ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

গান যখন হামলার সংকেত

শাহেদ হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪২, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গান যখন হামলার সংকেত

শাহেদ হোসেন : আগস্টের সকাল। চট্টগ্রাম,  খুলনা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে রেডিও সামনে নিয়ে অধীর আগ্রহে বসে আছেন কয়েকজন মানুষ। ভেতরে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর বাইরে তার ছিটেফোঁটারও প্রকাশ নেই। এসময় রেডিওতে বেজে উঠলো পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে  ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম  গান ...।’

 

কী আশ্চর্য! গানটি শুরু হওয়ার পর যেন মানুষগুলো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। চেহারায় ফুটে উঠলো প্রশান্ত হাসি। একটু পরেই শুরু হয়ে গেল কর্মচাঞ্চল্য, সাঁজ সাঁজ রব। সংকেত পাওয়া গেছে! সংকেত পাওয়া গেছে!! জাহাজে হামলার সংকেত পাওয়া গেছে।

 

১৯৭১ সালের আগস্টে গানের এই সংকেত পাওয়ার পর বাংলাদেশের চারটি বন্দরে পাকিস্তানি ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিলেন নৌ-কমান্ডো বাহিনী। তাদের অসীম সাহসী এই সাফল্যের বদৌলতে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশিদের তৎপরতার খবর ততক্ষণে জেনে গিয়েছিল পুরো বিশ্ব। আর  নতুন গতিপথের সন্ধান পেয়েছিল বাঙালির মুক্তির লড়াই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে ‘অপারেশন জ্যাকপট’হিসেবে পরিচিত এই অভিযানের সূচনা হয়েছিল দুটি গানের মাধ্যমে। অর্থাৎ গান ব্যবহার করা হয়েছিল যুদ্ধের সংকেত হিসেবে।

 

১৯৭১ সালের মার্চের শুরুর দিকে পাকিস্তানি সাবমেরিন পি এন এস ম্যাংরো ফ্রান্সের তুলন সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যায় নিজেদের সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণের জন্য। ৪১ জন সাবমেরিনারের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি । বিবিসির সংবাদ বুলেটিনে ২৫ মার্চের গণহত্যার খবর শুনে এদের মধ্যে নয়জন পালিয়ে বাংলাদেশে চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত আটজন কৌশলে পালিয়ে স্পেনের মাদ্রিদে অবস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সেখান থেকে তারা চলে যান ভারতে। সুপ্রশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর নৌপথে হামলা চালানোর জন্য জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সিদ্ধান্তে খোলা হয় নৌ-কমান্ডো সেক্টর। ঐতিহাসিক পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে ২৩ মে খোলা হয় গোপন ট্রেনিং ক্যাম্প । এই ট্রেনিং ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম দেয়া হয় সি-২ পি । এখানে ট্রেনিং দেওয়ার জন্য মে মাসের শুরুর দিকে প্রায় ৩০০ জন বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধাকে বিভিন্ন সেক্টরের শিবির থেকে নিয়ে আসা হয়। এদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে, সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যেও শুধু যার এলাকায় অপারেশন চালানো হবে তিনি ছাড়া আর কেউ এই সম্পর্কে জানতেন না।

 

ট্রেনিং শুরুর আগেই যোদ্ধাদের বলে দেওয়া হয়, এটি আত্মঘাতী যুদ্ধ হবে। তাই শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীর ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক ফরমে স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এতে লেখা থাকতো, আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না। ক্যাম্পে তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে যোদ্ধাদের বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেধে সাঁতার, পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার, সাঁতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাতার ইত্যাদি কঠিন কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেওয়া হত ।

 

প্রায় তিন মাস পর ৩ আগস্ট শেষ হয় প্রথম ব্যাচের ট্রেনিং। এই ব্যাচের ১৬০ জন যোদ্ধার ওপর দায়িত্ব দেওয়া হলো বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানিদের যোগাযোগের চ্যানেলগুলো বন্ধ করে দেওয়া। এ অভিযানের নাম রাখা হলো 'অপারেশন জ্যাকপট।' টার্গেট করা হয় চট্টগ্রাম , মংলা , চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে থাকা পাকিস্তানি জাহাজগুলোকে। এ অভিযানে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ৬০ জন, মংলার জন্য ৬০ জন, চাঁদপুরের জন্য ২০ জন এবং নারায়ণগঞ্জের জন্য ২০ জনকে বাছাই করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় চারটি স্থানে মধ্যরাতে কিন্তু রাত ১টার আগে একযোগে শেষ করা হবে । তিনজনের একটি কমান্ডো দল একটি জাহাজ আক্রমণ করবে, যাদের প্রত্যেকের পেটে গামছা দিয়ে একটি লিমপেট মাইন বাঁধা থাকবে। তারা জাহাজের অগ্রভাগে, মাঝখানে এবং শেষ প্রান্তে পানির ছয় ফুট নিচে ওয়ান আওয়ার ডিলে পেন্সিল মেথড ব্যবহার করে মাইনগুলো স্থাপন করবে। এই অভিযানের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৪ আগস্ট। অর্থাৎ পাকিস্তানিদের স্বাধীনতা দিবসেই তাদের ওপর চালানো হবে ভয়াবহ হামলা।

 

সার্বিক দায়িত্বে নিযুক্ত চারটি দলের কমান্ডারকে দেওয়া হয় হালকা অথচ শক্তিশালী একটি ট্টানজিস্টার সেট। তাদেরকে অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল বিশেষ গোপনীয় সংকেত, যা দলের অন্য সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল। দলনেতাদের বলা হয়েছিল, দুটি বাংলা গানকে সতর্ক সংকেত হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আর এ গান দুটি প্রচার করা হবে কলকাতা আকাশবাণীর পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে সকাল ৬টা থেকে ৬.৩০ মিনিট অথবা রাত ১০.৩০ মিনিট থেকে ১১টার মধ্যে। এই ফ্রিকোয়েন্সির নাম ও গান দুটিই কেবল দলনেতারা জানতেন। কোনো কারণে গান শুনতে না পারলে ভেস্তে যাবে সমস্ত পরিকল্পনা।

 

এই সাংকেতিক গান দুটি ছিল, আল্পনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া শিশু সংগীত ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি ...।’ এটি হবে প্রথম সঙ্কেত, এর অর্থ হবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ২য় গান প্রচার হবে। এর মধ্যে আক্রমণের সকল প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। চূড়ান্ত সংকেত অর্থাৎ দ্বিতীয় গানটি ছিল পঙ্কজ মল্লিকের ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলাম গান ...।’ এই গানটি শোনার মানে হচ্ছে যেভাবেই হোক ওই রাতেই আক্রমণ করতে হবে।

 

প্রথম দফার অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো ১৩ আগস্ট সকালে। ট্টানজিস্টার খুলতেই আকাশবানীর খ কেন্দ্র থেকে ভেসে আসে ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুর বাড়ি ...।’ কমান্ডাররা বুঝতে পারেন আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরেকটি গান তারা শুনতে যাচ্ছেন। আর সেই প্রতীক্ষিত গানটি শোনার পর সে ট্টানজিস্টার ফেলে দিতে পারবেন।  অপারেশন জ্যাকপট সফল না হওয়া পর্যন্ত তাদের আর কোন গান শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রেডিও শুনতে হবে না। ২৪ ঘণ্টা পর অর্থাৎ ১৪ আগস্ট শোনা গেল দ্বিতীয় গান ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান ...।’

 

এরপরই চার কমান্ডার পুরোদমে প্রস্তুত হয়ে যান তাদের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর জন্য। কিন্তু এর মধ্যেই গুজব ছড়িয়ে পড়ে  ১৪ আগস্ট পাকিস্তান দখলদারবাহিনীর ওপর মুক্তিবাহিনী সাংঘাতিক আক্রমণ চালাবে। এ কারণে শত্রুরা ছিল পুরো সতর্ক অবস্থায়। তাই শেষ পর্যন্ত অপারেশনের তারিখ একদিন পেছানো হয়। ১৫ আগস্ট এ অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। ১৫ আগস্ট রাত ১টা ৪০মিনিটে কান ফাটানো আওয়াজে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম কেঁপে উঠলো। রাত ১টা ৪৫ মিনিটে আরেকটি প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তারপর তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম । একটির পর একটি বিস্ফোরণে চট্টগ্রাম তখন থরথর করে কাঁপছে। ততক্ষণে ডুবতে শুরু করেছে বন্দরে থাকা ৬ নম্বর ওরিয়েন্ট বার্জ, আল-আব্বাস ও হরমুজসহ নয়টি জাহাজ।

 

মংলায় সাবমেরিনার আহসান উল্লাহর নেতৃত্বে অভিযান শুরু হয় ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে।  ২৪ জন নৌ-কমান্ডো ৬টি বিদেশি জাহাজে মাইন লাগান। ভোর ৬টা ৩০ মিনিট থেকে বিকট শব্দে ফাটতে শুরু করে একের পর এক মাইন। তলিয়ে যায় একটি পাকিস্তানিহ ছয়টি জাহাজ। চাঁদপুরে মাইন বিস্ফোরণে ধ্বংস হয় ২টি স্টিমার এবং গমবাহী একটি জাহাজসহ ছোট বড় নৌযান। নারায়ণগঞ্জ অপারেশনে মোট ৪টি জাহাজ ও বেশ কয়েকটি নৌযান ধ্বংস হয়।

 

তথ্যসূত্র :

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র- দশম খণ্ড

একাত্তরে বাগেরহাট : স্বরোচিষ সরকার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খুলনা জেলা - ড. শেখ গাউস মিয়া।

অপারেশন জ্যাকপট : সেজান মাহমুদ।

লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে : রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম।

দৈনিক সমকাল, ১১ ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ ডিসেম্বর ২০১৬/শাহেদ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়