ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ন দ দ দ

রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৪২, ৩১ জুলাই ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ন দ দ দ

দখলের কারণে ও নাব্যতা বা পানির অভাবে দেশের নদ-নদীর অবস্থা কেমন এই ছবিটি তা বলে দিচ্ছে

রহমান সিদ্দিক : সংস্কৃত ভাষায় কিছু বর্ণও অর্থ বহন করে। ‘ন’ অর্থ জ্ঞান, আর ‘দ’ অর্থ দান। শব্দটি সমাসবদ্ধ করলে দাঁড়ায় ‘নদ’ যার অর্থ যে জ্ঞান দান করে। শব্দতাত্ত্বিক বিচারে এটি আবার যোগরূঢ় শব্দ। নদের স্ত্রী লিঙ্গ নদীর অর্থও তাই। যে কারণে নদীর আরেক নাম সরস্বতী। তিনি বিদ্যা বা জ্ঞানের দেবী।

পৃথিবীতে জ্ঞানের বিকাশ ও সভ্যতার উন্মেষ সম্ভবত নদীকে কেন্দ্র করেই। সম্ভবত কেন পৃথিবীর প্রাচীন সব সভ্যতাই গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে। পৃথিবীর সকল ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থে নদীকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাইবেলে যে ইডেন গার্ডেনের কথা আছে, তাও অবস্থিত ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে। পবিত্র কোরানে যে কয়েকবার বেহেস্ত নিয়ে আলোচনা আছে, প্রত্যেকবারই নদীর উল্লেখ রয়েছে- ‘এর ভিতর দিয়ে নদী বয়ে যাবে।’ বর্তমান লক্ষ্মীর (কর্পোরেট পুঁজি) এ যুগে সরস্বতীকে (জ্ঞানবিভিত্তক সমাজব্যবস্থা) গলা টিপে হত্যা করতে পারলেই বুঝি অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব। অর্থাৎ আজকের দেশের ভেতরে প্রভাবশালী ব্যক্তি আর বিদেশি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের এমনই বাসনা।

উপনিষদে তিন-দ এর অর্থ ও ব্যবহার ভিন্ন দমন কর, দয়া কর ও দান কর। দেবতা, মানুষ ও অসুরেরা প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে বর চাইতে গেলে তিন সম্প্রদায়কে তিন-দ উপহার দেন ব্রহ্মা। বাংলাদেশে প্রবেশ করে এ তিন-দ এর অর্থ পাল্টে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে- দুর্যোগ, দুর্নীতি ও দুঃশাসন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে হয়তো সমানুষের হাত নেই, কিন্তু বাকি দুই ‘দ’ স্বাধীনতার পর থেকেই জাতির ওপর আষ্টে-পৃষ্ঠে জেঁকে বসেছে। এ থেকে জনগণকে মুক্তি দিতে কোনো সরকার তো চেষ্টা করেইনি বরং আরও জোরালো করেছে।

‘দ’ এর গল্প বাদ দিয়ে এ যাত্রায় নদ বা নদীর গল্প বলা যাক। সদ্যপ্রয়াত ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও পরমাণু বিজ্ঞানী এপিজে আবদুল কালাম বাংলাদেশ সফরে এসে স্বীকার করেছেন, এ দেশের যে জিনিসটি তাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে তা হলো এর চারপাশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলো। আবদুল কালাম মহৎপ্রাণ বলেই নদীপ্রেমের কথা বলেছেন। কিন্তু ব্যক্তি আবুদল কালাম ও ভারতরাষ্ট্র তো এক নয়। এক নয় বলেই হয়তো তিস্তা বা ফারাক্কা বাঁধের ব্যাপারে তার বেদনা থাকলেও করণীয় ছিল না।

বাংলাদেশ গরীব দেশ, কিন্তু এতো নদী যে দেশে থাকে তাকে গরীব বলার কোনো সুযোগ নেই। এর যথার্থ ব্যবহার করতে পারিনি বলে বাংলাদেশ অনেক পিছনে পরে রয়েছে। নদী বাংলাদেশের গর্ব করার মতোই একটি বড় উপাদান। কিন্তু এ নদী একদিকে ধ্বংসের আয়োজন করছে- এ দেশেরই অতি লোভী একটি শ্রেনি, সমানভাবে বন্ধুবেশি প্রতিবেশি রাষ্ট্রও একে হত্যার পায়তারা করছে। অথচ দুই হন্তারকের ব্যাপারেই আমরা নীরব রয়েছি।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মেই নদীগুলোর উৎপত্তিস্থল ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। নদীর সৃষ্টি নিয়ে মানুষের কোনো হাত নেই। আর মানুষের যেখানে হাত নেই, প্রকৃতির নিয়মকেও মানুষ বদলাতে পারে না। সফোক্লিসের অ্যান্টেগনি নাটকে মৃত ভাই পলিনিসেসকে সমাহিত করার অপরাধে যখন অ্যান্টেগনির মৃত্যুদণ্ড হয়, তখন অ্যান্টিগনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান ক্রেয়নকে বলছেন, ‘আপনি মনুষ্যনির্মিত আইনকে বদলাতে পারলেও প্রকৃতির আইনকে বদলাতে পারেন না।’

অ্যান্টেগনি কী বলেছেন, তা নিয়ে রাষ্ট্র ভাবলে রাষ্ট্র নিশ্চই মানবিক হতো। ক্রেয়নও প্রকৃতির নিয়ম বা আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছেন। সেটা ক্রেয়নের জন্য ভালো ফল বয়ে আনেনি। প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রকাঠামোর জন্যও শুভ হয় না। সাময়িক সুবিধা হয়তো হয়, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বিপর্যয় আসবেই। কয়েক বছর আগে ভারতের উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।

দুই দেশের ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে ভারত সরকার ৩৮টি নদীতে ড্যাম, ব্যারেজ ও ছোট-বড় জলবিদ্যুকেন্দ্র নির্মাণ করে একতরফা পানি প্রত্যাহার  করে নিচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এতো বড় সমুহ ক্ষতির কথা ভেবেও এ দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়নি। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে আমাদের কূটনৈতিক সাফল্যকে অনেক বড় করে দেখা হলেও অভিন্ন নদীগুলো বাঁধ দেয়া নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য নেই।

গত জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে সফরে এলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আশার আলো দেখেছিল এ দেশের মানুষ, কিন্তু তা আর হয়নি। তবে পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুধি সমাবেশে মোদি যে চমৎকার ভাষণ দিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের মানুষকে মুগ্ধ করেছে। সঞ্চার করেছিল আশারও। মোদির ভাষণ থেকে সরাসরি উদ্ধৃতিটা তুলে ধরছি- ‘আমি বিশ্বাস করি এবং আমার তো মনে হয় পাখি, বাতাস এবং জল- এই তিনটির কোনোও ভিসা চাই না। আর জল কোনো রাজনৈতিক বিষয় হতে পারে না। এটি মানবিক ভিত্তির ওপর তৈরি। সেই মানবিক মূল্যের ওপর এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। আমরা একজোট হয়ে করব। আপানাদের আশ্বাস অবশ্যই দিচ্ছি। আমি নিজেও বিশ্বাস করি, চেষ্টা পালিয়ে যেতে হবে। বিশ্বাস ভেঙে গেলে চলবে না। (মোদি, ৭ জুন, ২০১৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।

মোদিজি, আমরা আপনার কথায় আশ্বাস স্থাপন করেছি, বিশ্বাসও ভঙ্গ করিনি। কিন্তু অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে আমাদের দেশটাকে মরুভূমি বানিয়ে আপনি কোন্ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলেন। কোন্ আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিদান দিলেন। ওই একই ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সীমান্ত চুক্তি নিয়ে কোনো এক সাংবাদিকের লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আজকের দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত সমস্যার সমাধান জার্মানের বার্লিন প্রাচীর ভাঙার সমতুল্য।’

এটা সত্য যে, সীমান্ত চুক্তি ও ছিটমহল সমস্যার ফলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ দীর্ঘদিনের মানবিক বিপর্যয় থেকে মুক্তি পেয়েছে, কিন্তু নদীগুলোতে বাঁধ দিয়ে ১৬ কোটি মানুষকে মানবিক বিপর্যয়ে ঠেলে দেয়ার অর্থ কী দাঁড়াতে পারে। বরং ফারাক্কা প্রাচীর ও তিস্তা প্রাচীর ভেঙে দিতে পারলে মোদিজি বার্লিন প্রাচীর ভাঙার কৃতিত্বটা নিতে পারতেন।

দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ নিয়ে ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ে কিছু সভা ও মানববন্ধন হলেও দেশের ভিতর থেকে বড় ধরনের কোনো প্রতিবাদ হয়নি। আমাদের বুদ্ধিজীবী ও সুধিসমাজও রহস্যজনক কারণে নীরব। যাদের রাজনীতির মূল এজেন্ডা ভারতবিরোধিতা- সেই বিএনপিও এ নিয়ে কোনো কথা বলছে না। অথচ তারা পারতো এই ইসুতে জনমত গঠন করতে। সম্ভবত ক্ষমতার লোভে মদমত্ত বিএনপি ভারতকে এখন আর চটাতে চাইছে না। আর চাইছে না বলেই ভারতের যে কোনো কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা থেকে তারা সরে এসেছে।

কিন্তু এ নিয়ে বর্তমান সরকার কী করছে? সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণ, সীমান্তচুক্তিসহ অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে বড় ধরনের কিছু কূটনৈতিক সাফল্য রয়েছে। এখন অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধ নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর পরও এর সুরাহা না হলে আন্তর্জাতিক আদালতের স্বরণাপন্ন হওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ভবিষ্যত বাংলাদেশের কথা ভেবে বর্তমান সরকার সে হিম্মত নিয়ে এগিয়ে আসতে পারবে কি। নাকি তারাও এ মুহূর্তে ভারতকে চটাতে চায় না। তবে মনে রাখতে হবে বিষয়টা চটানোর বা শত্রুতার নয়; বিষয়টা মানবিক মূল্যবোধের।

এ তো গেল নদী নিয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যা। সেখানে ভারত আন্তরিক না হলে এ সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। কিন্তু যখন দেখি একে একে বাংলাদেশের নদীগুলো ধ্বংস করছে এ দেশেরই কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, তখন সরকারের কিছুই করণীয় নেই? সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে ডিসিরা জানিয়েছেন, স্থানীয় প্রভাবশালীদের কারণে নদীগুলোর দখল বন্ধ করা যাচ্ছে না। নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান জেলা প্রশাসকদের উদ্বেগের কথা সংবাদ মাধ্যমেও জানিয়েছেন।

নৌপরিবহনমন্ত্রী এর আগেও বলেছেন, যারা নদী দখল করে তারা নব্য ‘রাজাকার’। এখন এ নব্য রাজাকারদের বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিবে সেটাই দেখার বিষয়। একাত্তরের রাজাকারদের বিচার হতে পারলে নব্য ‘রাজাকারদের’ বিচারে বাধা কোথায়। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যখন রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি ক্ষমতাসীন হয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে রাষ্ট্র তার কার্যকারিতা হারাতে বসেছে। দখলদারদের কাছ থেকে নদীগুলো রক্ষার ব্যাপারে নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর আন্তরিকতা রয়েছে বলেই মনে হয়, কিন্তু তা যেন শুধু কথাসর্বস্ব না হয়ে কার্যে পরিণত হয়।

‘ন’ অর্থ শুধু জ্ঞানই নয়; সংস্কৃত ভাষায় এর আরেকটা অর্থ- ’না’। বেদ হয়ে গীতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এসেছে- ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে; শরীর ধ্বংস হয়ে যাবে, পরমাত্মার বিনাশ নাই। পরমাত্মা বলতে এখানে প্রেমকে বুঝতে হবে। শুরু করেছিলাম জ্ঞান দিয়ে। কিন্তু শুধু জ্ঞান থাকলেই তো হবে না; প্রেমও থাকতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছেন, ‘জ্ঞানীর সুখ আত্মগৌরব নামক ক্ষমতার সুখ আর প্রেমিকের সুখ আত্মবিসর্জন নামক স্বাধীনতার সুখ।’ তখন প্রেমকেই গুরুত্ব দিতে হবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে এসে সুধি সমাবেশে শুধু জ্ঞানের কথাই শুনিয়ে যাননি, প্রেমের কথাও বলেছেন। জ্ঞান দিয়ে অনেক যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা যায় সত্যি, কিন্তু প্রেম না থাকলে এর কিছুই টিকবে না। দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোতে বাঁধের বিষয়ে শুধু জ্ঞান দিয়ে বিচার করলে হবে না, প্রেম নিয়ে এগিয়ে যাতে হবে ভারতের সরকারের কাছে। বাংলাদেশের প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যার চেয়ে অন্য কারো বেশি প্রেম আছে বলে মনে করা উচিত হবে না। সুতরাং তার পক্ষেই সম্ভব দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলো নিয়ে ভারতের সঙ্গে জোরালো লড়াই করে যাওয়া। আর আমাদের দেশের প্রভাবশালীদের কথা যদি বলি- তাদের জ্ঞান ও প্রেম কোনোটাই নেই। কারণ লোভ ও মুনাফার সঙ্গে যে প্রেমের সংঘর্ষ চিরকালীন। প্রভাবশালীদের জন্য দরকার আইনের কঠোর প্রয়োগ।   

 

 


রাইজিংবিডি/১ আগস্ট ২০১৫/রহমান/নওশের

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়