ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

চেরি ফুলের দিন || শান্তা মারিয়া

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৫, ২০ জুলাই ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চেরি ফুলের দিন || শান্তা মারিয়া

(চকবাজার টু চায়না- ১১তম কিস্তি)

মার্চের শেষ থেকে বেইজিংয়ে শীত একটু একটু করে কমতে থাকে। এপ্রিলে আবহাওয়া হয়ে ওঠে দারুণ সুন্দর।

 

তখন দুপুরে বাড়তে থাকে সূর্যের উত্তাপ। একটা হালকা সোয়েটারেই কাজ চলে সকাল আর বিকেলে। দুপুরে হয়তো ফুলহাতা শার্ট পরে ঘোরা যায়। গাছে কচি পাতা ফুটতে থাকে। শীতের রুক্ষ শুষ্ক চেহারা বদলে প্রকৃতি বলে দেয় বসন্ত এসেছে জনপদে। গাছে গাছে সবুজ পাতার সঙ্গে ফুটছে রকমারি ফুল। পথের পাশে ফুটেছে এক ধরনের হলুদ ফুল। এর নাম ইংছুন হুয়া ফুল। চীনা ভাষায় এর অর্থ বসন্তকে স্বাগত জানানোর ফুল।

 

সেই ফেব্রুয়ারিতে ঘোর শীতের মধ্যে বসন্ত উৎসব পালন করলেও এপ্রিলে এসেছে সত্যিকারের বসন্ত। সিআরআই ভবনের পাশে চোখে পড়ছে চেরি ফুল। হালকা গোলাপি আর সাদা। দারুণ শোভা এর। বিভিন্ন পার্কের চেরিগাছগুলোতে ফুল এসেছে। বসন্তের একবারে শুরুতেই চেরিগাছ ফুলে ভরে ওঠে। ভারি এদের তাড়া।

 

আবার একটু গরম পড়লেই ঝরে পড়ে ফুল। বিভিন্ন পার্কে চলছে চেরিব্লজম ফেস্টিভাল বা চেরিফুল ফোটার উৎসব। খবর পেলাম ইউইউয়ানথান পার্কের চেরি উৎসব বেশ বিখ্যাত। এর আগে ইউরোপ ও আমেরিকায় এবং বিশেষ করে জাপানে চেরি উৎসবের কথা শুনেছি, দেখেছি। ভাবলাম চীনের চেরি উৎসব দেখতে হবে।

 

এপ্রিলের ৮ তারিখে এক ছুটির দিনে মেলা দেখতে বের হলাম আমি আর সহকর্মী শিহাব। ইউইউয়ান থান আমার বাসস্থান শিজিংশান থেকে বেশি দূরে নয়। চারটে কি পাঁচটা সাবওয়ে স্টেশন।স্টেশন থেকে বেরিয়ে পার্কের দিকে এগোতে এগোতেই টের পেলাম বিশেষ কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটছে। কারণ দলে দলে শিশু, তরুণ তরুণীরা যাচ্ছে পার্কের দিকে। তাদের অনেকের মাথাতেই ফুলের মুকুট। রাস্তাতেও বিক্রি হচ্ছে খেলনা এবং কাপড়ের তৈরি ফুল ও পাতার মুকুট। ইউইউয়ান থান পার্কের কাছে এসে থমকে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কি বিশাল পার্ক! ১৩৭ হেক্টর জায়গা নিয়ে এই পার্ক।

 


এই এলাকার নাম হাইডিয়ান।এই পার্কে রয়েছে ২০ প্রজাতির ২ হাজার চেরিগাছ। এই চেরিগাছগুলোর রয়েছে আবার বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য। চীন-জাপান বিবাদের কথা তো প্রায় সবারই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীনে জাপানের আক্রমণ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা। লেখা হয়েছে অনেক গল্প। মোটকথা জাপানকে শত্রু দেশ বলেই বেশির ভাগ চীনা মনে করে। তবে দুদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে অনেক বছর ধরেই বন্ধুত্বপূর্ণ বলা হয় সরকারিভাবে। যদিও মাঝেমধ্যেই দ্বীপ বা সমুদ্রের সীমানা নিয়ে পরিস্থিতি গরম হয়ে ওঠে। যাই হোক,চীন জাপানের স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২ সালে বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ চীনে ১০০০ চেরিগাছের চারা উপহার পাঠায় জাপান। জাপানি ভাষায় চেরি ফুলের নাম সাকুরা। সেই ১০০০ গাছের মধ্যে ১৮০টি রোপণ করা হয় ইউইউয়ান থান পার্কে।

 

এখানে দুই ধরনের চেরি গাছ আছে। এক ধরনের গাছে ফুল আসে বসন্তের শুরুতেই। অন্য রকম গাছে একটু দেরিতে ফোটে ফুল। আগে ফোটা ফুলে ভরে আছে পার্কের চেরিগাছগুলো। গোলাপি, সাদা, পার্পল, হলুদ- কত যে রং আর তার বাহার। সঙ্গে চলছে মেলা।

 

টিকেট কেটে মেলায় ঢুকলাম। বসন্তের চমৎকার বাতাস বইছে। ঝকঝক করছে রোদ। ছুটির দিন বলে মেলায় উপচে পড়া ভিড়। মেলার স্টলগুলো ঘুরে দেখলাম। যথারীতি সবচেয়ে বেশি রয়েছে খাবারের স্টল। চীনারা আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছে শুকরের মাংস ভাজা, স্যুপ, নুডলস, পরোটা, আইসক্রিম। আইসক্রিমে আমার কোনো আপত্তি নেই। তাই একটা কোন আইসক্রিম কিনে নিলাম। পণ্য চীনের অন্যান্য মেলায় যেমনটা দেখা যায় তেমনই। আলাদা কোনো বিশেষত্ব নেই। শুধু চেরি উৎসবের জন্য একটা বিশেষ পণ্য রয়েছে। সেটা হলো কাপড়ের ফুল। অজস্র কাপড়ের ফুল বিক্রি হচ্ছে। দেখতে একদম চেরি ফুলের মতো এসব কাপড়ের ফুল স্টিক আকারে বিক্রি করছে দোকানিরা।

 

কত রকম রঙের ফুল যে বিক্রি হচ্ছে তার ঠিকানা নেই। এসব স্টিক বাঁকিয়ে তৈরি হচ্ছে ফুলের মুকুট। দোকানিরাই কাপড়ের ফুল দিয়ে পছন্দসই মুকুট গড়ে দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই শিশু আর তরুণী মেয়েরাইএসব ফুলের মুকুট বেশি পরছে। তবে ছেলেদের মধ্যেও অনেকে দেখলাম ফুলের মুকুট পরে ঘুরছে। এসব লোকজ উৎসবে অংশ নেওয়ার মজাই আলাদা। আমিও একটা ফুলের মুকুট পরে নিলাম মাথায়। শিহাব অবশ্য সং সেজে ঢং করতে রাজি নয় কোনোভাবেই। তাই তার মাথায় মুকুট শোভা পেল না।

 

ছুটির দিন বলে বেশিরভাগ দর্শকই এসেছেন পরিবারে। অনেকেই দেখলাম তাঁবু খাটিয়ে দিব্যি রিল্যাক্স করছে। বয়স্ক মানুষরা নাতিনাতনিদের সঙ্গে এসেছেন বেড়াতে, সঙ্গে ছেলেমেয়েও রয়েছে। অনেক পরিবারেই এমন তিন প্রজন্ম চোখে পড়ল। পরিপূর্ণ শান্তিময় জনজীবনের ছবি।

 

 

ইউইউয়ান থান পার্কে রয়েছে বিশাল লেক। ইস্ট লেক, ওয়েস্ট লেক, বায়ি লেক এবং ইনশুয়ি লেক। এ চারটি লেকের স্বচ্ছ্ব নীলপানি সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে। লেকে নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা রয়েছে। অনেকে নৌকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে লেকে। বেশিরভাগই প্যাডেল নৌকা। আবার একটি লেকে রয়েছে স্পিডবোট। স্পিডবোটে চড়ার রোমাঞ্চ আলাদা। সেই রোমাঞ্চ উপভোগে তরুণ-তরুণীদের ঝোঁক বেশি। পার্কের পাশে রয়েছে ৪০৫ মিটার দীর্ঘ সিসিটিভি টাওয়ার। চীনের সরকারি টেলিভিশনের এই বিখ্যাত টাওয়ারটি অত্যন্ত সুন্দর। নীল আকাশের ক্যানভাসে সিসিটিভি টাওয়ার দেখতে অসাধারণ লাগে। লেকের পানিতে পড়েছে টাওয়ারের ছায়া। কি যে সুন্দর দৃশ্য!

 

প্রতিটি লেকের পাশে বসার জায়গা রয়েছে। আরও রয়েছে এক লেক থেকে অন্য লেকের পাশে যাওয়ার জন্য ছোট ছোট রঙিন সেতু। লেকের পাশে ছায়ায় বসে জীবন উপভোগ করছেন অনেক দর্শক। আমরাও বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলাম লেকের পাশে একটা পাথরের উপর। দুপুরের খাবারটা সেরে নিলামএখানেই। পার্কেও অনেক খাবারের জায়গা রয়েছে, রয়েছে চমৎকার রেস্টুরেন্ট। কিন্তু বাড়ির তৈরি খাবারের মতো সাশ্রয়ী নয় সেগুলো।

 

চেরিগাছ ছাড়াও পার্কে রয়েছে আরও বিভিন্ন জাতের গাছ। কোনো কোনো গাছের পাতা আর ফুলের শাখা ঝুলে আছে লেকের উপর। সবুজ পাতার ছায়া পড়েছে লেকের পানিতে। পার্কে বেড়াতে আসা দর্শকদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই রয়েছে ক্যামেরা। চেরিফুলের ছবি তুলতে ব্যস্ত সবাই। এখানে চীনাদের ছবি তোলার বিষয়ে একটু বলি। এমন সব ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে এরা যে দেখে হাসি চাপা মুশকিল হয়ে পড়ে। শুয়ে বসে উবু হয়ে কত বিচিত্র ভঙ্গি যে করতে পারে এরা।

 

অন্য গাছের ফুলের সৌন্দর্যও কম নয়। শুধু সবুজ পাতা মেলা গাছগুলোর শোভাইকি কম। পার্কের মধ্যে উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথে পাহাড়ি এলাকার আমেজ। রয়েছে চীনের ঐতিহ্যের প্রতীক বাঁশঝাড়। দর্শকের বিশ্রামের জন্য রয়েছে চীনের ঐতিহ্যবাহী রীতিতে নির্মিত ছোট ছোট ছাউনি। এসব ছাউনির ছাদ ও খুঁটিতেও চমৎকার কারুকার্য। পার্কে কয়েকটি ভাস্কর্যও রয়েছে। সেগুলোও কম সুন্দর নয়।

 

সারাটা দিন কেটে গেল প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে। ধীরে ধীরে বিকেল হয়ে রোদ পড়ে এল, গাছের ছায়া হলো দীর্ঘ। সবুজ গাছপালা থেকে বিকেলের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বসন্তের সুবাস। সময় হলো ঘরে ফেরার।

 

আমার ঢাকার বাড়ির ড্রইংরুমে এখনো রাখা আছে পার্কে কেনা সেই ফুলের মুকুটটি। রংটা মলিন হয়ে গেছে। তবু যখনি চোখে পড়ে মনের পাতায় ভেসে ওঠে বেইজিংয়ের ইউইউয়ান থান পার্কে কাটানো সেই দিনটির কথা, মনে পড়ে চেরিফুল উৎসবের আনন্দময় স্মৃতি।

 

 

 

 

ছবি ক্রেডিট : শিহাবুর রহমান

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জুলাই ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ