ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

দার্জিলিংয়ের পথে-১২

কালিম্পংয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা...

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ৩ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কালিম্পংয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা...

কালিম্পংয়ে গ্রুপ ছবি। পেছনে কাঞ্চনজঙ্ঘা

উদয় হাকিম : কালিম্পং। সবুজ বনানীতে সাজানো সুউচ্চ পাহাড় আর তার ভাঁজে ভাঁজে মেঘের খেলা- এই হলো কালিম্পং এর আসল সৌন্দর্য। একে আরো মোহনীয় করেছে প্রবাহমান তিস্তা। এত শান্ত, স্নিগ্ধ মনোলোভা স্থান পৃথিবীতে কম-ই আছে। বলা চলে কবি-সাহিত্যিকদের জন্য আদর্শ জায়গা।

কালিম্পং এর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা বলা চলে দেলু বাইও বোটানিক পার্ক। এর বিশাল এবং বৈচিত্র্যময় চত্বর মন কাড়ে সবারই। নানা রকমের পাতাবাহার, ক্যাকটাস আর শত শত জাতের গাছগাছালিতে পরিপূর্ণ। প্রকৃতিকে এখানে কোনো আঘাত করা হয়নি। লালন করা হয়েছে সযতেœ। উঁচু-নিচু জায়গাগুলোকে তার মতো রেখেই সাজানো হয়েছে।

গাইড পার্থ শুরুতেই আমাদের নিয়ে গেলেন পশ্চিম উত্তর কোনের একটি উঁচু জায়গায়। আঙ্গুল তুলে দেখালেন, ওইটা কাঞ্চনজঙ্ঘা। পশ্চিম-উত্তর কোণে ধবধবে সাদা একটি চূড়া। পিরামিডের মতো মাথা বের করে আছে। দুই পাশে ঘন সাদা মেঘ। যে কারণে শুধু ওই সুশ্রী মু-ু টুকুই দেখা যাচ্ছিলো। এটা দেখার জন্য কত চেষ্টা করেছিলাম দার্জিলিংয়ে। পারি নি। যাক, অবশেষে এই ট্যুরে পরম আকাঙ্খিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা হলো। কি বিশাল শুভ্র সৌন্দর্য নিয়ে নিশ্চুপ অবিচল দাঁড়িয়ে আছে।

দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর কাছে তিস্তা। যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম তার ঠিক নিচ দিয়েই সর্পিল গতিতে বয়ে গেছে। দুপাশে ঘন বন। মাঝখানে রূপসী স্রোতস্বীনি। হিমালয় থেকে এর উৎপত্তি। লামো লেক থেকে। বলা হয়ে থাকে, যৌথভাবে লামো লেক এবং তিস্তা খাংচি হিমবাহ থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এই হিমবাহ ৭ হাজার ৮০০ মিটার উচ্চতায়। স্থানটি উত্তর সিকিমে পড়েছে। এই নদী দিয়ে সিকিম এবং কালিম্পং এর সীমানা ভাগ করা।

আমি বললাম, গ্রুপ ছবিটা ওখানেই হয়ে যাক। সবাই জার্সি নিয়ে এসেছিলেন। সেটি গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। পেছনে পাহাড়ের মাথায় আটকে থাকা মেঘ আর কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া নিয়ে ছবি হলো। প্রথমে ফিরোজ আলম, পরে মিলটন ছবি তুললেন। এ দুজনের ফটোগ্রাফির হাত ভালো।

কিন্তু সবার ছবি তো হলো না। তাহলে? স্থান বদল করলাম। জার্সিও চেঞ্জ হলো। ক্যামেরা চলে গেলো গাইড পার্থর হাতে। পার্থ অবশ্য ভালোই ছবি তোলেন। ক্লিক.. ক্লিক..।

গেরুয়া বসন পরা বৌদ্ধ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখক


এবার একা একা ছবি তোলার পালা। একটা ক্যামেরা জনির হাতে দিয়ে আরেকটা নিয়ে গেলেন ফিরোজ-মিলটন-মামুন। তারা কোথায় গেলো কে জানে। ছবি তোলার দুর্দান্ত নেশা এই তিনজনের। জনির ক্যামেরা আমি নিয়ে কিছু ছবি তুললাম। জনি, সোহাগ, শাকিল, সাইফুল, কোচ জাহিদ, নারকেল জাহিদ, আরো কয়েকজনের সিঙ্গেল ছবি নিলাম। সোহাগ এসে বায়না ধরলো তার খালি গায়ে ছবি তুলতে হবে! পোলাপান! দিলাম তুলে। জনি বললো, এভাবে আমার ছবি তুলতে। স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে তুললাম আমিও। রেলিং এর উপর দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মেঘে ভেসে যাওয়ার মতো করে পোজ দিলাম। ক্লিক..। ছবি তোলা যেন শেষই হচ্ছিলো না। শুয়ে বসে যে যেভাবে পারে ছবি তুলছিলো। কিছুক্ষণ পর মেমোরি কার্ড ফুল হয়ে গেলো। এবার শুরু হলো মোবাইল ফোনে তোলা।

একদল বৌদ্ধ শিক্ষার্থী, ভিক্ষু হওয়ার ব্রত নিয়ে যারা দীক্ষা নিচ্ছেন, গেরুয়া বসন পরে এসেছিলেন। তাদের দেখে অনুরোধ করলাম। সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন। তাদের নিয়ে হলো আরেকটা গ্রুপ ছবি। এরপর গেলাম দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নিচু জায়গার দিকে। ওখান থেকে প্যারাগ্লাইডিং দেখা যাচ্ছিলো। অনেক উঁচুতে বেলুনের মতো কাপড়ে ভেসে বেড়াচ্ছিলেন পর্যটকরা। দেখতে ভালো লাগছিলো। কিন্তু নিজে চড়তে ভয় লাগছিলো। দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে শূন্যে ভেসে যাচ্ছিলেন তারা। জগতের সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি। 

নূরুল আফসার চৌধুরী দেখলাম ফুল নিয়ে কসরত করছিলেন। ফুলের ছবি তোলার জন্য ঝুঁকে পড়ছিলেন, শুয়ে পড়ছিলেন। কিন্তু মামুনরা কোথায়? একবারে পশ্চিমে একটি টিলা আছে। এই পার্কের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। সেখানে যাচ্ছিলাম। দেখলাম পথে অফিস ঘর আর মন্দিরের পাশের রাস্তায় বসে পোজ দিচ্ছেন ফিরোজ আলম। ক্যামেরা মিলটনের হাতে।

জনি আর সাইফুলকে নিয়ে গেলাম উঁচু ওয়াচ টাওয়ারের নিচে। ওখান থেকে তিস্তা আর পার্শ্ববর্তী পাহাড়কে আরো রূপবতী মনে হচ্ছিলো। মোবাইলে ছবি তোলা চলছিলোই। পাশের ঘাসেমোড়া সবুজ কার্পেটের ওপর বাচ্চা আর তাদের মায়েদের হৈ-হল্লোড় চলছিলো। আর সময় ছিলো না। বেরিয়ে গেলাম পার্ক থেকে।

রূপসী স্রোতস্বীনি তিস্তা


হোটেলে গিয়ে পড়লাম বিপদে। তখনো রুমে কিছুই দেয়া হয়নি। যতবারই ফোন করি ততবারই উত্তর দিচ্ছিলো, দেখছি দাদা। কিন্তু দেখা আর হচ্ছিলো না। একজন একজন করে লোক আসছিলো, চলে যাচ্ছিলো। কাজের কাজ হচ্ছিলো না। টিভি নষ্ট, সেটি দেখতে একজন এসে বললেন, এটা তো ঠিকই ছিলো ..। আমি বললাম, সত্য করে বলেন তো কাহিনী কি? আমার তো মনে হচ্ছে এগুলো কখনোই ঠিক ছিলো না। এসব বলা আপনাদের পলিসি। লোকটি ভ্যাঁবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।

আসলে ঘটনা হচ্ছে এখানে এক রাতের বেশি সাধারণত কেউ থাকতে আসে না। তাই টিভি ঠিক করার দরকার হয় না। কেউ ঠিক করতে বললেও, দেখছি বলতে বলতেই সময় শেষ হয়ে যায়। সকালে চলে যায়। ঠিক করার দরকার হয় না। টাওয়েল, ওয়াশরুম, সাবান এগুলো? ওই একই ব্যাপার। ৫/৬ বারের বেশি একই বিষয় নিয়ে কেউ বলে না। সবাই নীরবে সহ্য করেই চলে যায়।

আমরা ছিলাম নাছোড়বান্দা। শেষে সাবান আর টাওয়েল আসলো। ফিরোজ আলম প্রস্তাব করলেন, আপনারা মামুনদের রুমে চলে যান। তাই গেলাম, বেচারা মামুন আর আলভি চলে গেলেন আমাদের রুমে।

রাতের খাবার শেষ করে সবাই ঘুমিয়ে। আমি লিখতে বসলাম। লেখা শেষ হলে তখন অনেক রাত।  নিচ থেকে গানের আওয়াজ আসছিলো। এরা কারা? আমাদের টিমের, নাকি বাইরের শিল্পী। ভাবলাম গিয়ে দেখি। পরে মনে হলো টিমের ২ জন সিনিয়রের মধ্যে একজন আমি। নিচে গিয়ে কি না কি দেখব! মামুনের রুমে গিয়ে টোকা দিলাম। বেচারা কাঁচা ঘুম নিয়ে উঠে এলেন। বললাম স্যরি। না বলেন, সমস্যা নেই। নিচে গিয়ে দেখবেন গান গাইছেন কারা। আমি যেতে চাই। যাওয়া ঠিক হবে কি না। ওকে, আমি দেখছি।

কিছুক্ষণ পর মামুন এসে বললেন, আপনার যাওয়া ঠিক হবে না। পরে শুনলাম জুনিয়ররা মুরগি এনেছিলো বাইরে থেকে। ছিলো আরো কিছু খাওয়ার জিনিস। খাচ্ছিলো আর ঘটি বাটি বাজিয়ে গান গাইছিলো। আমি শিওর ইয়া চৌধুরী আর শাকিল ছিলেন মধ্যমনি।

লেখকের সঙ্গে গাইড পার্থ বাসনেত


সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে জিপে উঠলাম। আবারো সেই সুষম ঢাল পেরিয়ে তিস্তা ব্রিজ পার হচ্ছিলাম। যাচ্ছিলাম শিলিগুড়ির পথে। ত্রিবেণীর ঠিক পরে তিস্তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটা পার হচ্ছিলাম। গাড়ি থামাতে বললাম। সবাই নেমে গেলাম নদীর পাড়ে। নদীর একটা অসাধারণ ভিউ পাওয়া গেলো। সেখানেই সবাই ছবি তুললাম। জায়গাটা এত চমৎকার যে, ওটাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিলো না। মনে মনে বললাম, আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে..।

এতদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন পার্থ। দেখেছেন আমাদের সকল স্বার্থ। আমাদের গাইড। আজ তাকে বিদায় বলতে হবে। ডাকলাম। মিলটনকে বললাম আমাদের দুজনের ছবি তুলে দিতে। লোকটি একেবারে আমাদের একজন হয়ে উঠেছিলো। আমাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললেন।

আরো ভাটিতে এসেছিলাম চলে। তিস্তা ধরেই যাচ্ছিলাম। চমৎকার একটা ব্রিজ পেলাম। পার্থ বললেন, এটাকে বলা হয় করোনেশন ব্রিজ। ব্রিটিশ আমলে তৈরি। নির্মাণ শৈলীতেও আভিজাত্য।

সেবক নামে একটা জায়গায় দেখলাম বিশাল বিলের মতো। তিস্তার প্রথম সমতল। প্রথম উপত্যকা। বেসিনের মতো জায়গা। এখান থেকেই পাথর আহরণ করা হয়। সেগুলো ট্রাকে করে চলে যায় বাংলাদেশে।

সেবক পার হয়ে দেখলাম দুপাশে সমতল বন। গজারি আর শাল গাছ। আছে চা বাগানও। রাস্তা ঘেষে জামরুল গাছের সারি। রঙিন ফুল ফুটে আছে। মনে হচ্ছিলো আমরা ওই রাস্তা দিয়ে যাবো বলে তোরণ সাজানো হয়েছে। আরো সামনে সেনাবাহিনী ঘাঁটি। ক্যান্টনমেন্ট। পাশেই শুকনো নদী।

হোটেল স্বস্তিকায় কেক কেটে সোহাগের জন্মদিন উৎযাপন


শিলিগুড়িতে আবারো সেই হোটেল স্বস্তিকা। সত্যি! এখানকার খাবারটা অসাধারণ! বাঙালি খাবারের আসল টেস্ট ওখানে পেয়েছিলাম। খাবার খাওয়ার সময় একটা চমক ছিলো। সেদিন ছিলো সোহাগের জন্মদিন। তাকে না জানিয়ে আমরা কেকের অর্ডার দিয়েছিলাম ফোনে। এর কৃতিত্ব অবশ্যই ফিরোজ আলমের। সোহাগ তো লাঞ্চের সময় কেক দেখে অবাক! আনন্দে কেঁদে ফেলার যোগাড়। বলছিলো, এত মানুষের সঙ্গে জন্মদিনের কেক কাটব। ভাবিনি! এইতো জীবনের প্রাপ্তি!

লাঞ্চ শেষে টুকটুকে চড়ে গেলাম শ্যামলি কাউন্টারে। যাওয়ার পথে সিটি ট্যুরও হয়ে গেলো। ব্যাগ রেখে পার্থকে নিয়ে বের হলাম। পকেটে যতগুলো রুপি ছিলো সব দিয়ে চকলেট কিনলাম। আমার সঙ্গে নূরুল, আলভি এবং জনিও ছিলো।

স্বস্তিকার খাবার, শ্যামলীর ঠান্ডা বাতাস, দুপাশের দেশজ প্রকৃতি। মন ভরিয়ে দিচ্ছিলো।

কে জানে, আবার কবে যাব দার্জিলিং- কালিম্পং!

**
** 




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ জুন ২০১৮/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়