৌড়েই পার হতে হলো। এরপর বুঝলাম, ফাঁকি দেয়া বা বোকা বানানোর ব্যাপারটাই চন্দ্রের ভাষায় ‘টুপি পরানো’।

পথ ক্রমেই নিচের দিকে নামছে। গরু বা গয়াল চলাচলের পথ। প্রচন্ড কাদা, কোথাও কোথাও হাঁটু পর্যন্ত। বহু কসরত আর পরিশ্রমের পর পতিত হলাম আবারও সেই একই খালে, যা শুরু থেকেই আমাদের সঙ্গে চলছে। আমাদের পথ উজানে। এদিকটাতে খাল বেশ চওড়া, তবে অল্প গভীরতার পানি বইছে কুলকুল করে। তার মাঝে ছড়িয়ে আছে অজস্র পাথর। পাথরের অরণ্য পেরিয়ে সন্ধ্যার পরপর উপস্থিত হলাম কাঙ্ক্ষিত খদপাড়ায়।

বেশিরভাগ মুরং বসতির অবস্থান পানির উৎসের কাছে। খদপাড়া তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। খালের বাঁকেই বেশ বড় একটা বসতি। বাইরে কোনো মানুষ নেই। সকলেই ঘরে ঢুকে পড়েছে। পশুগুলোও ঢুকে পড়েছে ঘরের মাচার নিচে। 

আমরা অতিথি হলাম চন্দ্রের পূর্ব পরিচিত কাই মুরং-এর বাড়িতে। একমাত্র তিনি ছাড়া পরিবারের আর কেউ বাংলা বলতে পারে না। বাড়িটি একেবারে খালের সাথে। জলের ধারায় মন জুড়ানো কুলকুল শব্দ তার নিত্য প্রহরের সঙ্গী। ঘরে ঢোকার পর আপ্যায়ন পর্ব শুরু হলো পাকা কলা দিয়ে। এরপর সিদ্ধ ভুট্টা। সজ্জন ব্যক্তি কাই মুরং, খুব আগ্রহ নিয়ে আমাদের ভ্রমণ বিস্তারিত এবং পরবর্তী গন্তব্য সম্বন্ধে শুনলেন। চন্দ্রের ইচ্ছা পরের দিনগুলোতে কাই’দা নিজেই আমাদের পথপ্রদর্শক হোক। জরুরি কাজ পরে যাওয়ায় তিনি পারলেন না। তবে নিশ্চিত করলেন জানাশোনা আছে এবং পথ চেনে এমন একজনকে সঙ্গে দেবেন। 

গোসল সেরে ফিরে দেখি চায়ের আসর চলছে। জড়ো হয়েছে আরও কয়েকজন। তাদের মাঝে একজনের হাতে সবচেয়ে বড় চায়ের পেয়ালা। ঠিক পেয়ালা নয়, ঝোল তরকারি পরিবেশনের মত একটা কড়ির বাটি। দুই হাতের তালুতে চেপে ধরে শুরুৎ শুরুৎ চা পান করছেন। নাম লিনি মুরং। কাই’দা পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন সেই হবে আমাদের পথপ্রদর্শক।

ওদিকে আমাদের জন্য রান্নার কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে। কাইদা’র খাটো মতন কিশোরী মেয়েটি একাই রান্না করছে। মাচার উপর দিয়ে মচমচ করে হাঁটছে আর কাজ করছে। বাড়ির সব রান্নার দায়িত্ব তার উপর। সবাই জুমে যায়, আর সে তাদের জন্য রান্না করে রাখে। রাতে খাওয়ার সময় হলে গিয়ে দেখি প্রতিটি থালায় ভাত তুলে গোল করে সাজানো এবং মাঝখানে অন্যান্য তরকারির পাত্র। মারফার ঝোল এবং লাউ, ঝিঙ্গা, করলা দিয়ে চিংড়ীর আলাদা একটা তরকারি। সাথে গামলা ভর্তি কন্ডুং নামের এক ধরনের কাঁচা শাকপাতা এবং অপর পাত্রে মরিচ-নাপ্পির ভর্তার পাশে কর্পা নামক কচু ডাটার টুকরো। প্রতি গ্রাসে দুই একটা শাকপাতা ছিড়ে মুখে দেয়া তাদের অভ্যাস। অধিকন্তু, দুই-তিন গ্রাস খাওয়ার পর কচুর এক টুকরোয় সামান্য ভর্তা মাখিয়ে কচমচ করে চিবিয়ে খাওয়া একাধারে সুস্বাদু এবং শরীরের জন্য উপকারী। একগুচ্ছ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটা মুরং পরিবারের সঙ্গে আন্তরিক খাওয়াদাওয়া শেষে শুরু হলো গল্পগুজবের দ্বিতীয় পর্ব। সেক্ষেত্রে, উভয় পক্ষের কথোপকথনে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করে গেলেন স্বয়ং কাই’দা। 

মচমচ শব্দে শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেল। শব্দের সাথে ঘরময় ছড়িয়ে পড়লো মৃদু দুলুনি। চোখ মেলে দেখি কাইদা’র কিশোরী মেয়েটি রান্নার কাজে লেগে পড়েছে। সকাল হওয়ার সাথে সাথে পেট ভরে ভাত খাওয়ার পর দলবেঁধে সকলেই জুমে যাবে। সূর্যের আলো ফুটে বেরোবার আগেই তার রান্নার কাজ শেষ হয়ে গেল। এর মধ্যে লিনিও এসে হাজির। কাঁধে ব্যাগ এবং হাতে একটা দা নিয়ে পথপ্রদর্শক লিনি চললো আগে আগে। বসতির মাথার উপর আরোহণের পর নিচ দিকে তাকিয়ে সর্বপ্রথম দৃশ্যমান হলো খালের হাঁসুলি বাঁক। বাঁকের ঠিক বুকের মধ্যে খদপাড়া। পাড়ার চরদিক থেকে পাহাড়গুলো উঠে গিয়েছে মেঘের ভেতর। 

পাহাড়ের শীর্ষদেশ ধরে এক ঘণ্টা এগিয়ে উপস্থিত হলাম লিনির জুমঘরে। পাহাড়ে পাহাড়ে ধান পেকে হলুদ হয়ে আছে। জুমঘরটির অবস্থান ঠিক তার মাঝখানে। এক পশলা বৃষ্টির পর আবারও পথে নামতে হলো। সামনের পথ এগিয়েছে ঝিরি ধরে। পাহাড়ের শীর্ষ থেকে নেমে পতিত হলাম ভালুক ঝিরির শীতল ধারায়। ঝিরির নাম এমন কেন হলো তার উত্তর যদিও নামের মধ্যেই নিহিত কিন্তু লিনি সে বিষয়ে কোনো তথ্যই সরবরাহ করতে পারল না। অথচ সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে তার প্যাচাল, চলছে রেডিওর মতো বিরতিহীন। এমন আরও কয়টা ঝিরি পার হতে হবে সে প্রশ্নের উত্তরেও কবি নীরব। বড় বড় পাথরের স্তূপ এবং হড়কা বানের ঠেলায় জড়ো হওয়া বাঁশের টুকরোগুলো চলতি পথের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তার উপর দিয়ে বৃষ্টির পানিতে পাথরের শরীর পিচ্ছিল হয়ে একেকটা মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। ভালুক ঝিরির সমাপ্তি ঘটলো পোয়ারি খালে গিয়ে।

প্রবহমান টলটলে পানি দেখে কেউ আর লোভ সামলাতে পারলাম না। এক পর্ব গোসলের পর মিলনবিন্দু থেকে পা বাড়ালাম পোয়ার উজান পথে। প্রশস্ত খাল গিয়ে  ঢুকে পড়ল গিরিখাতের ভেতর। কালো কুচকুচে সুউচ্চ প্রাচীরের মাঝখান দিয়ে পথ। উপর থেকে ঝুলে পড়েছে লতা আর বৃক্ষের ডালপালা। পানির গভীরতা হাঁটু থেকে কোমর সমান কিন্তু স্রোতের অনেক শক্তি। দীর্ঘ পথ চলার পর একটা পাহাড় টপকে প্রবেশ করলাম কাতিয়া ঝিরিতে। ঝিরির সবচেয়ে সুন্দর জায়গা বলে যেটা মনে হলো ঠিক সেখানে একটা লম্বা বিরতি এবং ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে শুরু হয়ে গেল রান্না। চা-নাস্তা তৈরিতে শরিফ ভাইয়ের পটুতা আর ধৈর্যের তারিফ না করলেই নয়। এই ফাঁকে লিনি বাঁশ দিয়ে একটা করে পানপাত্র বানিয়ে ফেললো। ওটস-নুডুলস-এর মিশ্রণে এক প্রকার ঘাটি এবং সবশেষে এক পাত্র করে কফি। 

 

কাতিয়া থেকে উঁচু পাহাড় পার হয়ে সাইং নামে আরেকটা ঝিরি। ঝিরি মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হলো আরও উজানে। যেতে যেতে গিয়ে উপস্থিত হলাম একটা খাতের প্রায় শেষ প্রান্ত। লিনির দেয়া তথ্য মতে তা সাইং ঝিরির উৎস মুখ। সেখান থেকে অত্যন্ত পিচ্ছিল একটা পথ উঠে গিয়েছে পাহাড়ের মাথায়। কোনোমতে পাহাড় পারি দিয়ে পতিত হলাম সন্দু নামক আর এক ঝিরির উৎসে।

এলাকাজুড়ে কুমারী বনের অন্ধকার ছায়া। গহীন অরণ্য বললেও ভুল হবে না। মানব বসতির সংখ্যা একেবারেই নগন্য। এমনও বসতি আছে যার অনেক বাসিন্দাই জীবনে কখনও উপজেলা সদর দেখেনি। তারা নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া এসব পথে পা বাড়ান না। সুতরাং, সমতলবাসীদের যাতায়াত কল্পনার অতীত। এমনকি কাঠ, বাঁশ বা অন্যান্য বনজসম্পদ চোরাকারবারীদেরও এটি আয়ত্বের বাইরে। জঙ্গলাকীর্ণ ছোট্ট সন্দু ঝিরি চলতে চলতে কখন যে চওড়া হয়ে গেল টের পেলাম না। আমাদের পরবর্তী আস্তানা থুইপাড়া। তার আগেই প্রবল বৃষ্টির কবলে ফেঁসে গেলাম। বাধ্য হয়ে পাথরের উপর আশ্রয় করে প্রতীক্ষায় থাকতে হলো- কখন বৃষ্টি থামে! পানির উচ্চতা ক্রমেই বেড়ে চললো। বৃষ্টি থামার নাম নেই। অবশেষে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সন্ধ্যার খানিক আগে গিয়ে উপস্থিত হলাম থুইপাড়া। (চলবে)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব : সেনাক্যাম্প এড়িয়ে পার্বত্য এলাকার আরো গভীরে 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়