ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

যেভাবে এলো বড় বাপের পোলায় খায়

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০২, ৩১ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যেভাবে এলো বড় বাপের পোলায় খায়

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর: পুরান ঢাকার চকবাজার। বিকেল তিনটা থেকে শুরু করে ইফতারের সময় পর্যন্ত এখানকার ইফতার-বাজারে সবচেয়ে বেশি যে বাক্যটি শোনা যায় তা হলো: বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়। ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন, ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী একটি খাবারের নাম। ইফতারে এই খাবার বেশ জনপ্রিয়।

রোস্ট, ডাবলি, মিহির দানাসহ ১৫ রকমের পদ আর ১৬ রকমের মসলার সমন্বয়ে তৈরি এই খাবারটি ছাড়া ইফতার জমে না পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের। খাবারের বাহারি আয়োজন দেখলেই যেন জিহ্বায় পানি আসে। আর ঘ্রাণ? সে তো অর্ধেক ভোজনের সমান।  তাই তো ঢাকাবাসীর কাছে পুরান ঢাকার চকবাজারের এই ইফতারের চাহিদা অন্যরকম।

বড় বাপ, দাদা, বাবা থেকে চার পুরুষ ধরে রমজানে চকবাজারে ইফতার বিক্রি করছেন মোহাম্মদ হোসেন। তিনি জানান, পাকিস্তান আমলে তার বাপ-দাদা বিক্রি করতেন ঐতিহ্যবাহী ইফতারি শেখ চুরা ভর্তা। ধীরে ধীরে খাবারটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই খাবারের নাম বদলে যায়। যদিও এর কারণ এখন আর জানা যায় না। এরপর খাবারটির নতুন নাম হয় ‘বড় বাপের পোলায় খায়’। এখানেই নামটি সীমাবদ্ধ থাকেনি। স্থানীয় বিক্রেতাদের মুখে মুখে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরেকটি বাক্য: ‘ঠোঙ্গায় ভইরা লইয়া যায়’। চকবাজারে গেলে বিক্রেতাদের এই কোরাস আপনাকে মুগ্ধ করবে!  
 


অপর ব্যবসায়ী মুনছুর আলী জানান, যার হাত দিয়ে এই খাবারের উৎপত্তি, তিনি হলেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা দাতা মোহাম্মদ কামাল মাহমুদ। তিনি বরাবরই ভোজনরসিক ছিলেন। নানা ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি করতে জানতেন। এই খাবারটিও তারই সৃষ্টি। প্রায় ৮০ বছর আগে তিনিই প্রথম এই খাবার তৈরি করে চকবাজারে বিক্রি শুরু করেন। সেই ধারাবাহিকতা এখনো চলমান।

ইতিহাস যাই হোক না কেন, মোগল আমলের ঐতিহ্যের ছাপ ও ছোঁয়ার এসব ইফতারি কালক্রমে ঢাকার সব এলাকায় ছড়িয়ে পড়লেও এখনো পুরান ঢাকার ইফতারের ঐতিহ্য কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। শুধু ঐতিহ্য নয়, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাহারি আয়োজন। ফলে খানদানি ইফতারি মানেই পুরান ঢাকার ইফতার সামগ্রী। সুদূর উত্তরা থেকে চকবাজারে ইফতার কিনতে এসেছেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা শামীমুল ইসলাম। তিনি বলেন, প্রতি বছরই রমজানে এখানে ইফতার নিতে আসি। পুরান ঢাকার এই ইফতারে আলাদা একটা মজা আছে। আজ এসেছি মূলত ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নেওয়ার জন্য।

চকবাজারে এই আইটেম ছাড়াও রয়েছে আরো শত রকমের ইফতার সামগ্রী। এর মধ্যে বেগুনি, সবজি, পিঁয়াজু, পাকোড়া, আলুর চপ ৫ টাকা করে এবং ডিমের চপ ২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুরগির রোস্টের দাম ছোট-বড় ২২০ থেকে ৩০০ টাকা। কবুতরের রোস্ট ১৫০, কোয়েলের রোস্ট ৬০ টাকা, গরুর কাবাব ৬০০-৭০০, খাসির কাবাব ৮০০-৯০০ এবং সুতি কাবাব ৪০০-৫০০ টাকা। এর বাইরে সবজির কাঠি কাবাব প্রতিটি ২০ থেকে ৩০, গরুর কাঠি কাবাব ৪০ থেকে ৫০ এবং মুরগির কাঠি কাবাব ৪০ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। খাসির পায়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

চকবাজারের শাহী পরোটাও উল্লেখ করার মতো। সাধারণ শাহী পরোটা প্রতিটি ২৫ টাকা, ঝাল শাহী পরোটা ৩০, মুরগির মাংসের শাহী পরোটা ৪০, গরুর মাংসের শাহী পরোটা ৫০ ও খাসির পরোটা বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়।
 


রসালো খাবারের মধ্যে প্রতি কেজি দইবড়া ১০০ টাকা, দুধের পনির ৫০০, বোরহানি ১০০, পেস্তা শরবত ২০০ এবং মাঠা ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। শুধু তাই নয়। রয়েছে আচারের হরেক বাহার। প্রতি ১০০ গ্রাম প্যাকেটের আম, চালতা ও ত্রি-ফলার মোরব্বা ২০ এবং একই ওজনের বরই, তেঁতুল, জলপাইয়ের আচারও একই দামে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া শাহী জিলাপি ১৬০ থেকে ২৫০ ও খেজুর ৪০০ টাকা।

মুরগির মাংস ভাজা বড় টুকরো ৮০, মাঝারি ৬০, ছোট টুকরো ৪০ টাকায় এবং গরুর মাংস ভাজা বড় ৬০ ও ছোট টুকরা ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফালুদা বড় ২০০ ও ছোট ১০০ টাকা, ফিন্নি বড় ১০০ ও ছোট কাপ ৫০ টাকা। লাবাং বড় ও ছোট বোতল ২০০ ও ১০০ টাকা। এছাড়া অন্যান্য সব ধরনের ও পদের ইফতারি এবং ফলমূলের পসরাও রয়েছে চকবাজারের ইফতার বাজারে।

সত্যি বলতে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ পুরান ঢাকার ইফতারে ব্যতিক্রম এক আয়োজন। এর স্বাদ নিতে আপনাকে চকবাজারে আসতে হবে। নিশ্চিত করে বলছি, আপনার পয়সা বিফলে যাবে না। ৮০ বছরের ঐতিহ্য এমনি তো আর নয়!




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়